• Uncategorized
  • 0

|| আন্তর্জাতিক ডাক্তার দিবস || লিখেছেন আকাশ কর্মকার ও নীতা পাত্র কর্মকার

বিচ্ছেদের সার্জারি

রোজ সকাল ছটায় গেটের বাইরে রনির স্কুলবাসের তাড়ায় অনেক সক্কাল সক্কাল বিছানা ছাড়তে হয় ঊর্মিকে। তাড়াহুড়োর হাতে দুটো ব্রেড ওমলেট আর এক গ্লাস দুধ ব্রেকফাস্ট দিয়ে ছেলেকে স্কুলে রওনা করেন, তারপর এক কাপ চিনি ছাড়া লাল চা খেয়েই বেরিয়ে পড়েন হিমাদ্রি সারাদিনের জার্নিতে।
ডাঃ হিমাদ্রি বোস এই শহরের একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক , তার হাতে যেনো রয়েছে দুর্মূল্য সেই বিশল্যকরণীর গুন। হসপিটালের সকল স্টাফ, সকল নার্সের শ্রদ্ধার, ভালোবাসার মানুষ। আবার বেশ খামখেয়ালিও বটে, রোগীদের সেবায় একবার ডুবে গেলে দিন রাত সব ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দে পেরিয়ে চলে যায়। তবে রোজকার মতোন নিয়ম করে রাত আসে আবার পরদিন ভোর হয়, কতগুলো দিন কতগুলো রাত হিমাদ্রি বাবু তার চেম্বারে কাটিয়ে ফেলেন সেটা তিনি নিজেই জানতে পারেন না।
ঠিক বারো বছর আগে বাবা মা’র অমতে বিয়ে করেন, একটা দুই কামরার ফ্ল্যাটে নিজেদের মতোন সংসার গড়তে থাকেন বোস দম্পতি। কিন্তু সংসারের প্রতি হিমাদ্রির উদাসীনতা যেনো দিন দিন আরো বেড়েই চলেছে; ঊর্মি আজ কোথাও যেনো চাকচিক্যে মোড়া স্ত্রী হয়ে রয়ে গেছে অনুভূতির ঊর্ধ্বে। নিত্য দাম্পত্য কলহ ওনাদের ডেইলি রুটিনের একটা অংশ হয়ে উঠেছে। সময়ের টানাপোড়েনে দুজনেই আজ ক্লান্ত; তবুও হাজার একাকিত্বের মধ্যে একটা হাসির কারণ হলো একমাত্র ছেলে, আর কদিন পর যার দুই অঙ্কের ঘরে পদার্পণ দিবস উদযাপিত হতে চলেছে।
একদিন রাতে হিমাদ্রি বাবু বাড়ি ফিরলে তার স্ত্রী ওনাকে বলেন তাদের ছেলে বড়ো হয়েছে, সামনেই সে দশ বছর পূর্ণ করবে, তাই উনি একটা বার্থডে পার্টি রাখতে চান। ডাক্তারবাবু বেশ খুশি হয়েই এই প্রস্তাবে সম্মতি দেন। তারপর থেকে চলে শপিং, মার্কেটিং, বেলুন রং বাহারি চকমকির কাগজ.. স্বামী স্ত্রী দুজন মিলে আবার আগের মতোন করে বাজার সাজিয়ে আনে, রাতে ক্লান্ত দুটো শরীর বিছানায় এলিয়ে পড়ে। মিসেস বোসের মন বেশ খুশি, হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কের এ যেনো এক পুনরুজ্জীবনী প্রক্রিয়া। আজ রাত বারোটা বাজলেই রনির জন্মদিন, কাল সন্ধ্যায় এক বিশাল আয়োজন।
রোজকার মতোন সকালে আজও হিমাদ্রিবাবু হসপিটালে বেরোচ্ছেন, ঠিক তখনই মিসেস বোস হাতটা চেপে ধরে বললেন – “ঠিক ৭ টা মনে আছে তো.. আর যাই করো আজকের দিনটা লেট করোনা, প্লিজ্।” ডঃ বোস মৃদু হেসে বললেন- “একদম লেট করবোনা ম্যাডাম, আপনি সব আয়োজন সেরে রাখুন, আজ কোনো ডাক্তার নয়, একজন বাবা সময়ে উপস্থিত হবেই হবে।”
সারাদিন সকলে মিলে হৈচৈ করে সাজানো হলো ঘর, ড্রয়িং রুম, টেবিল, সোফা। কেক উপস্থিত, খাবারের আয়োজনও সম্পূর্ণ।
ঘড়িতে সন্ধ্যে ছ’টা, এবার ছেলেকে তৈরী করে হিমাদ্রির প্রিয় নীল পাঞ্জাবীটা খাটের ওপর রাখলেন ঊর্মি। ক্রমে নিজের গতিতে এগোতে থাকলো পার্টি। আত্মীয় বন্ধুদের সকলের আগমনে আজ ছোট্ট দু’কামরার ফ্ল্যাটটা বেশ গমগম করছে; কিন্তু সকলের মুখে একটাই প্রশ্ন হিমাদ্রি বাবু কৈ! দেখতে দেখতে আটটা বেজে গেলো! ঊর্মি নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে বার বার ফোন করতে থাকেন কিন্তু ঐপার থেকে একটাই কথা শোনা যায় বারবার, The number you have dialed is currently switched off. Please call again later.
সেদিনের মতোন পার্টির সাথে সাথে হয়তো আরো অনেক কিছুই শেষ হয়ে গেছল। ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকা একটা সলতে এক দমকা ঘূর্ণিঝড়ে নিভে যাবার উপক্রম। পরদিন সকাল আটটায় যখন এলেন হিমাদ্রিবাবু, কিছু বলার বা বোঝানোর অবস্থায় উনি হয়তো ছিলেন না কারণ ততক্ষণে তার বেলুনে সাজানো ফাঁকা বাড়িতে তিনি একা। সামনের টেবিলে নামানো চিঠিটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিল, গতকাল তিনি আসতে অনেকটাই দেরী করে ফেলেছন, যে দূরত্ব এককে মাপা সম্ভব নয়। এখানেই শেষ, আবার হয়তো এখান থেকেই শুরু!
আজ আরো বারোটা বছর এগিয়ে এসেছে, সেই রাতের ঘটনা আর কেউ জানতে পারল না, কারো জানার কথাও নয়। বাড়ি ফেরার পথে নিজেরই গাড়ির চাকায় চাপা পড়ে যাওয়া মৃতপ্রায় ছোট্ট অনাথ ছেলেটাকে উনি নিজে হাতে সুস্থ করে তুলেছেন। কেউ কোনোদিন জানলো না, যখন তার স্ত্রী অভিমানে ছিঁড়ে ফেলছিল তার বাড়ীর সাজানো গেটের সমস্ত ফুল, তখন উনি অপারেশন টেবিলে যত্ন করে একটা একটা সেলাই এর বুনুনে প্রাণ দিচ্ছিলেন ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হাড় মাংসের শরীরে!
কেউ জানে না, কেউ কখনো জানবেও না, কেউ তো জানার জন্য অপেক্ষাও করেনি। যোগ-বিয়োগের সংসারে অভিযোগ-অভিমানের পাল্লা যে আজ বড্ড ভারী হয়ে উঠেছে।
আজ এতবছর পরও তিনি একটা কথাতেই বিশ্বাসী, তিনি একজন বাবা, তিনি একজন স্বামী কিন্তু সবার আগে হয়তো তিনি একজন ডাক্তার। ডাক্তারদের ছুটি নেই, ডাক্তারদের ছুটি হয়না। শপথবাক্য ভাঙলে আওয়াজ হয়না ঠিকই, তবে বিবেকের দংশনে প্রতিমুহূর্তে একটা করে আঁচড় পড়ে হৃদয়ে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।