সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ১৫)

সালিশির রায়

কিস্তি – ১৫

আর আসন্ন দুর্যোগের আভাস পায় অঞ্জলি। বিকালের দিকেই তার বর্হ্বিপ্রকাশ ঘটে। মোড়ল পরিষদের লোকেরা তাদের বাড়িতে এসে বলে যায়, তারণ দাদুদের বাড়ির লোকেরা কাল সকালে ঝাড়খণ্ডের জানগুরুর কাছে যাবে। তারা না ফেরা পর্যন্ত অঞ্জলিদের গ্রামের বাইরে যাওয়া চলবে না , মোড়ল জানিয়ে দিয়েছে। অঞ্জলি মনে মনে যা ভাবছিল ঘটনার গতি প্রকৃতি সেই দিকেই যাচ্ছে দেখে খুব ভয় পেয়ে যায় সে। এবার তো জানগুরু তারণদাদুদের বাড়ির লোকেদের কাছ থেকে কায়দা করে তাদের হাঁড়ির খবর জেনে নিয়ে মাকে দোষী সাব্যস্ত করে দেবে জানগুরু। তারপর সালিশিসভা বসিয়ে জরিমানা আদায়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করা হবে।
সেই যাত্রা না হয় শুয়োর দিয়ে রক্ষা হয়েছে কিন্তু এবারে কি হবে ? ভেবে কোন কুলকিনারা পায় না সে।রাতটা নির্ঘুমেই কেটে যায় সবার। সকাল হতে না হতেই হই হই করে পাড়ার বেশ কিছু লোক ঝাড়খণ্ডের উদ্দ্যেশ্যে রওনা দেয়। আর তার আভাস পেয়ে মা যেন আরও মুসড়ে পড়ে। কারণ কি হতে যাচ্ছে সে আন্দাজ মাও করতে পারছে।সেদিন দাদা-বৌদি ছাড়া তারা কেউ খেতে পারে নি।দাদা-বৌদি না থাকলে হয়তো রান্নাও হত না। দাদা-বৌদিরা যেন কি ? এই বিপদটা যেন তাদের নয়। দাদা এমন ছিল না। বৌদির সংম্পর্শে কয়েকদিনেই কেমন যেন পর পর হয়ে গেল।শুধু বৌদির দোষ দিয়েই বা লাভ কি, দাদা ঠিক থাকলে বৌদি কি এমনটা করতে পারত?
ওইসব সাত পাঁচ কথা ভাবতে ভাবতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। আর ফের হই হই করে ঝাড়খন্ড থেকে ফেরে পাড়ার লোকেরা। জানগুরু কি বলতে পারে তা এক রকম আন্দাজই করেছিল তারা , তবুও কিছুটা কৌতুহল হয় অঞ্জলির। কিছুক্ষণের মধ্যেই মোড়লের বাড়ি থেকে ভেসে আসে হই-হট্টগোলের শব্দ।অঞ্জলি বুঝতে পারে পাড়ার লোকেরা সব জড়ো হয়েছে সেখানে। খাড়াটা এবারে অবধারিত ভাবে নেমে আসবে তাদের পরিবারের উপরে। তার ধারনাই সত্যি হয়। জকমাঝি আর চৌকিদার এসে বলে যায়, আজই সালিশি সভা ডেকেছে মোড়ল। মাকে নিয়ে তারা যেন তাড়াতাড়ি মোড়লের বাড়িতে যায়।
খুব একটা আশ্চর্য্য হয় না অঞ্জলিরা। এমনটা যে হতে পারে সেই আন্দাজ তো তারা করেইছিল। তাই তারা মাকে নিয়ে মোড়লের বাড়ি পৌঁছোয়। দাদা-বৌদি বাড়িতেই থাকে। দাদা অবশ্য আসতেই চেয়েছিল, কিন্তু বৌদির চোখের ইশারায় আর পা বাড়ায় না। সেটা লক্ষ্য করে অঞ্জলিই দাদাকে বলে, বৌদি একা থাকবে তোকে যেতে হবে না। তুই বরং বাড়িতেই থাক। আমরা তো যাচ্ছিই। তেমন কিছু হল তোকে ডাকব।
— সেই ভালো।
দাদা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। আর অঞ্জলিও এই মুহূর্তে বৌদিকে চটাতে চায় না। বৌদিকে ধরেই আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য সে মনে মনে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছে। তারা পৌঁছোতেই মাকে লক্ষ্য করে রে রে করে তেড়ে আসে পাড়ার মহিলারা। সে কোন রকমে তখনকার মতো মাকে আড়াল করে। পাড়ার মহিলাদের উদ্দেশ্যে সে বলে — কাকী,
জানগুরুও কি তোমাদের বলেছে তারণদাদুকেই মা’ই তুক করে মেরেছে ?
—- তোর মা’কে জানগুরু কি করে চিনবে , যে নাম বলবে। তবে যা বলেছে তাতে তোরই মা’ই যে ডাইন তা স্পষ্ট বোঝা যায়।
— তা জানগুরু কি বলেছে শুনি ?
—- বলেছে যে তুক করেছে তাদের দক্ষিণদুয়ারী বাড়ি। সামনে টিনের চাল। পিছনে গড়ে। চার ছেলেমেয়ে। দুজনের বিয়ে হয়েছে। আর বুঝতে কি বাকি থাকে রে ?
অঞ্জলি বুঝতে পারে , পাড়ার লোকের কাছেই সব জেনে নিয়ে ওইসব কথা বলেছে জানগুরু। সেই সময় মা কোনরকমে মিন মিন করে বলে, বিশ্বাস করো আমি কিছু করি নি , আমি ডাইন-ফোকোস নয় গো , আমি তোমাদের মতোই মানুষ। আর যাই কোথা। রে রে করে মায়ের উপর চড়াও হয় মহিলারা। ঝাঁটা, লাঠি, ছাতা হাতের কাছে যে যা পাই তা নিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে মাকে।সে কোনরকমে নিজের শরীর দিয়ে মাকে আড়ালের চেষ্টা করে। মহিলাদের আক্রোশ মিটতে বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে যায়। ততক্ষণে মায়ের নাক মুখ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। চোখ ঢেকে যাচ্ছে রক্তে। কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছে মা। তারও শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝড়ছে। ওড়না দিয়ে মায়ের রক্ত মুছিয়ে দিতে দিতে সে পাড়ার লোকেদের উদ্দ্যেশ্যে বলে, এটা কি তোমরা ভালো করলে ? বিচারের জন্য ডেকে রায়ের আগেই একটা নিরীহ মানুষকে এ ভাবে মারাটা কি ঠিক হলো ? যদি তোমাদের ক্ষেত্রে এমনটা হত ?
তার কথা শেষ হয় না , রে-রে করে ওঠে সবাই। গালাগালি দিয়ে বলে — বেশ করছি , তোর মা লোকটাকে খেয়েছে। নোলা লকলক করছে। আবার কাউকে খাবে। তাই তার আগেই পিটিয়ে মেরে দেব ওকে। অঞ্জলি বোঝে কোন কথা বলে লাভ হবে না। মোড়ল ওদের ভরপেট মদ খাইয়ে দিয়েছে। এটা মোড়লের একটা চাল। তার সালিশির রায় যাতে সবাই এক কথায় মেনে নেয় তার জন্যই মোড়লের ওই ফন্দি। তাই মদের নেশায় সবাই এখন বিচার বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছে। এ সময় যা’ই বলতে যাবে তাতেই হিতে বিপরীত হবে। কিছুক্ষণ পর খাটিয়ায় এসে বসে মোড়ল।পাড়ার লোকেরা একদিকে , আর মা- বাবা ভাই সে বসে রয়েছে অন্যদিকে।তাদের উদ্দ্যেশ্যে মোড়ল বলে , জানগুরু যে রকম বলেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে ওই মেয়েটার ঘাড়ে ডাইনি ভর করেছে। ওর তুক করা ছাতু খেয়েই তারণখুড়ো মরেছে।হয় ওকে গাঁ থেকে তাড়াতে হবে , না হলে ওর ঘাড় থেকে ডাইনিকে তাড়াতে হবে। না হলে ও আরও অনেককে খাবে। তা তোমরা সব কি বলছ ? তাই তো নাকি ?
মোড়লের কথা শেষ হতেই সবাই সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে —- ঠিক, ঠিক। সে কথা আর বলতে।অঞ্জলি বুঝতে পারে বিচার পর্ব বাঁধা গতেই এগোচ্ছে। এক একটা মুহুর্ত যাচ্ছে আর উৎকণ্ঠায় তাদের যেন মাথার শিরা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে। মনে হচ্ছে যা হওয়ার তা তাড়াতাড়ি হয়ে যাওয়াই ভালো। পরিষদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ চুপিচুপি আলোচনা কংমুখ খোলে মোড়ল। তাদের দিকে তাকিয়ে সে বলে, পরিষদদের সঙ্গে আলোচনা করে , স্বামীর মতোই ১০০০ টাকা জরিমানা করা হোল। জরিমানার টাকায় মারাংবুরুর পুজো আর জানগুরুকে এনে ওর ঘাড় থেকে ডাইন তাড়ানো হবে। কাল সন্ধ্যার মধ্যেই টাকা জমা দিতে হবে। নাহলে অন্যব্যবস্থা। এটাই যে হবে তা তো জানাই ছিল অঞ্জলির। টাকাটা যেমন করে হোক যোগাড় করতেই হবে। কারণ অন্য ব্যবস্থাটা বড়ো নির্মম। হয় গোপনে স্বপরিবারে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে , নাহলে ডাইন বলে ওরা মাকে পিটিয়ে মেরে দেবে।
তাই কোন কথা না বলে বাড়ি ফিরে আসে তারা। আর পাড়ার লোকেরা তাদের নজরবন্দী করে ফেলে। জরিমানার টাকা কি করে যোগাড় হবে ভেবে বাবা খুব উতলা হয়ে পড়ে। মায়ের যেন কোন হেলদোল নেই। তখন মার খাওয়ার পর থেকেই মা কেমন চুপ মেরে গিয়েছে। দাদা – বৌদির অবশ্য তেমন কোন হেলদোল নেই। মা যেন দাদার মা নয়। কেমন যেন গা’ছাড়া ভাব তাদের। কিন্তু এখন তা গায়ে মাখতে চায় না অঞ্জলি। একমাত্র বৌদির দয়াতেই এই বিপদ থেকে উদ্ধার হওয়া যেতে পারে। বৌদির বাবারা বড়োলোক। বিয়ের সময় মেয়েকে তারা কানে আর নাকে সোনার গয়না দিয়েছিল। এই বিপদের সময় ওই গয়না দুটো ধার হিসাবে চাইলে বৌদি নিশ্চয় না করতে পারবে না। সেই ভেবে দাদার সামনেই কথাটা বলে অঞ্জলি। বৌদিও বোধহয় ব্যাপারটা আঁচ করেছিল। তার কথা শেষ হতেই বলে, গয়নাদুটো যে বাপের বাড়িতে রেখে এসেছি। লাগলে সকালে তোমার দাদার সঙ্গে গিয়ে এনে দিতে হবে। বৌদির কথা শুনে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ে অঞ্জলির। বৌদি যে এত সহজেই গয়না দিতে রাজী হবে ভাবতে পারে নি সে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দেয় সে। বাইরে থেকে দেখে বৌদির সম্পর্কে কত খারাপ ভেবেছিল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।