সাপ্তাহিক ধারাবাহিক ঐতিহ্যে “কলকাতার চার্চ (কোম্পানীর যুগ)” (পর্ব – ৯) – লিখেছেন অরুণিতা চন্দ্র

আগের পর্বে ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কলকাতায় ব্যাপ্টিস্ট মিশনারী সোসাইটি ও লন্ডন মিশনারী সোসাইটি কর্তৃক স্থাপিত চার্চগুলির কথা আলোচনা করা হয়েছে। এর পরেই আসে তৃতীয় মিশনারী সোসাইটি অর্থাৎ চার্চ মিশনারী সোসাইটি দ্বারা কোম্পানি কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত চার্চটির কথা যার নাম হোলি ট্রিনিটি চার্চ।১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের চার্টার এক্টে যখন মিশনারী কার্যকলাপের উপর বিধিনিষেধ শিথিল করা হয় তখন থেকেই বিভিন্ন মিশনারী সংগঠন ভারতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে চার্চ মিশনারী সোসাইটির দুজন সদস্য সর্বপ্রথম মাদ্রাজে পৌঁছন। ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা কলকাতায় আসেন ও খিদিরপুরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। চার্চ মিশনারী সোসাইটির উদ্দেশ্য ছিল মূলতঃ তিনটি , প্রিন্টিং প্রেস প্রতিষ্ঠা, স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং চার্চ ও মিশনারীদের জন্য একটি গৃহ প্রতিষ্ঠা। কারণ বেশিরভাগ সময়ই ধর্মান্তরিত দেশীয় রা তাঁদের পিতৃগৃহ থেকে বিতাড়িত হতেন। তাঁদের আশ্রয়, শিক্ষাদান ও জীবিকার সংস্থান প্রয়োজনীয় ছিল। তাঁদের কার্যালয় ছিল যে অঞ্চলে তা জঙ্গল, চর্ম কারখানা আর সমাজবিরোধী অধ্যুষিত হওয়ায় শহরের মধ্যে একটি জমির প্রয়োজন হয়। সোসাইটির সেক্রেটারি রেভারেন্ড Josia Prath-এর সুপারিশে বর্তমানের ৩৩, রাজা রামমোহন সরণীর ঠিকানায় চার্চের জন্য জমি ক্রয় করা হয় ২০,৪০০ টাকা অর্থমূল্যে। মেজর Kipps নামক এক সদস্য আরো ৩০,০০০ টাকা দান করেন। চার্চের বর্তমান ঠিকানায় আদিতে থাকা পুকুরটি বুজিয়েই চার্চটি নির্মিত হয়। প্রথমে ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে চ্যাপেল ও ইংরাজি স্কুল উদ্বোধনের জন্য এক বৃহৎ হলঘর নির্মিত হয়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিওর অন্যতম শিষ্য এবং বাংলার নবজাগরণের উজ্জ্বল নক্ষত্র এই স্কুলে সুপারিনটেনডেন্ট হিসাবে যোগ দেন। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পদে আসেন রেভারেন্ড জেমস লং, বাঙালির এবং কলকাতার ইতিহাসচর্চা যাঁর কাছে ঋণী হয়ে আছে।এই স্কুলে জড়িত থাকার সময়েই তাঁর অনুরোধে মাইকেল মধুসূদন দত্ত দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পনের ইংরাজি অনুবাদ করান ও ফলস্বরূপ লং গ্রেপ্তার হন। পরে তাঁর হয়ে জরিমানা দিয়ে তাঁকে মুক্ত করেন কালীপ্রস্নন সিংহ। তাঁর নামানুসারেই চার্চটি পরিচিত হয় লং সাহেবের গীর্জা নামে।
প্রথমে চ্যাপেলের জন্য শুধু হলঘর হলেও খুব দ্রুতই নেটিভ খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় পরিপূর্ণ চার্চের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৮২৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে Archdeacon of Calcutta diocese রেভারেন্ড Daniel Corie চার্চের শিল্যান্যাস করেন। যেহেতু কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল তাই কলকাতার বিশপ ছিলেন ভারত এমনকি অস্ট্রেলিয়ার ও খ্রিষ্টধর্মের প্রধান গুরু তাই বিশপ কলকাতায় না থাকলে এই Archdeacon ডেপুটি বিশপ হিসাবে দায়িত্ব সামলাতেন। প্রতি প্রেসিডেন্সিতেই এই পদটি সৃষ্টি হয়েছিল। ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে চার্চটি উদ্বোধিত হয়। চার্চের সংলগ্ন একটি রাস্তাও নির্মিত হয় যা বর্তমানে রাজা রামমোহন সরণী নামে পরিচিত।প্রথমে চার্চটিকে চার্চ মিশনারী চ্যাপেল এবং পরে ড্যানিয়েল কোরির নামানুসারে কোরি চার্চ ও বলা হত। নিকটস্থ একটি রাস্তার ও নামকরণ হয়েছিল কোরি লেন। ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে কলকাতার পঞ্চম বিশপ এবং ভারতের প্রথম মেট্রোপলিটন বিশপ রেভারেন্ড Daniel Wilson চার্চটি অধিগ্রহণ করেন এবং নামকরণ করেন ‘Holy Trinity Church’ চার্চের প্রথম যাজক ছিলেন রেভারেন্ড Timothy Sandis (১৮৪৫-১৮৬৪) প্রথম বাঙালি যাজক ছিলেন রেভারেন্ড প্যারিমোহন দত্ত।
চার্চটি গ্রীক স্থাপত্যে নির্মিত, শিখরটি পবিত্র ক্রুশচিহ্ন দ্বারা অলঙ্কৃত। গ্রীক চার্চের ন্যায় এর ঘন্টার অবস্থান। মঞ্চের দুইধার অস্ট্রিয়ান কাঁচের জানালা দ্বারা সুসজ্জিত। চার্চের দেওয়ালেও সংরক্ষিত আছে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের উদ্দেশ্যে স্মৃতিফলক।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।