আমরা সরাসরি গালিচায় বসতে চেয়েছিলাম। সৈয়দ সাহেব বাঁধা দিয়ে বললেন: না না, এখন ওখানে না। সোফায় বসো। আগে চা-নাস্তা হোক। তারপর গালিচায় বসে মূল অনষ্ঠানে যাওয়া যাবে।
সৈয়দ সাহেবের স্ত্রী চা-নাস্তা নিয়ে এলেন। চা, গরম জিলেপী আর লুচি।
সৈয়দ সাহেবের স্ত্রীকে আমরা আগে দেখেছি। কিন্তু কথা হয়নি, মুখে সেভাবে তাকানোও হয়নি। তিনিও তার মেয়ের মতোই মুখে হাসি ধরে রেখেছেন। হাসি হাসি মুখে হেলাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন: তুমি এসেই সবাইকে নিজের করে নিয়েছো। এটা খুব বড় একটা গুণ। সবার ভেতর এই গুণটা থাকে না।
হেলাল ভাইয়ের মুখ লাল হয়ে গেল। লজ্জায় কি না জানি না। হেলাল ভাই মুখে কিছু বলতে পারল না।
সৈয়দ সাহেবের স্ত্রী বললেন: বঙ্গবন্ধুর কথা চিন্তা করো, তিনি বলতেন-আমার মানুষ, ভায়েরা আমার। এরকম সম্বোধন শুনলেই তো তার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছা করে। যতদূর জানি, তুমি এসেই ওদেরকে তুই-তোরা এরকম সম্বোধন করতে শুরু করেছো, আর সবাই তোমাকে লুফে নিয়েছে। আচ্ছা, তোমরা খাও।
সৈয়দ সাহেবে স্ত্রী চলে যেতেই সৈয়দ সাহেব বললেন: তোমাদের খালাম্মা কিন্তু একটু বেশি কথা বলে। দেখেছো, এক দমে কত কথা বলে গেল।
আমি বললাম: কই, বেশি কিছু বলেননি তো।
: তবে তার কথা আমার ভাল লাগে।
: আমাদেরও ভাল লেগেছে খুব। উদাহরণ হিসেবে কি চমৎকারভাবে বঙ্গবন্ধুকে টেনে নিয়ে এলেন।
: খাও, লুচি আর জিলাপী-তোমাদের খালাম্মার নিজ হাতের তৈরী।
আমরা খেতে শুরু করলাম। মোফাজাফ্ফরের দোকানে তো আমরা সব সময়ই লুচি, জিলাপী খাই। স্বাদও লাগে খুব। কিন্তু সত্যিকারে লুচি-জিলাপীর যে কী স্বাদ, তা তখন বুঝলাম। খাচ্ছিলাম খুব হালুম-হুলুম করে। সৈয়দ সাহেব বললেন: কেমন লাগছে হেলাল?
হেলাল ভাই তখন গরম একটা লুচির অর্ধেকটা কামড় দিয়ে মুখের ভেতর নিয়ে হাঁ করে আছে। এরকম সময় প্রশ্ন। বলল: ভাও…..খুব ভাও।
সৈয়দা নার্গিস জাহান খিলখিল করে হেসে উঠে হেলাল ভাইকে একেবারে ভেঙে দিল। তবে আমাদের কাছে হাসির শব্দটা খুবই মিষ্টি মনে হল। মনে হল, নুপুরের নিক্কন ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ল ঘরময়।
সৈয়দ সাহেব মেয়েকে বললেন: হাসি সুন্দর জিনিস। তোমার হাসিটা একটু বেশি সুন্দর। তবে বুঝতে হবে, কোথায় হাসা উচিত আর কোথায় উচিত না।
মেয়ে অভিমানের সুরে বলল: হাসির আবার উচিত-অনুচিত!
: অবশ্যই উচিত-অনুচিত আছে। জগতের সব কিছুরই উচিত-অনুচিত আছে। গোলাপ ফোটানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজবে না?
: ঠিক আছে, আর হাসব না। মুখ কালি করে রাখব।
: হাসবে না কেন? যেখানে হাসার দরকার সেখানে হাসবে। এর জন্য কমনসেন্স দরকার। কমনসেন্স তৈরী কর। কমনসেন্স তৈরী করতে পয়সা লাগে না।
আমার বুঝলাম, মেয়েকে একটু বেশি শাসন করা হয়ে যাচ্ছে। হেলাল ভাইও সেটা বুঝল। ততক্ষণে হেলাল ভাই মুখের লুচি গিলে ফেলেছে। হেলাল ভাই সুন্দর করে বলল: হাসিটা তো কোনো সমস্যা করেনি।
সৈয়দ সাহেব বললেন: জিলাপীটা দেখেছ? মুখে দিলে হাওয়াই মিঠাইর মতো উড়ে যায়। আচ্ছা, তোমরা কি হাওয়াই-মিঠাই ইংরেজিটা জানো?
আমরা সমস্যায় পড়ে গেলাম। আচানক এভাবে ইংরেজি ধরা? চার বছর ধরে নাইনে থাকা গাব্বুটা সব সময় আমাদেরকে ইংরেজিতে চ্যালেঞ্জ করে। চ্যালেঞ্জটা মিথ্যা নয়। ও আমাদেরকে বাঁচাল। বলল: আঙ্কেল, হাওয়াই-মিঠাই ইংরেজি ক্যান্ডি ফলস।
: গুড। আমি বিশ্বাস করি, তোমরা সবাই লেখাপড়ায়ও অনেক ভাল। তোমার নামটা যেন কী?
: গাব্বুু।
: বাহ! সুন্দর নাম। গাব থেকে গাব্বু। এক সময় আমাদের দেশে গাবের অনেক ব্যবহার ছিল। নৌকায় গাবের আঁঠা দিতে হত। আমরা গাছে উঠে
পাকা গাব খেতাম। একবার ভর দুপুর বেলা আমার বন্ধু রমজানকে নিয়ে গাব খেতে গিয়ে ভূতের কবলে পড়েছিলাম।
ভুতের কবলে! ভূতের গল্প শুনতে আমাদের খুব আগ্রহ। গাব্বু বলল: ভূতের কবলে কীভাবে পড়লেন?
: এখন আবার সে গল্পে যাব?
: সমস্যা নেই আঙ্কেল। এখন তো আবৃত্তি হচ্ছে না। খেতে খেতে ভূতের গল্প শোনার মজাই আলাদা।
: তাহলে শোন-ভর দুপুর। প্রখর রোদ। সুনসান নীরবতা চারিদিকে। মা ঘরের মেঝোতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে হাত পাখার বাতাস খাচ্ছেন। বাবা বাড়িতে নেই। আমি চুপি চুপি ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। পথে বের হতেই পেয়ে গেলাম আমার বন্ধু রমজানকে। রমজান বলল, চল দোস্ত, বৈরাগীর ভিটায় থেকে গাব পেড়ে নিয়ে আসি। অনেক গাব পেকেছে। আমি আর রমজান গেলাম বৈরাগির ভিটায়। ভিটা ঠিক না, ছোট-খাটো বন। হাজার প্রকার গাছ তো ছিলই, আর ছিল শ’খানেক গাব গাছ। নানা রকম জন্তু-জানোয়ারের সাথে চিতাবাঘও থাকত তখন সেই ভিটায়।
প্রতিটা গাব গাছই যেন আকাশ ছোঁয়া। আকাশ ফুড়ে উঠলেও সমস্যার কিছু ছিল না। রমজান গাছে উঠত বাঁদরের মতো। তো অনেক গাব পাড়া হল। দুইটা ব্যাগ ভরে ফেলেছি। চলে আসব, এমন সময় একটা গাছের খুব নিচু এক ডালে দেখি এক ঝুপায় চারটা গাব। পেকে হলুদ হয়ে আছে। এরকম ঝুপায় বাঁধা পাকা গাব কখনো দেখিনি। আমরা লোভ সামলাতে পারলাম না। রমজান উঠে গেল গাছে। ঠিক সেই ডালে গিয়ে বলে-গাব কোথায়? দেখছি না তো। আমি নিচ থেকে গাব দেখছিলাম। ওকে যতই দেখাচ্ছিলাম, ও খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষে নিচে নেমে এল। এসেই দেখতে পেল। বলল-এবার নিয়ে আসছি। উঠেই আর গাব দেখে না। অথচ, নিচ থেকে আমি ঠিকই দেখছি। যদিও আমি গাছে ভাল চড়তে পারতাম না। ডালটা নিচু ছিল বলে শেষে আমি উঠে গেলাম। যে ডালে গাব দেখেছিলাম ঠিক সেই ডালটা দু’জন মিলে টেনে কাছে নিয়ে আসলাম। দেখি কোনো গাব নাই। নিচে নামতেই আবার সেই চারটে পাকা গাব। ওরা যেন হাতছানি দিয়ে আমাদের ডাকছে। আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তখন শোঁ শোঁ একটা শব্দ আসতে লাগল। আমরা দুইজন দুই ব্যাগ গাব নিয়ে দৌড়। একেবারে লোকালয়ে এসে তারপর থেমেছিলাম।
আমরা হাফ ছাড়লাম। শ্বাসরুদ্ধকর একটা গল্প। গাব্বু বলল: জানে বেঁচেেেছন। আর একটু সময় নিলে হয়ত আপনারা বিপদে পড়ে যেতেন।
বৈরাগীর ভিটায় আপনাদেরকে জ্যান্ত পুতে রাখত।
সৈয়দ সাহেব বললেন: যা হোক, গাব্বু নামটা আমার মনে ধরেছে বেশ। তুমি ভাল ইংরেজি জানো। আমি নিশ্চিত যে, তুমি এবার এইচ.এস.সি তো জিপিএ-৫ পাবে।
সৈয়দা নার্গিজ জাহান আবারও খিলখিল করে হেসে উঠল। তার হাসির পেছনে যুক্তিসংগত কারণ আছে। সে তো ভাল করেই জানে, গাব্বু চার বছর ধরে ক্লাশ নাইনে আছে। গাব্বু যে কবে এইচ.এস.সি পরীক্ষায় বসবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।