যুদ্ধ যুদ্ধ
এগারো
ভোর।শান্ত প্রকৃতি। পাখি ডাকছে। নরম চকচকে আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। বাতাসে হাল্কা ঠান্ডাভাব। মানুষটার মাথার ওপরের ছাউনিটা ঝড়ে উড়িয়ে না নিলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খুব। ছাউনির নীচেটায় থকথকে কাদা। এরমধ্যে কোথায় আর শোয়া বসা করে মানুষটা। সারারাত জেগেই কাটিয়ে দিতে হল তাকে। আলো ফুটতে নিজেই ওটাকে বেঁধেছেদে ঠিকঠাক করে নেওয়ায় হাত লাগাল।
কী যে মরার ঘুমে পেয়েছিল আমাকে। এতবড় একটা ঝড়জলের রাত গেল অথচ টেরই পেলাম না! তা গোঁসাই, আপনি ঠিকঠাক আছেন তো? একরকম হন্তদন্ত হয়ে দয়াল মানুষটার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল। তারপর অনুতাপভরা গলায় বলল, বুঝতেই তো পারছি, এই পলকা ছাউনির নীচে কী করে আর ভাল থাকবেন! আমাদের কাছে এসে আপনি কী কষ্টটাই না পাচ্ছেন। প্রভু যীশু কি ক্ষমা করবেন আমাদের। তারপর দয়াল হায় হায় করে উঠল, এ আপনি কী করছেন গোঁসাই, এ কি আপনার কাজ? নিন, এদিকটায় সরে আসুন তো!
মানুষটা নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়ালে বাঁধাছাদার কাজে হাত লাগাল দয়াল।
আজ রবিবার। বসতির মানুষগুলোর ছুটির দিন। পুরুষমানুষগুলো একটু বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়। সারা সপ্তাহের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ক্লান্তি দূর করে। তারপর সেজেগুজে গির্জায় যায় প্রভুর কাছে প্রার্থনা জানাতে।কৃতপাপস্বীকারও করে কেউ কেউ প্রার্থনা শেষে। প্রতীকী স্বরূপ প্রভুর ভোজের রুটিখন্ড মুখে নেয়। কিন্তু আজ ওদের শুধু ছুটির দিনের আনন্দ নয় অন্য আনন্দও আছে। তাই ভোর ভোর সারা বসতি জেগে উঠেছে। কেননা আজ শুয়োর মারা হবে। ঘরে ঘরে মাংস রান্না হবে। পুরুষমানুষগুলোর কেউ কেউ লুকিয়েচুরিয়ে মাংসের সঙ্গে পচানি বা বাংলা মদ খাবে। তারপর নেশায় বুঁদ হয়ে লম্বা ঘুম যাবে ফের।
একমাত্র দয়াল ছাড়া মানুষটার দুরবস্থার দিকে কারোর খুব একটা নজর নেই। বসতির সব পুরুষ আর যুবকরা শুয়োর ধরতে পিছনের খানাটার দিকে রে রে করে এগিয়ে চলে। ওদের হাতে বাঁশের টুকরো আর দড়ি। পিছু পিছু বাচ্চাকাচ্চাগুলো আনন্দে আত্মহারা হয়ে হৈচৈ করতে করতে চলেছে।
খানিক বাদে সেই বিকট ঘোৎ ঘোৎ শব্দটা ভেসে আসে। জোয়ান শুয়োর ধরা খুব কঠিন কাজ। নির্দিষ্ট শুয়োরটাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। বাকি শুয়োরগুলো প্রাণভয়ে দিগবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে বসতির চারিদিকে বিভৎস শব্দ করতে করতে ছড়িয়ে পড়লে মানুষটা শঙ্কিত দৃষ্টিতে যেন নরক দর্শন করতে থাকে। সে শুকনো গলায় বলল, দয়াল, বাঁধাছাদার কাম তুমি পরে করবা, আগে বাঁশ হাতে লও! জানোয়ারগুলা এদিকে আইতে পারে।
দয়াল আর দেরি না করে হাতের কাজ ফেলে একটা বাঁশের টুকরো হাতে নিয়ে ছাউনিটার চারিদিকে পাক খেতে থাকে। কোনোভাবেই যেন এই ছাউনি, গোঁসাই মানুষটার আস্থানা অপবিত্র না হয়। কাছাকাছি এসে পড়া শুয়োরগুলোকে জোর তাড়া লাগায়। বলল, আপনার কোনও ভয় নেই গোঁসাই। ওই শুয়োরটাকে ধরতে পারলেই বাকিগুলো একটু পরেই চুপ মেরে যাবে।
শুয়োর ধরার সবাই বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বৃত্তটাকে ছোট করতে করতে শুয়োরটার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। শুয়োরটা বেরোবার পথ না পেয়ে বৃত্তের ভিতরে এলোপাতাড়ি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয়। বৃত্তটা যত ছোট হয়ে আসতে থাকে শুয়োরটার মৃত্যুভয় তত প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। একসময় তিন চার জন একসঙ্গে প্রায় শুয়োরটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওটাকে ধরেই মুহূর্তে কাত করে শুইয়ে দিয়ে জোরে চেপে ধরলে যার হাতে নাইলন দড়ি সে দড়ির মাথার ফাঁসটা গলায় পরিয়ে দিয়েই জোরে টান দিয়ে ফাঁসটাকে আঁটোসাঁটো করে দেয়। শুয়োরটা রেহাই পেতে আর্তনাদসহ ছটফট করতে থাকে। চিৎকারটা আরও বিকট শোনায়। সবাই মিলে ওটাকে চেপে ধরে দুজোড়া পা দড়ির বাকি অংশ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিল। যার হাতে বাঁশের টুকরোটা ছিল সে ওটাকে দুজোড়া পায়ের ভিতর দিয়ে ঢুকিয়ে দিলে বাঁশটার দুপ্রান্তে দুজন করে চারজন জলদি কাঁধ লাগাল। তারপর ওটাকে নদীর দিকে বয়ে নিয়ে চলল। যথারীতি পিছনে পিছনে ছোটদের হৈচৈ, মজা আর আনন্দের লাফালাফি।
সূর্যটা এখন প্রচন্ড তেজে তাপ ঢালছে। ভেজা পৃথিবী দ্রুত শুকোতে লেগেছে। শুয়োরটাকে বয়ে নিয়ে নদীভেড়ি থেকে নেমে জোয়ারের জলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল ওরা। কোমর সমান জলে নেমে বাঁশটার দুপ্রান্ত জলে চুবিয়ে ধরে শক্ত করে। নোনাজলের জ্বালাধরা কামড়ের মধ্যে একটা অসহায় পশুর বাঁচার জন্য তীব্র লড়াই চলছে। জলে আর পশুতে মিলে জোয়ারের ঢেউ এখন লড়াই ভূমি, মানুষের হিংস্র উন্মাদনার উল্লাস। ওরা বাঁশটাকে আরও জোরে চেপে ধরে। কতটুকু আর সময় লাগল।মিনিট দশেকের মধ্যে সব শেষ!
মৃত নিথর পশুটাকে বয়ে নিয়ে ওরা বসতির দিকে ফিরছে।
মানুষটার ছাউনির অনতিদূরে খড়ে আগুন জ্বালিয়ে তাতে শুয়োরটাকে শুইয়ে উল্টেপাল্টে দিয়ে গায়ের লোম পোড়ানো হল। তারপর বড় একটা প্লাস্টিকে শুইয়ে দিয়ে ছোট কুড়ুল দিয়ে ওটাকে কুপিয়ে কুপিয়ে কাটা হতে থাকে। রক্ত মাংস ক্লেদ, নাড়িভুড়ির উৎকট দৃশ্য দেখে ঘৃণায় মানুষটার গা গুলিয়ে ওঠে। বলল, এই দিশ্য আর দেখন যায় না দয়াল।
ওদিকে আর তাকাবেন না গোঁসাই। দয়াল বলল।
চোউখ আছে বইলাই তো না তাকাইয়া আর পারি না দয়াল। যত তাড়াতাড়ি পারি সিনান আর আহ্নিকটা সাইরা লইয়া কীর্তনে বাইর হইয়া পড়ি! তা তুমি আমারে লইয়া মুকুন্দ পোদ্দারের কাছে যাওনের কী ঠিক করলা কও।
আপনি চান তো এখনই চলেন। দয়াল বলল। কারণ সে বুঝতে পারছে, মানুষটার প্রতি বড় অন্যায় সব কাজ করা হচ্ছে একের পর এক। এতে করে বসতির মানুষগুলোরই পাপের বোঝা বাড়ছে দিন দিন।
হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি পার নিয়া চল। এই নরকের জীবন থিকা তমাগ মুক্তি না দেওন পয্যন্ত আমার শান্তি নাই। তমাগও মঙ্গল।
বলতে বলতে গামছাটা কাঁধে ফেলে একটু সর্ষের তেল গায়ে মাখছিল মানুষটা, স্নানে যাবে। এমন সময় লুকাস এসে দয়ালকে খবরটা দিল, কাল রাতে ঝড়জলের সময় আমাদের বসতিতে নির্ঘাত চোর ঢুকেছিল দাদু। মাটি শুকোতে বড় বড় পায়ের ছাপ ফুটে উঠেছে।
শুনে দয়ালের কপালে গুচ্ছের চিন্তার ভাঁজ পড়ল। মানুষটার উদ্দেশ্যে বলল, এ তো ভারি চিন্তার কথা গোঁসাই। আমাদের মতো গরীবগুর্বোর ঘরেও যদি চোর সিঁদোয় তাহলে আর বাঁচি কী করে বলুন তো দেখি!
মুহূর্তে মানুষটার মুখমণ্ডলে কেমন এক আতঙ্কের ছায়া ছড়াল। এই বুঝি সে ধরাই পড়ে গেল। তার এই ধরা পড়াটা কোনও কঠিন ব্যাপার নয়। পারু মুখ ফুটে ঘটনাটা বসতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে দিলেই তো সে বড় বিপদে পড়ে যায়। পারুর কাছে এই ঘটনার প্রমাণও আছে। ওই যে গামছাটা! আসলে গামছাটা কাল রাতের ঘটনার সঙ্গে জড়িত না থাকলেও পারু জড়িয়ে দিতেই পারে। পারু যদি বলে,গোঁসাইয়ের গামছাটা মোটেই চুরি যায়নি। এই তো সেটা, কাল রাতে এই গামছা কাঁধে নিয়ে সে আমার ঘরে ঢুকেছিল, প্রমাণ হিসেবে ওটাকে আমি কেড়ে রেখে দিয়েছি। চুরি যাওয়ার কথা রটিয়েছিল নতুন গামছা পাওয়ার লোভে।
তবুও আত্মরক্ষার্থে মানুষটা বলল, যে আইছিল সে যে চোরই আছিল তা কী কইরা ধইরা নিলা তোমরা শুনি? ঝড়জলে আটকা পইড়া কেউ তোমাদের দাওয়ায় একটু ঠাঁই নিছিল হয়ত। চোরই যদি হইব তইলে কিছু না লইয়াই চইলা গেল!
আপনি ঠিকই বলেছেন গোঁসাই। কিন্তু অত রাত করে রাস্তা ঘাটে লোকজন থাকার তো কথা নয়। এই গরমকালে কোথাও তো যাত্রাপালা বা কবিগান হয় না যে রাত করে ঘরে ফেরার পথে ঝড়জলের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমাদের বসতিতে ঠাঁই নেবে।
হ, তোমার কথাটাও তো ফেইলা দেওন যায় না। তাইলে কেউ নিশ্চয়ই অন্য কোনও বদ মতলবে বসতিতে ঢুকছিল। বয়স্থা মাইয়াটাইয়া আছে যখন তখন তোমাগ একটু সাবধানে থাকন লাগে।
মানুষটা লক্ষ্য করে, দয়ালের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার বিন্দু বিন্দু ধূসর রেণু ফুটে উঠছে। মানুষটা ভালভাবেই অনুমান করতে পারে, দয়াল এখন কী ভাবছে। নিশ্চয়ই ওই অগস্টিন ছোকরাটার কথা। যে কিনা রাতদুপুরে তার মেয়ের ঘরে ঢুকেছিল। দয়ালের বুকের ভিতরটা এখন নির্ঘাত আতঙ্কে মোচড় দিয়ে উঠছে। ছোকরাটা তার মেয়ের সর্বনাশ করার জন্য আসেনি তো! এখন থেকে মেয়ের ব্যাপারে আরও সজাগ থাকবে সে। মানুষটা চায়, পারু আর অগস্টিনের অভিসারপর্ব হাতেনাতে ধরা পড়ুক! দয়ালের উদ্দেশ্যে বলল, কী দয়াল, অত কী চিন্তা করতাছ তুমি? আরে, সাবধানের মার নাই জানবা। চিন্তা কইরো না অত!
দয়াল মাথা নেড়ে বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ঠিকই বলেছেন গোঁসাই, এখন থেকে আমাদের খুব সাবধান হতে হবে।
লুকাস গম্ভীর গলায় প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে দয়ালের উদ্দেশ্যে বলল, বসতির ফটকে তালাচাবির ব্যবস্থা করতে হবে দাদু!
হুম। আর কিছু বলে না দয়াল। ভাঙ্গা ফটকটার দিকে পলকহীন দুচোখে তাকিয়ে থাকে। ফটকটা সারাই করা দরকার মনে করে।
ক্রমশ…