গদ্যের পোডিয়ামে অয়ন ঘোষ

বন্দী দিন অন্তরীণ

দিন চলে যায় চোখের বাইরে দিয়ে, ঠাঁই নেই আলোর নিচে। তোমার চোখে যে আমার সর্বনাশ দেখবো তারও জো নেই। কোথায় সে সচ্ছতোয়া চোখ আর কোথায় কাকচক্ষু জল। আচ্ছা কাকের চোখ কি সত্যিই অমন গল্প বলা চোখ আছে, তাকে তো কেবল জেনেছি দু সংবাদ বয়ে আনতে। তার বাইরে ওই পাঁচ ছ ক্লাসের বিজ্ঞানে পড়েছিলাম সে নাকি ঝাড়ুদার পাখি! বাড়িতে কাক বসলেই আমার “রাম বলো রাম বলো” বলতেন আর হুস হুস তাড়া দিতেন, পাছে কোনো দুঃসংবাদ না আসে। আমার বাবার মৃত্যুর তিন চার দিন আগে থেকেই একটা নাছোরবান্দা কাক সারা দিন ডেকে যেতো, মায়ের হাজার তাড়া খেয়েও সে যেতো না, তার বদলে বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে। মাকে বলতে শুনেছি আমার দাদু যেদিন মারা গেলেন, সেদিনও নাকি কাকের অমন বুক ফাটা ডাক শোনা গিয়েছিল। এমনকি সাগর পারের নাটক ম্যাকবেথ এও একটা দাঁড়কাকের কথা আছে। জানি বিজ্ঞান ওসব মানে না,কিন্তু এই বিজ্ঞানের যুগে দাঁড়িয়েও কোনো কোনো দুর্বল মুহূর্তে ওই সংস্কারের বা যদি বলেন কুসংস্কার তাই সই, থেকে দূরে সরে থাকতে পারি না। ওই ডাকের সাথে মনটাও কেমন যেনো কু ডেকে ওঠে। যখন লিখছি এই লেখা তখন সামাজিক মাধ্যম থেকে সব চ্যানেলে দেখাচ্ছে অভিনেতা ইরফান খানের ঘুমের দেশে চলে যাবার খবর, ধন্য তুমি এলিয়ট, এপ্রিল এ বছরই সত্যিই নিষ্ঠুর। অভিনয় শেষ, মঞ্চ ছেড়ে চলে গেলেন দক্ষ অভিনেতা। বলে স্মৃতিতে থাকেন যারা, তাদের নাকি মৃত্যু নেই। অভিনয় শেষ হলে দর্শকের মুখে মুখে ফেরে টুকরো টুকরো আলাপ সংলাপ। সেই সংলাপ জুড়ে জুড়ে জীবন মালা গাঁথে, পড়ে পড়ায় গলে। তখন আর নাটক মঞ্চে থাকে না, দাওয়া থেকে ড্রইং রুম, লন থেকে উঠোন, রাজপথ থেকে ধুলোপথ, সর্বত্র তার ছায়াপথের বিস্তার, না হলে এভন এর চরন কবি কেন বলবেন, All the world’s a stage; and all the men and women merely players;… এই মৃত্যুর পরেও একটা সান্ত্বনা, কদিন আগেই খবর ছিল, ইরফান খানের মাও জীবনের সীমানা পেরিয়ে আরো বড় জীবনের দিকে পাড়ি জমিয়েছেন। সন্তানের মৃত্যু তাকে দেখতে হলো না, পুত্রশোক বড় শোক। অন্তত তার থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন। “দুনিয়ামে সবসে বড়া বোঝ কেয়া হোতা হ্যায় জানতে হো! পিতা কি কান্ধোঁ পর বেটে কি জনাজা”, (শোলে)। চিতার নির্মহ আগুনের কাছে আমরা জমা রেখে আসি যাপনের আদুরে মুহূর্ত। নরম মাটির আদুল বুকে ঘুমিয়ে পরে সংসার সংসার খেলা। রাগ দ্বেষ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, আনন্দ উল্লাস, হুল্লোড়, প্রেম প্রীতি, শোক সবই লিথী নদী তে স্নান করে পারনের পথে এগোয় ধীরে ধীরে, পিছন পানে যে তাকায় না, তা নয়, কিন্তু ছাড়তে চাইলেই যেমন ছাড়া যায় না, ফিরতে চাইলেই কি ফেরা যায়। সব চাওয়া কি মেলে!
তারপর চৈত্র গিয়ে বোশেখ এসেছে ক্যালেন্ডারে, যথারীতি। বেশ কটি কালবৈশাখীর দাপট দেখেছে নগরবাসী। নতুন বছরের সেই মিঠে গন্ধ পেলাম না, ধীরে ধীরে কাছে আসছে, ঠাকুর পুজোর সময়। না না দুগ্গা পুজোর কথা বলছি না। বাঙালির সবচেয়ে বড় ঠাকুর, যার কাব্যের কথা ছেড়ে দিন, শুধু যদি ব্র্যান্ড ভ্যালু ভাবেন, অনেক MNC কে টেক্কা দিয়ে যাবে হাসতে হাসতে। আমাদের রবি ঠাকুর, বড় কাছের, বড় নিজের। কিন্তু এতো ঠাকুর পুজোর সময় নয়। আজ পর্যন্ত সরকারি হিসেব অনুযায়ী এই পৃথিবীর প্রায় দু লক্ষ দশ হাজার সহ নাগরিক কে হারিয়েছি আমরা। তার মধ্যে সবাই তো আর ইরফানের মায়ের মতো ভাগ্য নিয়ে আসেননি। সবাই বলছে শোক সামলে উঠে দাঁড়াবে মানুষ। জনান্তিকে বলে রাখি শোক পেলে তবেই বোঝা যায়, সামলে ওঠা কতটা শক্ত। গোটা পৃথিবীতে একটা অসম যুদ্ধ চলছে আর এই যুদ্ধে শুভেচ্ছা ছাড়া আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, গোপন ভালোবাসা ছাড়া কোনো সান্ত্বনা নেই। হাতে হাত রেখে শপথ নেবার সুযোগ নেই, শুধু মন বাড়িয়ে মনের পাশে বসে আছি, যেমন করে আমরা সাড়া জীবন বসে থাকি প্রাণের দেওয়া শোকের পাশে, নিঝুম নতজানু। তাই যাকে কখনো দেখিনি, তাকেও মনে মনে বলছি ভালো থেকো, সাবধানে থেকো। যে পথে, যে দেশে কখনো যাইনি, আমার দেশের চিরায়ত লোককথায়, আমার পথের পাশের, বিষন্ন নয়ানজুলিতে ভেসে আছে সেই না দেখা দেশের চাঁদ, চুপচাপ গিয়ে বসছি তার পাশে নীচু স্বরে বলছি, “ও চাঁদ সামলে রেখো জোছনা কে”। কি বুঝল কে জানে, ভাষার তো মিল নেই। তবে এই পৃথিবীতে এতো দিন কাটানোর পর, নিশ্চিত করে বুঝে গেছি, মন পড়ে নিতে বর্ণপরিচয় লাগে না। মনে হচ্ছে ঠিকই বুঝতে পেরেছে, না হলে বাতাসের ছোঁয়ায় জলে কাঁপন লাগলো কেনো আর সেই সঙ্গে সারা অঙ্গ দুলে উঠলো আশরীর ভিজে যাওয়া জোৎস্নায়। কানে কানে খবর ছড়িয়ে পড়ল, পুব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে, বলল সেরে ওঠো, সেরে ওঠো, ভালো থেকো, ভালো থেকো। জানি এইটুকুই সম্বল আমাদের, এই মুহূর্তে। তবে এই ভাঙনের কালে, ভাসানের বেলায় ওইটুকুই অনেক। বৈরী না রেখে,অসুয়া না রেখে, ঈর্ষা না রেখে মন ভরে যদি এই ডাকটা পাঠাতে পারি, সাড়া আসবেই মনে মনে, প্রাণে প্রাণে: পাড়ি দিতে তরী, হাল ভাঙ্গে যদি/ ছিন্ন পালের কাছি, মৃত্যুর মুখে দাড়ায়ে জানিব, তুমি আছো আমি আছি।
হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে তো থাকতেই হবে। যদিও কিছু নেই মনের মতো সম্বল, তবুও নিজেকে অহরহ বোঝাচ্ছি দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, কারণ আমাদের প্রত্যেকেরই প্রত্যেককে বড় প্রয়োজন। উপনিষদে বলেছে না, “বসুদৈব কুটুম্বকম”, গোটা পৃথিবী আমার আত্মীয়। তা ওই প্রাণের আত্মীয়তায় যতটা পারা যায়, টিকে থাকার চেষ্টা করতে হবে কারণ “দিকে দিকে কাঁদিছে মোর আত্মার আত্মীয়, আমারই স্রষ্টার সৃষ্ট জীব”। এ লড়াই আমাদের টিকে থাকার কারণে, এখানে আত্মপর ভেদ চলবে না। ক্রমশঃ খারাপ হচ্ছে আমাদের আর্থিক ও মানসিক স্বাস্থ্য। সামনের দিন গুলোয় কি জুটবে কি জুটবে না, জানা নেই। প্রতিবেশীর অবস্থাও ভালো নয়। এমনিতেই এ পোড়া দেশের আশি ভাগ মানুষ আর্থিক অসুখের স্বীকার। নব্বই ভাগ মানুষের শিক্ষার চেতনা নেই। যে দশ ভাগের আছে তারা ব্যবহারে কৃপণ। এখনো পারস্পরিক দোষারোপ চলছে, চলেছে একে অপরকে টেক্কা মেরে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা। এরই মাঝে পড়ে প্রাণ আইঢাই মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক মানুষ গুলোর। জীবন প্রায় থেমে গেছে, কোনো এক স্বার্থপর দৈত্যের চোখ রাঙানিতে। কিন্তু সময়ের নিয়মে, সরস্বতীর মতোই সরস গতি জীবনের। অনেক অনেক দূরে যেখানে প্রায় দৃষ্টি যায়না, সেখানে কেউ কেউ দেখতে পাচ্ছে সবুজ আলোর ইশারা, তাকে আরো বেশি করে চোখে ধরতে হবে, প্রাণে প্রাণে শুনতে হবে। নিশুতি অন্ধকারে জোনাকির ডানায় রূপকথা খেলে বেড়ায়। রূপকথা যে অসম্ভব নয়, সামান্য পতঙ্গ ও জানে, মানুষ যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই মঙ্গল। শুভায় ভবতু।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।