সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ৬)

সালিশির রায়

কিস্তি – ৬

তাদের সেই কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যায় মোড়লদের বাড়ি থেকে ভেসে আসা মদ্যপ কিছু মানুষের উল্লাসে। মারাংবুরুর পুজোর নামে মোড়লের বাড়িতে ফুর্তির আসর বসে।মারাংবুরুর পুজোর জন্য তাদের বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া একটি মাত্র শুয়োরের দামের সমপরিমাণ টাকা দেয় মোড়ল। সেই টাকাতেই পুজো আর মদ দুই-ই হয়ে যায়। একটা শুয়োর সেই রাতেই কাটা হয়। বাকি দুটি শুয়োর লাভ হয়ে যায় মোড়লের। উপরি হিসাবে জোটে তাদের গয়না আর জমানো টাকা। মোড়ল তাই দারুন খুশী। তাদের অনাচারের জন্য মারাংবুরুর কোপ থেকে কি করে সে গ্রামের লোকেদের রক্ষা করল তাই হেঁকে ডেকে সাতকাহন করে বোঝাচ্ছিল সকলকে। গ্রামের লোকেরাও তেমনি। ভরপেট মদ-মাংস পেলেই হলো। দুহাত তুলেএমনভাবে প্রশস্তি গাইতে শুরু করে মনে হয় যেন মোড়ল নিজের গাঁটের কড়ি খরচ করে খাওয়াচ্ছে।
পাড়ার মানুষ গুলো এমনই ভোলাভালা। জরিমানার সিংহভাগ যে মোড়ল আত্মসাত করে নিতে পারে সেই চিন্তাও তাদের মাথায় আসে না। মোড়লও মদ-মাংস খাইয়ে গ্রামের লোক গুলোকে বোকা বানিয়ে রাখে। এবারও তার অন্যথা হয়না। রাত যত দীর্ঘ হয়, হই হুল্লোড় তত বাড়তে থাকে। খুব অসহ্য লাগে অঞ্জলির। মনে হয় গিয়ে আচ্ছা করে দু’কথা শুনিয়ে দিয়ে আসে। মনে হয় ওই আসরে গিয়ে মোড়লকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে আসে — তোমরা মানুষ না কি ? একদিন আগেই পাড়ারই একটি মানুষ চলে গিয়েছে। একটি পরিবারকে নিঃস্ব করে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। সেই পরিবারটির মানসিক অবস্থার কথা একবার ভাবারও প্রয়োজন মনে হয় না তোমাদের ?
কিন্তু যাওয়া হয় না। দরজার দিকে পা বাড়াতেই তার মনের ভাব আন্দাজ করে দিদি এসে খপ করে তার হাত চেপে ধরে বলে — তুই কি পাগল হয়ে গেলি ? কোথাই কি বলতে যাচ্ছিস , ওরা কি আর মানুষ আছে ? কি করতে কি করে ফেলবে তার কোন ঠিক আছে ? সেটা অঞ্জলিরও ভালোই জানা আছে। বিভিন্ন সময় সে দেখেছে , মদ ওরা খায় না, বরং মদেই ওদের খায়। আর সব বুদ্ধি – বিবেচনা হারিয়ে ফেলে। কারও কারও ভিতরে সহমর্মিতা বোধ কাজ করলেও তা গ্রাস করে নেয় মদের নেশা। ওদের হই হুল্লোড় যে কত রাত পর্যন্ত চলেছিল তা জানতে পারে নি অঞ্জলিরা। খিদে, ক্লান্তিতে কখন যে তারা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে।
এই ঘুমটা বড়ো প্রয়োজন ছিল তাদের। বিশেষ করে বাবা- মায়ের। কারণ তারা খাটতে না গেলে তো হাঁড়ি চড়বে না। সকাল হতেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে সবাই। দরজা খুলতেই শুরু হয়ে যায় আর এক বিপত্তি। মোড়লের বাড়ি থেকে শুয়োরগুলো চলে আসে তাদের বাড়িতে। আর ভাইয়েরই বয়সী মোড়লের ছেলেটা সেগুলোকে ডাকিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য লাঠি উঁচিয়ে হাজির হয়। ভাই কিছুতেই শুয়োরগুলিকে নিয়ে যেতে দেবে না, আর মোড়লের ছেলেটা নিয়ে যাবেই। এই নিয়ে দুজনের হাতাহাতি হয় আর কি ? দিদি ছুটে গিয়ে ভাইকে কোলে নিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। ভাই ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, ওদের কত কি আছে। তাও আমাদের শুয়োর নিয়ে যাবে কেন ? এখন আমি কার সঙ্গে খেলব ? ভাইয়ের চোখ ঠলঠল করে ওঠে।কান্না পাওয়ারই কথা। শুয়োর গুলো যখন একেবারে বাচ্চা তখন থেকে ভাইটা সেগুলো নিয়ে খেলা করত।
তাই ভাইকে ভোলাতে অঞ্জলি বলে , রাত থেকে কিছু খাস নি। শুধু শুয়োর নিয়ে খেলা করলেই হবে। কিছু খেতে হবে না ? সেন্টার থেকে খিচুড়ি এনেছি খাবি না ? কাল থেকে কারও পেটে কিছু পড়ে নি। তারা না হয় বাবা-মা চালডাল নিয়ে না ফেরা পর্যন্ত না খেয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ভাইটা তো তা পারবে না। তাই সকালেই গ্রামের অঙ্গণওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে খিঁচুড়ি আর সবজি নিয়ে আসে। ভাই ওখানেই পড়ে। এমনিতে রোজ রোজ খিচুড়ি খেতে চায় না। কিন্তু আজ আর না করে না, বরং গোগ্রাসে খাই। আর পেট ভরতেই শুয়োরের বায়না ভুলে যায়। মোড়লদের ছেলে মেয়ের সঙ্গেই খেলায় মেতে ওঠে। বাচ্ছারা কত সহজেই সব কিছু ভুলে যায়। তারাই ভুলতে পারে না।
সেদিনের সেই লাঞ্ছনা কথা ঘুরে ফিরে মনে পড়ে যায়। আর মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। সেই বিষন্নতা গ্রাস করে নেয় দাদা– দিদির বিয়ের দুঃশ্চিন্তা। নির্ধারিত বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসে ততই উৎকণ্ঠা বাড়ে বাবার। এমনিতে তাদের সমাজে বিয়েতে পাত্রীপক্ষকে পণ দিতে হয় না। বরং পাত্রীর মায়ের দুধের আর বাবার ভাতের ঋণ হিসাবে একটা বকনা গরু আর এক বিশ ধান দিতে হয় পাত্রপক্ষকে। সেই হিসাবে দিদির বিয়েতে বরযাত্রীর খাওয়া ছাড়া তেমন কিছু খরচ নেই। তাই বাবা দাদার বিয়েটা ভেঙে দিয়ে শুধু দিদির বিয়ে দেবে বলে ঠিক করে।শুনে দাদা কিছুটা মুসড়ে পড়ে। বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার পর দাদা মনে মনে হয়তো রঙীন জাল বুনেছিল , তাই তার মুসড়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। শেষ পর্যন্ত আসরে নামতে হয় তাকে। একদিন কাজ থেকে ফেরার পর সন্ধ্যায় বাড়ির সবার সামনে বাবাকে সে বলে — তুমি দাদার বিয়েটা শুধু শুধু ভেঙে দিতে চাইছো কেন ?
—- শুধু শুধু কি বলছিস , আমি কোথাই পাবো বকনা গরু কেনার টাকা , কোথাই পাবো এক বিশ ধান। ওইসব কেনার জন্যই তো শুয়োর গুলো পেলেছিলাম। কিন্তু মোড়ল সব নিয়ে নিল। আমি এখন কোথাই পাবো টাকা ?
—- কিন্তু আমি যদি গরু আর ধানের ব্যবস্থা করে দিই ?
—- তুই ! তুই কি করে ব্যবস্থা করবি ?
—– তুমি তো দাদা আর দিদির বিয়ে একদিনে দেবে ঠিক করেছিলে। কিন্তু ধরো যদি দিদির বিয়েটা আমরা কয়েকদিন আগে দিই , আর দিদির শ্বশুর বাড়ি থেকে পাওয়া গরু আর ধান দিয়ে যদি দাদার শ্বশুরবাড়ির দুধ- ভাতের ঋণ শোধ করি তাহলে কেমন হয় ?
তার কথা শুনে হাসি ফুটে ওঠে বাবার চোখে মুখে। হাসি মুখে বলে — তাই তো এটা তো ভাবি নি। এজন্যই বলে লেখাপড়া করা মাথা।
—- তাহলে বলো আমাকে পড়া ছাড়াবে না ?
— বেশ রে তাই হবে।
এত সহজে সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়ায় স্বস্তি ফেরে গোটা পরিবারে। হাসি ফোটে দাদার মুখেও। সে বলে, সত্যি তোর বুদ্ধি আছে।
—– উহু, ওসব বলে ছেড়ে দিলে হবে না।
—- তাহলে বল কি দিতে হবে ?
— সে আমি সময় মতো চেয়ে নেব।
দিদিও এসে যোগ দেয় তাদের সঙ্গে — আমার বিয়ের জন্যই কিন্তু তোর ভাঙা বিয়ে জোড় লাগল তা মনে রাখিস। সেই হিসাবে আমার কিছু পাওনা হয়।
সবার হাসি ঠাট্টায় কয়েক দিন ধরে জমাট বেঁধে থাকা দমবন্ধ পরিবেশটা কেটে গিয়ে কেমন যেন স্বস্তির সুবাতাস বইতে থাকে।সে সময় মা এসে আলোচনায় যোগ দেয়। তাকে উদ্দেশ্য করেই বলে , শুধু দুধ-ভাতের ঋণ শোধের ব্যবস্থা হলেই হবে ? মোনামুনি , ভোজ, ছেলের বিয়ের তো আবার রাত্রি যাপনেরও খরচ আছে। সেসব কি ভাবে যোগাড় হবে শুনি ?
ফের দুশ্চিন্তার ছায়া ঘনিয়ে আসে পরিবারে। কিন্তু কয়েকদিন পরই সেই মুসকিল আসান করে দেয় কুঁয়ে নদী। এমনিতেই কুঁয়েকে দুঃখের কুঁয়ো বলে নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষজন। কোপাই আর বক্রেশ্বরের মিলনে লাভপুরের মিলনপুরে সৃষ্টি হয়েছে কুঁয়ের।দুই নদীর স্রোতধারা বোধ হয় একা ধারণ করতে পারে না কুঁয়ে। তাই প্রায় প্রতিবছরই তার স্রোতধারায় দুই তীরবর্তী জনপদ প্লাবিত হয়ে লণ্ডভন্ড করে দেয় অঞ্জলিদের ঘর গৃহস্থালি। তলিয়ে যায় বিঘের পর বিঘে আবাদী ধানী জমি। সেই জল সরতে সরতে জমির ধান হেজে মজে শেষ হয়ে যায়। ধান তো নয় , যেন রক্ত জল করে বোনা সব ছোট ছোট স্বপ্ন। কারো স্বপ্ন থাকে ধান তুলে বাড়িটাকে একটু বাসযোগ্য করে তোলার, কেউ স্বপ্ন দেখে নতুন বৌয়ের নাকে একটা ঝিলিক দেওয়া নাকছাবির। ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়ে একটু ঝাড়া — হাত পা হওয়ার স্বপ্নও থাকে কতজনের।
কিন্তু অধিকাংশ বছর কুঁয়ে সেইসব স্বপ্ন ভেঙে দেয়। নদীর গ্রাসে ফসল হারিয়ে শুন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয় কৃষাণ – ভাগচাষীদের। তাদের স্বপ্ন তো পূরণ হয়ই না, মাঝখান থেকে ঘাড়ে চেপে বসে থাকে খাদ বাবদ মুনিবের থেকে নেওয়া ঋণের বোঝা। সে বোঝা ঘাড় থেকে সহজে আর নামে না। সেই ঋণের চাপে জল ডোবা ফসলের মতোই হেজে মজে যায় অঞ্জলিদের জীবনধারা। কিন্তু সেবারে নদীতে বন্যা হয়নি। ফসলও ভালো হয়েছিল পরাণকাকুদের খাদের ধান মিটিয়েও বাবা বাড়িতে ১৫ টিন ধান আনতে পেরেছিল। সেই ধান থেকে হয়েছিল দাদা–দিদির মোনামুনি, বিয়ে, রাত্রিযাপনের সংস্থান সহ সব কিছু। আজ এত বছর পরেও সব স্পষ্ট মনে আছে অঞ্জলির। দিদির মোনামুনির ঘটনাটা মনে পড়লে তো আজও সে লজ্জায় লাল হয়ে যায়।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।