সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে অসিত কর্মকার (পর্ব – ৭)

যুদ্ধ যুদ্ধ

সাত

কুহু কুহু কুহু…।
একটানা কোকিলের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল মানুষটার। ভাবে, তবে কি ভোর হয়ে এল। এত তাড়াতাড়ি! কেননা এখনও তার চোখে ঘুম, শরীরে ক্লান্তি। ভাল করে চোখ মেলে। ছায়াছায়া রুপোলি রঙ্গের নিঃসাড় পৃথিবী। নিমগাছটার ডালের ফাঁকে তেজী চাঁদটাকে দেখতে পেল মানুষটা। অনুমান করল, রাত এখন তিন প্রহরও হয়নি। তবে হ্যাঁ, চাঁদটা এত নিটোল হয়ে ফুটেছে যেন চারিদিকে ভোর এখন।কোকিলটা ভুল করতেই পারে। কাক এত চতুর হয়েও এই একই ভুল করে বসে কখনও কখনও। কিন্তু কোকিলের গলা এত ভারি হবে কেন? ভোরে কোকিলের ডাক বুঝি এমনই শোনায়। মনে খটকা লাগে মানুষটার, কোকিলটা হঠাৎ ডাকাডাকি থামিয়ে দিল কেন। ওই ডাকের পাল্টা ডাক আরেকটা কোকিল ডেকে উঠছে না বলেই কি? এমনই হয় বুঝি। ঠিক মনে করতে পারছে না মানুষটা। একটু পরেই হঠাৎ খুব মিহি গলায় মাত্র একবারের জন্য অন্য একটা কোকিল ডেকে উঠল যেন। তারপরই চারিদিক নিস্তব্ধ। শোয়া থেকে উঠে বসল মানুষটা। কোকিল দুটো কোথায় বসে ডাকছে তা বোঝার চেষ্টা করে। আর ঠিক তখনই তার খোলা চোখের সামনে দিয়ে একটা ছায়া সরে গেল যেন। স্পষ্ট বুঝল,তার পিছন দিয়ে কেউ একজন খুব সন্তর্পণে হেঁটে চলে গেল। বিড়াল হেঁটে যাওয়ার মতো করে।
মানুষটা ভয় পেল। তবে কি সত্যিই শ্মশানের ওই…! কিন্তু ওই অশরীরীই যদি হবে তাহলে তার ছায়া পড়বে কেন।ইহজগতের কোকিলের ডাকে সাড়াও কি সে ওইভাবে দিতে পারে? তারপর ঠিক জীবিতের মতো করে এমন হেঁটে যাওয়া! সব মিলিয়ে কেমন এক হতভম্ব ভাব মানুষটার। ভাল করে চোখ চালিয়ে দেখল, অশরীরী কেউ নয়, পারু বসতির পিছন দিকে হেঁটে যাচ্ছে। বুঝতে পারল, সবই দুটো মানুষকোকিলের ডাক ছিল। অভিসারে চলেছে পারু। অগস্টিন ছেলেটা কোকিলডেকে প্রেমিকাকে ঘরের বাইরে বার করে এনেছে, কতবড় সাহস ছেলেটার! পারুই বা কেমন বেয়াক্কেলে, এই রাত গভীরে ছেলেটা ডাকল আর তুই দিব্যি ঘর থেকে বেরিয়ে এলি? যেদিন সব খুইয়ে ঘরে ফিরবি সেদিন বুঝবি মেয়ে! এমনই নানা কথা মনে চালাচালি হতে থাকে মানুষটার।
আর কৌতূহল সংবরণ করতে পারছে না মানুষটা। নিজেকে যতটা সম্ভব লুকিয়ে রেখে পারুর পিছু নিল। বসতির পিছনের খানাটার পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা। হাত দুয়েক চওড়া। দুপার জুড়ে ঢোলকলমির ঝাড়। পারু ওই পথ দিয়ে হেঁটে বুড়ো শিরীষগাছটার পিছন দিকটায় চলে গেল। সেখানে নিশ্চয়ই অগস্টিন দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তার লম্বা ছায়া পড়েছে পাশটি দিয়ে। মানুষটা দেখতে পাচ্ছে ছায়াটার তেমন নাড়াচাড়া নেই। স্থির, একমনা হয়ে দাঁড়িয়ে। গাছটার এপারে একটা শুকনো খাদ মতো। তাতে ঘাস, লতাপাতার জাঙ্গল। মানুষটা বুঝল, নিজেকে লুকিয়ে রাখার এ এক আদর্শ জায়গা ওটা।
ওদের কথাগুলো ঠিকমত শুনতে পায় না মানুষটা। শুধু দেখে, দুটো ছায়া ঘনিষ্ঠ হয়ে একটা ছায়ার আকার পেল। ছায়া দুটো মিলেমিশে যাচ্ছে।তারই যুগল ভঙ্গিমা যত ছায়ায় খেলা করছে। দেখে মানুষটার মধ্যে আজ কতদিন পরে যৌনখিদে প্রবল হয়ে উঠছে। পরিতৃপ্ত হওয়ার বাসনা জাগছে মনে। বুঝতে পারছে, সে এখনও তেমন বুড়িয়ে যায়নি। নতুন করে সংসারসুখের যে স্বপ্ন সে দেখে তাতে কোনও ভুল নেই। ছায়া দুটো একসময় আলাদা হল। নিজেদের মধ্যে কীসব কথা সারল।
গাছের পিছন থেকে বেরিয়ে এল পারু। অগস্টিন তাকে জিজ্ঞেস করল, দুপুরে কলে জল আনতে যাচ্ছ তো?
হ্যাঁ।
আর রোববার গির্জায়?
হ্যাঁ।
পারু হনহন করে ঘরের পানে হাঁটছে। মানুষটা তখনও খাদের মধ্যে। বুঝতে পারল, বড্ড ভুল হয়ে গেছে তার, এভাবে হুট করে খাদে নেমে আসা ঠিক হয়নি। পারু তার আগে পৌঁছে দেখবে নিমগাছটার নীচে সে নেই। ফলে পারু তাকে সন্দেহ করতেই পারে। কিন্তু ভুল সংশোধনের উপায়ও নেই তার এখন। বুঝল, খাদে নামা যত সহজ উঠে আসা ঢের বেশি কঠিন। ঘাস, লতাপাতা আঁকড়ে ধরে কোনওরকমে উপরে উঠতে থাকে মানুষটা। অসাবধানে তার হাঁটু ছড়ে গিয়ে রক্ত ঝরছে। হাতের পাতা দুটোতে জ্বালা জ্বালা ভাব। কাঁটাও ফুটেছে কটা। ধুতি ছিঁড়েছে। হাঁটতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছে খুব। একরকম ল্যাংচে ল্যাংচে চলে।
নিমগাছটার তলায় এসে মানুষটা দেখল, তার গামছাটা নেই!
ভোর না হতে বসতিতে হৈচৈ বাঁধিয়ে দিল মানুষটা। নিমগাছটার নীচে এখন পুরো বসতির ভিড়। সবার মনে কৌতূহল, মানুষটার গামছাটা কে চুরি করল!
ভিড়টার উদ্দেশ্যে গলা চড়িয়ে দয়াল বলল, এ তো ভাল কথা না, কাল গোঁসাইয়ের টাকা দুটো চুরি গেল, আর আজ গেল তার গামছা চুরি। কে নিয়েছ সাফ সাফ বলে দাও। সামান্য একটা গামছার জন্য পাপের ভাগীদার হবে কেন তোমরা? গোঁসাই মানুষটার অভিশাপ কুড়িও না।
ভিড়টা সহসা আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। একরকম সমস্বরে চিৎকার করে সবাই বলল, আমি নিইনি, আমি নিইনি!
তারপর উচ্চস্বরে নিজেদের মধ্যে তাদের সততা নিয়ে কথা চালাচালি করতে লাগল।
ধমক দিয়ে উঠল দয়াল, চুপ সবাই! তোমরা টাকাদুটো নাওনি, গামছাটা নাওনি, তবে কি সব বাতাসে মিলিয়ে গেল!
ভিড়টা মুহূর্তে চুপ করে গেল।
একটু পরে লুকাস নীরবতা ভেঙ্গে বলল, কুকুরে নিয়ে যায়নি তো?
হতেই পারে। ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলল।
কুকুরে নিলে সে কি আর আস্ত রেখেছে? আরেকজন বলল।
তাহলে নতুন একটা গামছা কিনে দিতে হবে গোঁসাইকে। কিন্তু টাকাদুটো তো আর কুকুরে নেয়নি। দয়াল বলল।
মানুষটা দয়ালের কথায় সম্মতি জানিয়ে বারকয়েক মাথা দোলাল। বলল, অভাবে স্বভাব নষ্ট, বোঝলা দয়াল। মনে লয় কোনও পোলাপাইনে টাকাদুইডা নিয়া মন্ডামিডাই কিইনা খাইছে। তাই কইতাছি, ঐ নিয়া তুমি আর অশান্তি কইর না।
এসব ছেলেকে মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে দিতে হয়। দয়াল ক্রুদ্ধ হয়ে বলল।
তাতে কি স্বীকার পাইবা? মানুষটা বিদ্রুপভরা বাঁকা হেসে ফের বলল, পাইবা না!
বসতির প্রধান ফটকের একপাশে ডাঁই করে ওই কুঁড়েঘরের ভাঙ্গাচোরা বাঁশ, খুঁটি, পচা খড় রাখা হয়েছে। এগুলো রান্নার কাজে পুড়িয়ে ফেলা হবে। নতুন খড়, খুঁটি আর বাতার বাঁশ লাগবে কিছু। পিরা আর দেয়ালের মাটি নোনায় ধরে ঝুরঝুরে এখন। কটা বিষাক্ত সাপ মারা হল। কটা আবার পালিয়ে বাঁচল। কুঁড়ের ভিতরে আসবাবপত্র বলতে কিছু নেই। থাকার বলতে শুধু একটা সিঁদুর মাখা ত্রিশূল মেঝের একপাশে মাটিতে গাঁথা। তার পাশে একটা কালো পাথর।
পাথরটার গায়ে ছড়িয়ে রয়েছে সেই কবেকার কিছু ফুল বেলপাতা। শুকিয়ে কালো কুচকুচে। গায়ে লেপানো সিঁদুর শুকনো রক্তের মতো কালচে, গুড়ো গুড়ো। ঘর সারাইয়ের কাজে লাগা মানুষগুলো ওই ত্রিশূল আর পাথরে হাত দেওয়ার সাহস পায় না।
একসময় ভিড়টা পাতলা হয়ে গেল। মেয়েছেলেরা সংসারের কাজে নেমে পড়ল। পুরুষরা তৈরি হয়ে যে যার কাজে বেরোচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্যে দয়াল বলল, তাড়াতাড়ি ফিরিস সবাই, এখনও অনেক কাজ বাকি। ঝড়জলের দিন আসছে, কাজটা যেন ভাল হয়।
একটু ছায়ার ব্যবস্থা করতে পার দয়াল? রৌদ্দের বড় তেজ। সারা শরীলডা পোড়ায়। দুপুরকাটাইলে আর টিকন যাইব না। মানুষটা বলল।
দয়াল খানিক ভেবে বলল, সে ব্যবস্থা আমি করব গোঁসাই। ওই কুঁড়েঘরের একটা চালা এনে এই নিমগাছটার সঙ্গে ফিট করে দেব। আপনাকে কটা দিন তো এখানেই থাকতে হবে। তারপর দয়াল লুকাসকে ডাকল।
লুকাস নিজের মতলবেই মানুষটার কাছেপিঠে ঘুরঘুর করছিল। কখন মানুষটাকে সে একা পাবে, সয়েনিকে বশীকরণ করার পদ্ধতিটা মানুষটার কাছ থেকে শিখে নেবে।
দয়ালের হুকুম পেয়েই লুকাস দৌড়ে গিয়ে দয়ালের ঘর থেকে শাবলটা নিয়ে এল। মনে তার এখন দারুণ ফুর্তি। দয়াল তাকে দেখায় নিমগাছটা থেকে কতদূরে কতটা দূরত্ব রেখে দুটো গর্ত করতে লাগবে। তাতে দুটো খুঁটি পুঁততে হবে। খুঁটিদুটোর মাথায় আড়াআড়িভাবে একটা বাঁশ বাঁধতে হবে। সে বাঁশের সঙ্গে লম্বালম্বিভাবে তিনটে বাঁশের বাঁধন পড়বে। ওই তিনটে বাঁশের মাঝামাঝি আড়াআড়িভাবে আরেকটা বাঁশের বাঁধন পড়বে। এতে করে তিনকোণাকার একটা চালা তৈরি হবে। তার উপর খড় চাপানো হবে। মানুষটা আপাতত সে চালার নীচে বাস করবে।
দয়াল চালাটা তৈরির জন্য পুরানো দড়িদড়া, উপযুক্ত বাঁশ আর খুঁটি সংগ্রহে ব্যস্ত। মাটির বুকে শাবল চালায় লুকাস। শুকনো খটখটে মাটি যন্ত্রণায় টংটং শব্দ করে ওঠে। মানুষটা একটু দূরে বসে লুকাসের কাজ দেখছে। লুকাসকে তার উপকারটুকু করতেই হবে। প্রাণ বাঁচিয়েছে তার, তাই কেমন একটা টান অনুভব করছে।
গোঁসাই, আমার ওই ব্যবস্থাটা হচ্ছে তো? লুকাস গড়িয়ে চলা গালের ঘাম হাতের তালু দিয়ে মুছে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল।
হইব, আমার উপর ভরসা রাখ। মিটিমিটি হেসে জিজ্ঞেস করল, কি রে, আছে তো ভরসা?
আছে গোঁসাই, আছে। এই আমি প্রভু যীশুর ক্রুশ ছুঁয়ে বলছি।
সহসা মানুষটার সারা মুখমণ্ডল পাথরের মতো কঠিন হয়ে উঠল। তাতে বিদ্রুপমাখা তাচ্ছিল্যভাব। চোখের বাঁকে, ঠোঁটের কোণে খেলা করছে ঘৃণা।
তাইলে আর আমার কাছে কেন? যারে ছুঁইয়া শপথ করতাছস তার কাছেই হত্তা দিয়া পইড়া থাক! মানুষটা উষ্মা প্রকাশ করে বলল।
তৎক্ষণাৎ ক্রুশ থেকে হাত সরিয়ে নিল লুকাস। সে বুঝতে পারছে, দুনৌকোয় পা দিয়ে ফেলেছে। প্রভু যীশুর নামে শপথ করে সামনের এই মানুষটাকে ছোট করছে। তাকে এখন ভুল শোধরাতে হবে। চট করে তার মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেল। নরম গলায় বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, সে তো পাথরের মূর্তি, কোনও কথার উত্তর মেলে না তার কাছ থেকে। এটা আমাদের অভ্যাস গোঁসাই, কথায় কথায় ক্রুশ ছুঁয়ে শপথ করি। এটাকে আপনি ধরার মধ্যে নেবেন না। আপনার সঙ্গে কী ওই মূর্তির তুলনা! হয় কখনো?
ঠিক আছে, ঠিক আছে। কথাডা মনে রাখিস। মানুষটা খানিক আত্মপ্রসাদের সঙ্গে বলল।
কটা বাঁশ আর দড়িদড়া হাতে দয়াল দুজনের সামনে এসে দাঁড়াতে ওদের কথার প্রসঙ্গ পাল্টে গেল। এত সময়ে একটা গর্ত ঠিকমতো খোঁড়া হয়নি দেখে লুকাসকে ধমক দিল দয়াল। মূহুর্তে লুকাসের হাতের শাবল ক্ষিপ্র হয়ে উঠল।
সামনের ফাঁকা জায়গাটায় ছোট ছেলেপুলেগুলো হুটোপাটি লাগিয়ে দিয়েছে।সেইসঙ্গে থেকে থেকে ওরা নেচে নেচে হাততালি দিয়ে ছড়া কেটে উঠছে। ওদের মুখে মুখে ফেরা ছড়াটা এখন আরেকটু বড় হয়েছে,
গোঁসাই গোঁসাই গোঁসাই
পয়সা হারায় গোঁসাই
গামছা হারায় গোঁসাই!
শুনে মানুষটা ওদের দিকে তাকায়। তার দুচোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। দয়ালের নজর এড়াল না তা। খেদ প্রকাশ করে বলল, যত্তসব বেয়াদব, অসভ্য ছেলেপুলে! ধমক দিয়ে তাড়া লাগিয়ে বলল, গেলি তোরা এখান থেকে!
লুকাস একটা বাঁশের টুকরো উঁচিয়ে ওদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলল, এই দেখেছিস এটা, মেরে একেবারে মাথা ফাটিয়ে দেব সবকটার!
ওরা দৌড়ে দূরে সরে গেল। কিন্তু ওদের মুখে ছড়া কাটা বন্ধ হল না।
ক্রমশ…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।