সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে অর্ঘ্য ঘোষ (পর্ব – ১৮)

সালিশির রায় 

কিস্তি – ১৮

অঞ্জলি মনে মনে ভাবে, এই জন্যেই বোধ হয় বলে ঝড়ে বক মরে আর ওঝার কেরামতি বাড়ে। বাড়িতে এসেই নেতিয়ে পড়ে মা।অঞ্জলি মাকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর দুব্বো ঘাসের রস থেঁতো করে নিয়ে আসে। পরম মমতায় মায়ের শরীরের ক্ষতস্থানগুলিতে লাগিয়ে দেয় সেই রস। মায়ের গা তখন জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। সে মাথায় জলপট্টি দিতে বসে। দুলালও শুয়ে পড়ে মায়ের পাশটিতে। এমনিতে দিদির বিয়ের পর থেকে দুলাল আর সে একটা ঘরে থাকে। আজ সেই ঘরে বাবাকে পাঠিয়ে সে মায়েদের ঘরেই থাকে। দুলালটারও গা টা কেমন গরম গরম লাগে। ওইটুকু ছেলে চোখের সামনে মায়ের হেনস্থার হওয়ার ঘটনাটা দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। জ্বরের ঘোরে মা এক সময় ভুল বকতে শুরু করে। বিড় বিড় করে বলে থাকে —- মেরো না আমাকে, মেরো না তোমরা। মা থামতেই দুলালও ভুল বকতে শুরু করে। বালিশ চেপে ধরে সে শুধু বলেই চলে উ : আ :। আর শিউরে শিউরে ওঠে।
অঞ্জলি বুঝতে পারে চোখের সামনে মা’কে ওই ভাবে নির্যাতিত হতে দেখেই এই অবস্থা হয়েছে ভাইয়ের। দু’জনকে সামলাতে গিয়ে সারারাত দু’চোখের পাতা করতে পারে না অঞ্জলি। আর মোড়লের বাড়িতে তখন হই-হুল্লোড়। জানগুরুকে নিয়ে মদের আসর বসিয়েছে পাড়ার লোক। আর অঞ্জলি ভেবে চলে অনাগত ভবিষতের কথা। দাদা চলে গেল, মা -বাবার ওই তো অবস্থা। ভাইটাও ছোট। তাকেই সামাল দিতে হবে সবদিক। কিন্তু কিভাবে একা সামাল দেবে সে ? নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে তার। এসময় দাদা-দিদি থাকলে সবাই মিলে পরিস্থিতির সামাল দিতে পারত। দিদিকে অবশ্য বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যেতেই হত, কিন্তু দাদা একি করল ? তাদের বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে চলে গেল ? অথচ ওই দাদাই তাদের কি ভালোই না বাসত।
তারা তখন বেশ ছোট। সবাই পিঠোপিঠি। তাদের সমাজে মেয়ের শরীরে উল্কি পড়ার চল রয়েছে। ছুঁচ ফুটিয়ে ফুটিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে মাছ, পাখি কিম্বা হাতে উল্কি দিয়ে নাম লেখা হয়। সাধারণত বাদনা পরবের আগে বিহার কিম্বা ঝাড়খণ্ড থেকে উল্কি আঁকিয়েরা আসে। উল্কি পড়াটা বেশ যন্ত্রণাদায়ক। তবুও প্রায় প্রতিটি আদিবাসী মেয়েই শরীরে উল্কি আঁকায়। শখ করে ছেলেরাও আঁকায়। সেবারে তারা দু’বোন উল্কি আঁকাচ্ছিল। দাদাও ছিল সেখানে। উল্কি আঁকিয়েরা তাদের হাতে ছুচ ফোটাচ্ছিল আর সেই ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। তারা যন্ত্রনায় উ:আ: করছিল। তাই দেখে দাদা বার বার ছুটে গিয়ে উল্কি আঁকিয়েদের হাতের ছুঁচ সরিয়ে দিচ্ছিল।কিছুতেই আর তাদের উল্কি পড়া হচ্ছিল না। শেষে মা জোর করে দাদাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের উল্কি আঁকা হয়। আর সেই দাদাই আজ সমাজের নির্মম ফলার সামনে তাদের ফেলে রেখে চলে গেল।
অজান্তেই হাতে আঁকা মাছের উল্কিটার দিকে চোখ চলে যায় অঞ্জলির। একবার হাত বোলায় উল্কিটার উপর। আর একে একে মনে পড়ে যায় সব পুরনো স্মৃতি। উল্কি নেওয়ার পর তাদের হাত ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছিল।উল্কি আঁকিয়েরা বলেছিল কাঁচা হলুদ বেঁটে লাগিয়ে দিলেই নরম পড়ে যাবে। দাদা সেই শুনে জঙ্গল থেকে তুলে এনেছিল কাঁচা বুনো হলুদ। সেই হলুদ বাঁটা লাগিয়েই তাদের হাত ভাল হয়েছিল। ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে অঞ্জলি ভুলেই গিয়েছিল রাত থেকে কারো পেটে কিছু পড়ে নি।তাড়াতাড়ি কিছু খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে বাবার জন্য। না হলে বাবা খালি পেটে কাজ করতে বেরোবে কি করে ? বাবা কাজে বেরোতে না পারলে তো পরের দিন তাদের হাঁড়ি চড়বে না। মা কবে কাজে যেতে পারবে , আদৌ আর কোনদিন কাজে যেতে পারবে কিনা তার ঠিক নেই।তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে অঞ্জলি। সেদিন হৃদয়দার আনা চাল ডাল কিছুটা বেঁচে আছে। তাই দিয়েই আলু সিদ্ধ ভাত বসিয়ে দেয়। তারপর বাবাকে খাইয়ে কাজে পাঠিয়ে দেয়। ভাই আর মা’কেও ডেকে তোলে।
এক রাতেই মা যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। মানসিক অবসাদগ্রস্থ দেখায় তাকে। মনে মনে কি যেন বিড় বিড় করে। তার মুখের দিকে দীর্ঘক্ষণ চেয়ে থাকে মা। তারপর বলে, হ্যারে ওরা যে বলল আমি নাকি তারণকে খেয়েছি। আমি কি সত্যি ডাইনি ? এই আশংকাটাই করেছিল অঞ্জলি।খুব ভয় পেয়ে যায় সে। তাদের পাড়াতেই এর আগে যশোমতী কাকীকে ডাইনি সাব্যস্ত করেছিল জানগুরু। তারপর থেকেই যশোমতীকাকীও নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করে। আর তা থেকেই মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে বিছানা নেয়। তারপর আর বেশিদিন বাঁচে নি কাকী। তার বাড়ির লোকেরাও সেদিন বিষয়টি উপলব্ধি করেছিল। কিন্তু কোন সচেতনতা বোধ গড়ে ওঠে নি তাদের। মায়ের ক্ষেত্রে তাদেরও তো সেই জানগুরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে শুনেছে সে। কিছুতেই মায়ের ওই পরিস্থিতি হতে দেবে না সে। সবার আগে মায়ের মনে জাঁকিয়ে বসা ধারণা দূর করতে হবে। তাই মায়ের পাশটিতে গিয়ে বসে অঞ্জলি। তারপর বলে, তুমি কেন ডাইনি হবে, তুমি তো আমাদের মা।মায়ের দৃষ্টিতে যেন অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে ওঠে। তার মুখটা দু’হাতের তালুতে ধরে বলে, তুই সত্যি বলছিস আমি ডাইন নয় , তোদের মা ?
—- হ্যা গো।
—- আ : কি শান্তি।
ক্ষনিকের জন্য মায়ের মনে প্রশান্তি ফিরে আসে। পরক্ষণেই তা বদলে যায়। মুখে ফুটে ওঠে যন্ত্রণার ছাপ। অস্ফুটে বলে — তবে যে ওরা বলল আমি ডাইনি। কত মারল ওরা।
—- ওরা ভুল বলেছে। কিচ্ছু জানে না ওরা।
—- অ, তাই ?
তারপরই চুপচাপ হয়ে যায় মা। সে মা আর ভাইকে স্নান করিয়ে খাইয়ে দেয়। তারপর নিজে খেতে বসে। খেতে খেতে কত রকম চিন্তা আসে মনে। দিদিকে একবার খবর পাঠানোর খুব প্রয়োজন মনে হয় তার। মায়ের এই অবস্থা , দিদিকে না জানালে তাকেই দোষ পেতে হবে। কিন্তু খবর পাঠাবে কাকে দিয়ে ? বাড়ির যা হাল তাতে বাবার একদিন কোথাও যাওয়া মানে তাদের পেটে গামছা বেঁধে পড়ে থাকে। ভাইকেও পাঠানো যাবে না। হৃদয়দাকে পাঠিয়ে খবর দেওয়া যেতে পারে। হৃদয়দার কয়েকজন বন্ধুর মোটর সাইকেল আছে।তাদের কাউকে নিয়ে দিব্যি হৃদয়দা খবর দিয়ে আসতে পারে। সে বললে যত কাজই থাকুক না কেন , না করতে পারবে না হৃদয়। বিষয়টি ভেবেই ভালো লাগায় ভরে যায় তার মন। চোখ মুখও উজ্বল হয়ে ওঠে। পরক্ষণেই আবার দিদির কথা ভেবে মুখে যেন কালো ছায়া ঘনিয়ে আসে।
দিদি তো আবার হৃদয়দার সঙ্গে তার মেলামেশা পচ্ছন্দ করে না। যদি বাড়িতে পেয়ে তাকে অপমান করে বসে ? তাহলে আর সে হৃদয়দার কাছে মুখ দেখাতে পারবে না। সেটা সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না। হৃদয়দা সেদিন যদি দেবদুতের মতো সামনে এসে না দাঁড়াত তাহলে কি যে হত তা সে’ই জানে। সেই কথা মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। আবার পরক্ষণেই ভাবে সেদিনের কথা শুনলে দিদি কি আর হৃদয়দার সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে থাকতে পারবে ? চরম দোটানায় পড়ে অঞ্জলি।আর ঠিক তখনই বার দরজায় কে যেন কড়া নাড়ে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।