ছোটগল্পে অগ্নিমিতা দাস

সুপ্ত আগ্নেয়গিরি

মিলির হাতে দামী ব্র্যান্ডের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে
নেহা বলল, “ওমা! এটা অহনার ঘড়ি না!”
অহনা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “আমি ওরটা পরেছিলাম, ওটা মিলির!”
– “কিন্তু তুই বললি যে এটা তোর কানাডায় থাকা মাসি প্রেজেন্ট করেছে!”
– “ও, বলেছিলাম বুঝি! কি জানি”, বলে অহনা হাত উল্টোলো!
রেস্তোরাঁয় বসা এডিকেট মানা বন্ধুরা কথা পাল্টে দিল!.
অহনার এই ভালোমানুষী দেখলে মিলির মাঝে মাঝে গা জ্বালা করে!
সবাই জানে অহনার ব্যবহার করা জিনিস মিলি পরে… পরে তো পরে , তাতে কি হয়েছে!
সেটাকে ঢাকতে যাওয়ার কি দরকার!
অহনা ভাবে মিলি বোধহয় কিছু মাইন্ড করবে, কিন্তু
তাতে যে ওর আরো খারাপ লাগে সে বোধ ওর নেই!
অহনা বরাবরই আদুরে আর খুব ভালো মেয়ে!
রায়চৌধুরী পরিবারের আদরের মেয়ে অহনার গভারনেসের মেয়ে মিলি , মায়ের সাথে ওদের বাড়িতেই থাকে!
বিগত চব্বিশ পঁচিশ বছর হয়ে গেল!
মিলির মাকে অহনা নিজের মায়ের মতই দেখে, মিলি কে নিজের বোন!
অহনা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়লে ও মিলি কে ও কিন্তু পাড়ার সদ্য গজিয়ে ওঠা ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করা হয়!
বিরাট ইন্ডাস্ট্রিলিয়েষ্ট কুনাল রায়চৌধুরী উদার মনের মানুষ!
বাড়িতে মিলিকে নিজেদের মেয়ে বলেই দেখা হয়!
তাছাড়া অহনা তো মিলি অন্তপ্রাণ!
মিলি কে না নিয়ে ও কোন কাজ করবেই না!

তাই অহনার জেদেই মিলি আর ও এক কলেজে পড়ে!
মিলি ছোট থেকেই দেখে এসেছে অহনার নামীদামী জামা, ঘড়ি, জুতো সব কিছুই ও পেয়েছে ওর পরার পর!
হয়তো একদিন পরেছে তারপরেই সেটা চলে গিয়েছে মিলির দখলে!
মিলিকে ও দেওয়া হয় কিন্তু অত দামী না!
তাছাড়া দরকার কি!
যেখানে অহনার দৌলতে ওর আলমারি
ব্র্যান্ডেড জামা, জুতোয় ভরা!

একবার মিলির খুব মনে আছে ওর দশ বছরের জন্মদিনে অহনার মা প্রমিতা রায়চৌধুরী তাকে অহনার দুমাস আগের বার্থডের পরীর মত গাউনটা দেয়!
অহনা একদিন‌ই পরেছিল, যেই মিলির পছন্দ হয়েছে অমনি অমন দামী গাউন মিলিকেই দিতে হবে!
মিলি সেদিন অহনার নয়, মিলির নিজস্ব নতুন আনকোরা জামা পরতে ইচ্ছে করছিল!
মিলি ওর মাকে বলাতে শুনতে হয়েছিল, “অনেক ভাগ্য করে এইরকম বাড়িতে কাজ পেয়েছি! কাজের লোকের মত নয় বাড়ির লোকের মত দেখে! না হলে তোর বাপ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আমাদের কি অবস্থা হতো একবার ভেবেছিস!
ভগবানের দয়ায় আমার অহনার ও দয়ার শরীর, তোকে চোখে হারায়!
অতদামী জামা তোর ভালো লেগেছে বলে একদিন পরেই তোকে দিয়ে দিল আর তুই কিনা এটা নিয়ে জিলিপির প্যাঁচ কষছিস?”
মিলির বার্থডে ও দারুন ভাবে সেলিব্রেট করা হল,
কিন্তু বার্থডে গার্ল অহনার গাউন পরলো!
চেনা মানুষরা ভাবলো যমজ বোনের মত থাকে তাই দুজনের একরকম গাউন!
অহনার বিয়ে ঠিক হলো বড়ো
বিজনেসম্যানের বাড়ির এন আর আই ছেলের সাথে!
ছেলের পৈতৃক বাড়ি দিল্লীতে।
কিন্তু কলকাতাতে ও বাড়ি আছে!
ঋত দেশে ফিরলে অভিভাবকদের কথায় কলকাতায় আসে !
শুরু হয় দুজন দুজন কে দেখাশোনার পালা!.
কখনো রেস্তোরাঁয়, কখনো মলে, মাল্টিপ্লেক্সে মুভি
দেখা, ডিস্কোতে দেখাসাক্ষাৎ চলতেই থাকে!
অহনার সাথে অবশ্যই মিলি থাকে !
ঋত অবশ্যই অহনাদের কমন ফ্রেন্ডের মত মিলির সোশ্যাল স্ট্যাটাসটা জানতে পেরেছে!
মিলি ছোট থেকেই বলিয়ে ক‌ইয়ে!
মাঝে মাঝে তো ঋত আর মিলি খোশমেজাজে আড্ডা দেয়! অহনা শুধু শ্রোতা হয়েই থাকে!
সেদিন রাতে শুয়ে মিলি বলে,”ফ্র্যাকলি স্পিকিং! তোর ভয় হয় না ওইরকম হ্যান্ডু যদি তোর বদলে আমার প্রেমে পড়ে যায়!”
অহনা বলে ওঠে, “ভাট বকিস না!.”
– “কেনো আমি না হয় তোর মত ধবেধবে ফর্সা, মাখন সুন্দরী ন‌ই বাট আমি ও যথেষ্ট অ্যকট্রাকটিভ , সেক্সি ফিগার, মাখন ন‌ই পুরো ছুরি, চাক্কু সে জিগার আরপার হো যা গ্যায়া!”
– “চুপ করে শো তো! কিছুই মুখে আটকায় না!
তুই যত বড় সুন্দরী হোস না কেন আমার ঋতের দিকে ভুলে ও তাকাবি না!
এই বিশ্বাস আমার আছে!”
– “বাবা! আমার ঋত! কতটুকু চিনিস ওকে, সবে তো একমাস ও হয়নি!”
– “বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করেছে, বিয়ে হবে
চেনা অচেনা জানি না!
তোকে আমি ছোট্ট থেকে চিনি, রাত হয়েছে!
গুড নাইট!”
অহনা ঋত কে সারপ্রাইজ দেবে বলে পছন্দ করে
মান্যবর থেকে পাঞ্জাবি কিনলো!
ওর আবার ট্র্যাডিশনাল ড্রেস বেশি পছন্দ!
সেদিন আবার একা একা গিফটটা নিয়ে ঋত কে
সারপ্রাইজ দেবার ইচ্ছে ছিল, বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে, কারন পরদিন ঋতের জন্মদিন!
সকাল থেকেই অহনার পেটটা ব্যাথা ব্যাথা করছিল!
দুপুর থেকে আরো বাড়লো, অগত্যা মিলিই সহায়!
মিলি বেজার মুখে বিকেলে ক্যাব নিয়ে র‌ওনা হলো!
বাড়ির গাড়ি নেওয়া যাবে না!
ট্র্যাফিক জ্যাম না থাকায় যোধপুর পার্ক থেকে সল্টলেক বেশি সময় লাগলো না!
দরজায় বেলের আওয়াজে ঋত দরজা খুলে মিলি কে দেখে বেশ অবাক!
– “কি হলো উড বি আসেনি, বলে দরজায় দাঁড় করিয়ে রাখবে নাকি!”
– “ইয়েস, ইয়েস কামিং ঋত অপ্রতিভ মুখে বললো!”

তিনঘন্টা পর মিলি যখন গাড়িতে উঠলো, তখন সাইলেন্ট করা মোবাইলে দেখলো ত্রিশ‌টা মিস কল!
অহনা, প্রমিতা, মিলির মা সবাই কল করেছে!
অহনা বোধহয় ঋত কে ও কল করেছিল, কারন ওর ফোনটা বারবার ভাইব্রেট হচ্ছিল!
মিলি ইচ্ছে করেই ফোনটা আনমিউট করল না!
ব্যাগ থেকে আয়না টা বার করে থেবড়ে যাওয়া আইলাইনার, লিপস্টিক ঠিক করতে করতে মনে মনে ভাবছিল, আজকের সন্ধ্যায় সে বুঝেছে ঋতের জীবনে সে হয়তো প্রথম নয় কিন্তু অহনার জীবনে ঋত প্রথম!
এখানেই মিলির প্ল্যান সাকসেসফুল হয়েছে!
এবার অনন্ত মিলি অহনার আগে ঋত কে পেয়েছে!

কিন্তু তবুও কেন তার সদ্য লাগানো আইলাইনার ছাপিয়ে বৃষ্টির ধারা গাল দিয়ে নেমে আসছে!
কেন মনে হচ্ছে গাড়ি থেকে নেমে দূরে কোথাও পালিয়ে যাই, যাতে অহনা কে মুখ দেখাতে না হয়!
বুকটা কেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে বিজয়নী মিলির!
মিলি ঝাপসা চোখে দেখলো তার হাতে অহনার রিস্ট‌ওয়াচটা তে নটা পনেরো বাজছে!!!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।