সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ১)

সালিশির রায়

কিস্তি – ১

পেটের ব্যাথাটা মাঝে মধ্যে এখনও চাগার দিয়ে ওঠে। অভ্যাসবশেই তলপেটে হাত চলে যায় অঞ্জলির। ক্ষতগুলো শুকিয়ে গিয়েছে। কিন্তু ক্ষতচিহ্ন গুলো জনম দাগ হয়ে আছে।সেখানে হাত পড়লেই কেমন যেন চিন চিন করে ওঠে। আর এক লহমায় যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে বীভৎস সেই রাতটার ছবি। আজ দীর্ঘ ১০ বছর পর গ্রামে ফিরে একে একে সব মনে পড়ে যাচ্ছে তার। জামরুল গাছটার পাশে তাদের বাড়িটি মাটির স্তুপ হয়ে পড়ে আছে। সেই স্তুপের ভিতর থেকে আজও উঁকি দিচ্ছে সান বাঁধানো ছোট্ট মনসার থান। অদূরে মোড়লের বাড়ির সামনে তার সেই রাতের লাঞ্ছনার স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই তালগাছ , সেই বাঁশঝোপ।
অজান্তেই কখন দুচোখ জলে ভরে যায়, তা টের পায় না অঞ্জলি। একসময় কুঁয়ে নদীর ধার ঘেঁষা লাভপুর এলাকার ছোট্ট এই আদিবাসী পল্লীতেই ছিল তাদের বাড়ি।সব মিলিয়ে ঘর পঁচিশেক লোকের বাস। পল্লীটির গালভরা পোশাকী নাম শ্রীপল্লী। লোকের মুখে মুখে এখন হয়ে গিয়েছে ছিপল্লী। অঞ্জলি মনে করে সেটাই ঠিক হয়েছে। শ্রী বলতে যা বোঝাই তার ছিটে ফোঁটাও নেই সেখানে। সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে শুয়োরের মলমুত্র।ভোর থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত ঘোঁতর ঘোঁতর করে পাড়াময় টহল দিয়ে বেড়ায় শুয়োরের পাল। তাদের মলমুত্রের গন্ধে বহিরাগতরা পাড়ায় ঢুকে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ওয়াক – ওয়াক করেন। অথচ পাড়ার লোকেদের কেমন যেন সব গা সহা হয়ে গিয়েছে।
ওই গন্ধের মধ্যেই তো তাদের থাকতে হয়। না হলে তো উপায়ও নেই। প্রতিটি পরিবারেই রয়েছে শুয়োর। শুয়োর পালনই যে তাদের সহায়ক জীবিকা। শুয়োর থেকেই তাদের জোড়াতালি দিয়ে চলা সংসারে কিছুটা সুসার হয়। পাড়ায় প্রায় সবারই ঘুপচি ঘরে বাস। তারই মধ্যে রান্না– খাওয়া , বাস – সহবাস সব কিছুই। ঘরের একদিকে শুয়োরের খুপড়ি, অন্যদিকে হাঁস-মুরগির হুদরো। বাড়ির সামনেই কাঁচা নর্দমা। সেখানেই দিনভর খেলা করে বেড়ায় পেট মোটা উলঙ্গ ছেলেমেয়ের দল। কেউ দেখার নেই , নেই বলারও কেউ।সকালে ছেলেমেয়েদের খাইয়ে পরিবারে বুড়ো-বুড়িদের জিম্মায় রেখে মজুর খাটতে বেরিয়ে যায় বাবা-মা। ফিরতে সেই সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। আর বুড়োবুড়িরা ওইসব ছেলেমেয়েদের দেখবে কি, তারা নিজেরাই গাছতলার নীচে খাটিয়ায় পড়ে হাঁফায়।
সেই সুযোগে ছেলেমেয়েগুলো কতবার যে নর্দমার পচা পাঁক মাখে আর ডোবায় স্নান করে তার ঠিক নেই। সন্ধ্যায় মা ফিরে ফের আর একপ্রস্ত স্নান করিয়ে ঘরে তোলে তাদের। শরীরের এই অত্যাচার , তবু সহজে কিছু হয় না ওদের। আর হলে বাঁচানোও যায় না। পাড়ার লোকের বিশ্বাস মারাং বুরু আছে বলেই তাদের সহজে কিছু হয় না। এজন্যই বোহহয় পাড়ার মানুষ মারাং বুরুকে এত মান্যি করে। নিজেরা সব কাদাছিটের বাড়িতে থাকে, কিন্তু চাঁদা তুলে সান বাঁধানো করে দিয়েছে মারাং বুরুর থান। যে যখন মোড়ল হয়, সে তখন ওই থানে ধুপ সন্ধ্যা দেওয়ার অধিকারী হয়।
এখন সনাতন টুডু সেই অধিকার পেয়েছে। বেশ কয়েক বছর হলো মোড়ল হয়েছে সনাতন। তার আগে মাঝি হারাম ছিল তার বাবা সুখলাল বেসরা। মাঝি হারামকে আসলে মোড়ল বলে তারা। মোড়ল পদ নিয়ে দুপক্ষের আকচা-আকচি ছিল বহুদিন। বাবার মোড়ল পদ চলে যাওয়ার পর থেকেই পাড়াও কার্যত দুভাগ হয়ে যায়। তার বাবার পক্ষে রয়ে যায় কেবল পুরনো মোড়ল সভার সদস্যরা।দু- একজন বাদে নতুন মোড়ল সভায় তাদেরও ঠাঁই হয় না। সনাতনের মোড়ল পরিষদে পারানিক মনোনীত হয় ভক্তা হেমব্রম , জগমাঝি করা হয় লক্ষণ বেসরাকে। শুধু বাবার মোড়ল পরিষদের চৌকিদার হোপন হাঁসদাই যোগ দেয় সনাতনের মোড়ল পরিষদে। ওদের হাতে চলে যায় পাড়ার বিচার- আচারের ভার। তারা আর তার বাবার মোড়ল পরিষদের সদস্যরা পাড়ায় অচ্ছুতের মতো একরকম একঘরে হয়ে যায়।
অথচ একসময় কি একান ছিল তাদের। বাদনা, বাহা পরবে দল বেঁধে পুরুষদের ধামসা- মাদলের তালে কোমর দুলিয়ে নাচত মেয়েরা সবাই। ছেলেমেয়ের বিয়ের মোনামুনিতে যাওয়ার জন্য প্রতিটি পরিবারের একজন করে নিমন্ত্রণ পেত। চাষের মরসুমে দল বেঁধে বর্ধমানে ট্রেনে চেপে ধান পুততে যেত সবাই। পাশাপাশি খুপরি বেঁধে মাসাধিক কাল থাকত সেখানে।বাবা মায়ের সঙ্গে অঞ্জলিও গিয়েছে কতবার।বাবা-মা মাঠে চলে গেলে তারা পালাক্রমে ছোট ভাইবোনেদের আগলে রাখত। সেই সৌহার্দ্যটা আর ছিল না শেষের দিকে। তার বাবার অনুগামী কয়েকটি পরিবারকে বাদ দিয়েই তখন ওইসব অনুষ্ঠান হত।
আসলে ভোট রাজনীতিই ভেঙে দিয়েছিল তাদের মাঝি একান। মোড়ল যাদের হাতে থাকে সে পাড়ার ভোটও তাদের দলেরই হয়। তাই সব দলেরই চোখ থাকে আদিবাসী পাড়াগুলোর উপর।পরে অঞ্জলি শুনেছে আদিবাসীদের সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে, আদিবাসীরা নাকি বাপ ভুললেও ছাপ ভোলে না। এত অন্ধ আনুগত্য কোন দলই হাত ছাড়া করতে চায় না। কুঁয়ে নদীর ধার বরাবর রয়েছে জামবুনি, খয়েরবুনি, সেকমপুর, টালিপাড়া , নতুনপাড়ার মতো বেশ কিছু আদিবাসী পল্লী। আঁধার নামলেই পাড়াগুলিতে নানা অছিলায় বাইরের লোকের আনাগোনা বেড়ে যায়। কেউ আসেন মজুর খোঁজার নাম করে , কেউ বা হাস-মুরগী কিম্বা ডিমের খোঁজে। তাদের দলে যেমন ধান্ধাবাজ মানুষেরা থাকে, তেমন থাকেন রাজনৈতিক নেতারা।
ধান্ধাবাজ লোকেরা আদিবাসী মেয়েদের নিয়ে ফুর্তি লুঠতে আসে। আর নেতারা আসেন তাদের মিটিং – মিছিলে সামিল করার জন্য।তার বাবা ছিলেন রাম নস্করদের দলের সমর্থক। ভোটের আগে তো বটেই , মাঝে মধ্যে রামবাবুরা দল বেঁধে আসতেন তাদের পাড়ায়। বাবাও যেতেন রামবাবুদের পার্টি অফিসে। কখনও কিছু চাল গম, জামা -কাপড় কিম্বা কালো ত্রিপল এনে পাড়ায় বিলি করতেন। রামবাবুদের দেখে পাড়ায় আনাগোনা শুরু করেন বিরোধী পার্টির সুহাস কবিরাজরা। তারা ওঠা-বসা শুরু করেন সনাতনের বাড়িতে। প্রায়ই মদ মাংসের আসর বসতে থাকে সনাতনের বাড়িতে। সেখানে এক-দুই, এক-দুই করে পাড়ার লোকেদের ভীড় বাড়তে থাকে। তার উপরে একদিন রামবাবুদের হঠিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে সুহাসবাবুদের দল। চাল-গম, ত্রিপল তার বাবার পরিবর্তে সনাতনের হাত দিয়ে গ্রামে আসতে থাকে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষ তাই ভিড়ে যায় সনাতনের দলে। গ্রাম সালিশি ডেকে বাবাকে পদচ্যুত করে সনাতন মাঝি হারাম হয়ে বসে। সেদিনই যেন অঞ্জলির কপালে লেখা হয়ে যায় বীভৎস সেই রাতের বিধিলিপি।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।