।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়

শিউলি ফুলের মালা

(১)
জানালার পাশের শিউলিগাছটার দিকে আনমনা হয়ে তাকিয়ে ছিলেন গায়ত্রী। শরৎ সকালের স্নিগ্ধ বাতাসে মিশে রয়েছে শিউলিফুলের গন্ধ। ধূপের থেকেও পবিত্র সেই সুবাস জানান দিচ্ছে পুজো আসতে আর বেশি দেরী নেই। সাদা পাপড়িওয়ালা কমলা বোঁটার ফুলগুলোকে দেখলে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায় গায়ত্রীর। ওর বাপেরবাড়িতে উঠোনের কোনে এমনই একটা শিউলিগাছ ছিল। রোজ সকালে কোঁচড় ভরে ফুল কুড়িয়ে নিতো গায়ত্রী, পরম যত্নে মালা গেঁথে পরিয়ে দিতো ঠাকুরের গলায়। শিউলিফুলের কমলা রং আঙুলে লেগে থাকতো অনেকক্ষণ, সেই স্কুলে যাওয়া অবধি। গায়ত্রীর স্কুলড্রেস ও তো ছিল শিউলিফুলের মতোই, কমলা আর সাদা; ছোটবেলায় সাদা জামার সাথে কমলা স্কার্ট তারপর কমলা শাড়ি, সাদা ব্লাউজ। কাঁধের ওপর দুটো লম্বা বেনী দুলিয়ে বন্ধুদের সাথে স্কুলে যেতো গায়ত্রী। ওকে দেখার জন্য বখাটে ছেলেরা ওঁত পেতে বসে থাকতো, ও কিন্তু কাউকে পাত্তা দিতো না।
একটা খসখস শব্দ শুনে ফিরে তাকালেন গায়ত্রী। চামেলী এসেছে ঘর ঝাঁট দিতে।
“কি গো, আজ তোমার এতো দেরী কেন ? এখন তো দেখি রোজই একটু দেরী করে আসো।”
“আর বোলো না মাসিমা। দিন কয়েক হল একটা নতুন বাবু এসেছে। বড় পিটপিটে। ওখানে কাজ করতে করতেই তো দেরী হয়ে যায়।”
নরেন্দ্রপুরের এই ‘নতুন জীবন’ বৃদ্ধাবাসে বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে ফেলেছেন গায়ত্রী। একমাত্র ছেলে চাকরি পাওয়ার পর থেকেই বাড়িছাড়া। যৌথ পরিবার প্রিয়জনের অভাব খুব একটা বুঝতে দেয় না তাই শ্বশুরবাড়িতে সুখে-দুঃখে কেটে যাচ্ছিল বিধবা গায়ত্রীর দিন, রাত। বাকি জীবনটা হয়তো এভাবেই কেটে যেতো কিন্তু বাধ সাধলো ভগ্নপ্রায় শরিকি বাড়িখানা। বিশাল বাড়িটায় অনেক ফাটল ধরেছে, সুস্পষ্ট হয়েছে বট-অশ্বত্থের শিকড়, আস্তানা গেড়েছে তক্ষক আর বাস্তুসাপ। কেউই গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে বাড়ি মেরামত করতে ইচ্ছুক নয়। অগত্যা প্রোমোটার ভরসা। এতোদিন পর ছেলে আর মাকে নিজের কাছে রাখতে ইচ্ছুক নয়, তার নিজস্ব সংসার আছে, মা সেখানে বোঝা। আবার মাকে একা ফেলে রাখাও যায় না, লোকে কি বলবে। তাই গায়ত্রীর গতি হল বৃদ্ধাশ্রমে।
“বাবুর এই বয়সেও কি খেলাধুলোর শখ। সঙ্গে করে একখান ফুটবল এনেছে। বলছিল একদিন সবাই মিলে ম্যাচ খেলবে।” কাজ করতে করতে আপনমনে বকে চলেছে চামেলী।
“তোমার নতুন বাবুর নাম কি ?”, জিজ্ঞেস করলেন গায়ত্রী।
“বাবুকে দেখতে যেমন কার্তিক ঠাকুরের মতো নামখানাও তেমনই বাহারি, অরুনেশ্বর।”
জবাব শুনে থমকে গেলেন গায়ত্রী। মৃদুস্বরে জানতে চাইলেন,” দেখতে কেমন তোমার বাবুটিকে ?”
“ওই যে বললাম না, একেবারে কার্তিক ঠাকুরের মতো। পটলচেরা চোখ, বাঁশির মতো নাক, কোঁকড়ানো চুল আর গায়ের রংটা একেবারে সাহেবদের মতো, ধবধবে ফর্সা।”
বর্ননা শুনে খাটের ওপর বসে পড়লেন গায়ত্রী। ওঁর রক্তহীন, নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে চামেলী একটু ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,” কি হোলো মাসিমা ? শরীর খারাপ লাগছে ? ম্যানেজারবাবুকে ডাকবো ?”

(২)
বিধুশেখর বাঁড়ুজ্যে রক্তচক্ষুতে কনিষ্ঠা তনয়াটির দিকে কটাক্ষপাত করে বললেন,” এ সব কি শুনছি তোমার সম্বন্ধে ? তুমি না কি একটা নীচু জাতের ছোঁড়ার সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছো ?”, একবার মাথা গরম হয়ে গেলে আর শালীনতার পরোয়া করেন না বিধুশেখর।
গায়ত্রী কিছু বলার আগেই গোবিন্দলাল বলে উঠলো,”নস্করপাড়ার কালী মাস্টারের ছেলে অরুন, আমার সাথে একই ক্লাসে পড়তো। এক্কেবারে অকালকুষ্মান্ড। সারাদিন চাড্ডি বখাটে বাউন্ডুলে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলে বেড়ায়।”
স্থানীয় নিম্ন বুনিয়াদী স্কুলের শিক্ষক কালীকিঙ্কর নস্করের বড়ছেলে অরুনেশ্বরের সাথে গোবিন্দলালের শত্রুতাটা বেশ পুরোনো, সেই স্কুলে পড়ার সময় থেকেই চলছে। লেখাপড়া খেলাধুলো সবদিক দিয়ে ক্রমাগত পরাজিত হতে হতে গোবিন্দলালের মনের মধ্যে জিদ চেপে গিয়েছিল বদলা নেওয়ার। আজ সে সুযোগ এসেছে, গোবিন্দলাল মুচকি হেসে শ্যেণদৃষ্টিতে তাকালো গায়ত্রীর দিকে। গায়ত্রী মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
বিধুশেখর ফরমান জারি করলেন,”আগামী অঘ্রাণেই আমি গায়ত্রীর বিয়ে দেবো।” তারপর জেষ্ঠপুত্র নন্দলালের উদ্দেশ্যে বললেন,”বড়বউমার পিসতুতো ভাই ভালো চাকরি করে বলেছিলে না, তার সাথেই তাহলে কথা পাকা করো।” ঘাড় নেড়ে সন্মতি জানালো নন্দলাল। এবার বিধুশেখর বিমলাদেবীর উদ্দেশ্যে কড়া স্বরে বললেন,”যতদিন না বিয়ে হচ্ছে ততদিন মেয়েকে একটু চোখে চোখে রাখো। ও যেন একা বাড়ির বাইরে না যায়।” কাঠের পুতুলের মতো স্বামীর কথায় সায় দিলেন বিমলাদেবী।

(৩)
পথশিশুদের নতুন জামাকাপড় দেওয়া, রাস্তার ধারে কুকুর-বেড়ালের মতো অবহেলায় পড়ে থাকা মানসিক রোগীদের চুল, দাড়ি কেটে সাবান মাখিয়ে সাফ-সুতরো করা, ভিখারিদের ভরপেট খাওয়ানো- গত কয়েক বছর ধরে ‘হেল্পিং হ্যান্ড’ এন,জি,ও-র পুজোর কর্মসূচীতে এইগুলোই অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছে। তবে এ বছর সংস্থার কর্ণধার বদলেছে আর তার সাথেই বদলেছে কর্মসূচীও। তাই এ বছর ‘নতুন জীবন’ বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের লাক্সারি বাসে চাপিয়ে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাওয়া হবে।
‘হেল্পিং হ্যান্ড’-এর কর্মীদের বাড়িয়ে দেওয়া সাহায্যের হাত ধরে ‘নতুন জীবন’-এর বয়স্ক মানুষজনেরা ধীরে ধীরে বাসে উঠে যে যার সিটে বসে পড়লেন। গায়ত্রী খুশিমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বাস চলতে শুরু করতেই উনি থতমত খেয়ে পাশে বসা অরুনেশ্বরের হাতখানা চেপে ধরলেন। অরুনেশ্বর ভরসা মাখানো হাত রাখলেন গায়ত্রীর হাতের ওপর।
অরুনেশ্বরের দুই মেয়ে, দুজনেই বিবাহিত, ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের সুখের সংসার। স্ত্রী বিয়োগের পর দুই মেয়েই বাবাকে নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু অরুনেশ্বর রাজি হননি। যে মেয়েদের কাছে তিনি একদিন সুপারম্যান ছিলেন আজ তাদের বাড়িতেই ডোবারম্যান হয়ে থাকার কোনো ইচ্ছাই নেই অরুনেশ্বরের। তাই স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়েছেন ‘নতুন জীবন’ বৃদ্ধাবাসে, খুঁজে নিয়েছেন নতুন জীবন।
যে সমাজের জন্য, যে পরিবারের জন্য গায়ত্রী আর অরুনেশ্বর অতীতে এক হতে পারেননি আজ সেই সমাজ, সেই পরিবারের জন্যই ওঁরা আবার একসাথে। গায়ত্রী তাকালেন অরুনেশ্বরের চোখের দিকে, সেই আগের মতো করে। অরুনেশ্বরের চোখেও সেই পুরোনো ভালোবাসার রেশ। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বাইরে তাকালেন গায়ত্রী। কাল বলবেন চামেলীকে, কয়েকটা শিউলি ফুল এনে দিতে। দৃষ্টিশক্তি কমে গিয়েছে তাই আর মালা গাঁথার ক্ষমতা নেই, শ্বেত পাথরের রেকাবে সাজিয়ে ফুলগুলো দেবেন অরুনেশ্বরকে।
ট্র্যাফিক সিগন্যালের লাল আলো কিছুক্ষনের জন্য থামিয়ে দিয়েছিলো বাসটাকে। সবুজ সংকেত পেয়ে বাস আবার চলতে শুরু করেছে, এগিয়ে চলেছে গন্তব্যের দিকে…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।