• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ৭)

দার্শনিক হেলাল ভাই – ৭

তাই বুঝতে পারলেন, কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের। তিনি মফিজকে জিজ্ঞেস করলেন: বলো তো ‘আকাশলীনা’ কবিতাটা জীবনানন্দ দাশের কোন কাব্য গ্রন্থের অন্তর্ভূক্ত?
চিঠি দিতে গিয়ে এরকম প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হবে মফিজ তা কল্পনা করতে পারেনি। মফিজ একেবারেই মফিজ হয়ে গেল। জীবনানন্দ দাশের একটা কাব্য গ্রন্থের নামই ওর জানা। সেটা হলো-বনলতা সেন। ও সেটাই বলে দিল।
সৈয়দ সাহেব মৃদু হাসলেন। বললেন: ‘আকাশলীনা’ কবিতাটা খুবই রোমান্টিক। তাই অনেকেই মনে করে, এটা বনলতা সেন কাব্য গ্রন্থের। আসলে এটা ‘সাতটি তারার তিমির’ গ্রন্থের প্রথম কবিতা।
তারপর সৈয়দ সাহেব চিঠির উল্টো পিঠে হেলাল ভাইয়ের নাম দেখলেন। বললেন: একে তো চিনি। তোমরা সবাই এর সাথে থাকো। কথা বলিনি কখনো, তবে ছেলেটাকে চেহারায় খুব ভদ্র আর সরল মনে হয়।
: জি, খুবই ইনোসেন্ট-জেন্টালম্যান।
: তা জীবনানন্দের কবিতা লিখে পাঠিয়েছে কেন?
‘এটা আপনার মেয়ের প্রেম প্রস্তাব পত্র’-এরকম কথা তো বলা যায় না। মফিজ বুদ্ধি করে বলল: হেলাল ভাই চমৎকার আবৃত্তি করে, তাই……..।
: ও বুঝেছি। আবৃত্তি আমারও খুব প্রিয়। গোলাম মুস্তাফার আবৃত্তি খুব ভাল লাগে। তার ভাতিজা শিমুল মুস্তাফা তো খুবই ভাল আবৃত্তিকার। বলা যায়, সে একাই আবৃত্তিকে একটা জনপ্রিয় শিল্প মাধ্যমে রূপ দিয়েছে। বৈকুন্ঠ নামে তার একটা আবৃত্তি প্রশিক্ষণ সংগঠন আছে।
: জি জি।
: কাল আমার সম্পূর্ণ অবসর। কাল বিকেলে হেলালকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে। আমি তার আবৃত্তি শুনতে চাই।
: জি আচ্ছা। আঙ্কেল, আমাদের দল কিন্তু বেশ বড়।
: সমস্যা নেই তাতে। পুরো দল আসবে। শ্রোতা যত বেশি হবে, তত মজা। আমি চা-নাস্তার ব্যবস্থা রাখব। আসবে কিন্তু।
: জি আচ্ছা।
হেলাল ভাইয়ের মেজাজ ফোরটি নাইন। ফোরটি নাইন মেজাজ হল অতিশয় গরম মেজাজ। হেলাল ভাই বলে, মেজাজ সর্বোচ্চ ফিফটি পর্যন্ত উঠতে পারে। ফিফটিতে উঠলেই মারামারি। আর ফোরটি ফাইভ থেকে ফোরটি নাইন পর্যন্ত ভাঙাভাঙি।
আর মাত্র এক মাত্রা উঠলেই হেলাল ভাই মফিজের ওপর আক্রমণ চালাবে। মানে চড়-থাপ্পর।
হেলাল ভাই ক্ষেপে গিয়ে বলল: তুই সরাসরি চিঠিটা সৈয়দ সাহেবের হাতে দিয়ে দিলি?
: কী করব?
: এদিক-ওদিক করে কিছু বলতে পারলি না?
: এদিক-ওদিক করে কী বলব?
: তাহলে চিঠিটা পকেটে নিয়ে চলে আসতি।
: বেল টিপেছি। দরজা খুলে একজন বের হয়েছেন। এ অবস্থায় কিছু না বলে চলে আসা যায়?
: কিছু একটা বলে আসতি।
: কিছু একটা কী বলব?
: সব শিখিয়ে দিতে হবে?
: এরকম পরিস্থিতির সম্মুখিন হব তা তো ভাবতে পারিনি। আমি কোনো কথা রেডি করে যাইনি।
: চিঠিটা তো মার হয়ে গেল। বায়ান্নটা চিঠির একটা মার হয়ে গেলে আর থাকল কী?
: আরও তো একান্নটা আছে। কপালে থাকলে এর মধ্যেই হয়ে যাবে। সবই কপাল। কপালে থাকলে একবার জাল ফেলেই দশটা মাছ ধরা যায়,
আর কপালে না থাকলে দশবার জাল ফেলেও একটা মাছ ধরা যায় না।
: আমি কপালে বিশ্বাস করি না। আমি ফপালে বিশ্বাসী।
: ফপাল কী জিনিস?
: ফপাল হলো কর্ম। আই বিলিভ ইন অ্যাকশন। তুই কাজ ঠিক মত করতে পারিসনি। ইচ্ছা হচ্ছে, তোকে স্যুট করি।
: জীবনে আগ্নেয়াস্ত্র ছুঁয়ে দেখেছেন যে, স্যুট করবেন?
: তুই জানিস বিশ্ববিদ্যালয়ের খচ্চর টাইপের ছাত্র নেতাদের সাথে আমার পরিচয় আছে। ওগুলো বদমায়েশের এক শেষ। লেখাপড়া-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-ঐহিত্য-ইতিহাস-বিজ্ঞান কোনো কিছুর ধরে-কাছেও নাই। নাম নিয়েছে ছাত্রনেতা। রাজনীতি বোঝে ঘোড়ার ডিম। খালি আছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির তালে। ওগুলো হল দলের বড় বড় নেতার পালিত কুত্তা। দেশটাকে……।
হেলাল ভাই মফিজকে ত্যাগ করে অন্যদিকে চলে গেল। তার রাগ মোড় নিয়ে চলে গেছে খচ্চর টাইপের ছাত্র নেতাদের ওপর। তার মানে মফিজ ঝামেলা মুক্ত।
বল্টু বলল: বাদ দেন তো হেলাল ভাই। ও তো চিরকালের মফিজ। আমরা হলে একটা কিছু বলে কাটিয়ে আসতে পারতাম। পরে ঠিক জায়গায় পৌছে দিতাম।
: চিঠি তো দিতে পারেই নাই, আবার আবৃত্তির বায়না নিয়ে এসেছে।
: এ কাজটা মন্দ হয়নি। চিঠি যে দিতে পারেনি সেটা পুশিয়ে দিয়েছে। মনে হয়, চিঠি দেয়ার চাইতেই বড় কিছু করেছে।
: মানে?
: এমন তো নয় যে, আপনি আবৃত্তি করতে পারেন না। আপনার আবৃত্তি শুনে সৈয়দ সাহেবের কন্যা সৈয়দা নার্গিস জাহান মুগ্ধ হবেই হবে। তাতে অন্যরকম কিছু ঘটার সম্ভবাবনা খুব বেশি।
হেলাল ভাই শান্ত হল। আমরা মহাখুশি। দল বেঁধে কারও বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ সাধারণত হয় না। যাব। হেলাল ভাইয়ের আবৃত্তি শুনব। খাওয়া-দাওয়াও হবে। সৈয়দ সাহেবের মেয়ে সৈয়দা নার্গিস জাহানের সাথে আমাদেরও কথা হবে নিশ্চয়।
পরদিন দুপুরের কিছু পরে আমরা সবাই গেলাম ১৫৮ নম্বর সৈয়দ ভিলায়। যাওয়ার সময় একবার হেলাল ভাই থমকে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল:
সৈয়দ সাহেব হয়ত কথার কথা বলেছেন। গিয়ে দেখব খেয়েদেয়ে সবাই ভাতঘুম দিচ্ছে। কি যে বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হবে!
আমাদের মনেও এরকম আশঙ্কা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল, আমাদের দেখে তিনি এবং তারা সবাই অবাক হবে। সৈয়দ সাহেব হয়ত মনেই করতে পারবেন না যে, আমাদেরকে যেতে বলেছিলেন। আমরা মনে করিয়ে দিলে সৈয়দ সাহেব হয়তো বলবেন, তাই নাকি? আসতে বলেছিলাম? দেখো দেখি, একেবারে ভুলে বসে আছি। আচ্ছা আসো আসো।
সবরকম নেতিবাচক আশঙ্কা নিয়েই আমরা সৈয়দ ভিলায় কলবেল চাপলাম।
দেখি সৈয়দ সাহেব, এবং তার স্ত্রী-কন্যা মিলে ভালই আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রেখেছে। তারা আমাদেরকে দেখে খুশি হল। আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করল। সবচেয়ে ভাল লাগার ব্যাপার হল, সৈয়দা নার্গিস জাহান মুখে মিটিমিটি হাসি ধরে রেখে বাবার পাশে ছিল। তার দৃষ্টি ছিল হেলাল ভাইয়ের মুখে। আমরা ধরে নিলাম, এখানেই কিছু হবে। হেলাল ভাইয়ের ব্যর্থ হয়ে যাওয়া পত্রটাই স্বার্থক প্রেম নিয়ে আসবে। আর সত্যিই যদি তা হয় তো হাবা মফিজ হেলাল ভাইয়ের কাছে বাবার মর্যাদা পেয়ে যাবে। হেলাল ভাই নিশ্চয় পুরণো দর্শন নতুন করে কপচাবেন-দেখেছিস, পচা শামুকেই পা কাটে। অথবা নতুন কোনো দার্শনিক মন্তব্যও করতে পারে। শত হলেও দার্শনিক মানুষ।
সু-সজ্জিত ড্রইং রুমটার তিন দিকে সোফা। মাঝখানে সবুজ গালিচা। তার ওপর ফুল-প্রজাপতির নকশা আঁকা চাদর বিছানো হয়েছে। চারিপাশে নামানো কুশন। কুশনগুলো নানা আকৃতির-চৌকোণা, ত্রিকোণা, হার্টশেপ। কুশনের কভারগুলোর মধ্যেও শৈল্পিক কারুকাজ আছে।
বুঝতে পারলাম, আবৃত্তির আয়োজন হিসেবেই এসব। সোফায় বসে আবৃত্তি হয় না।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।