• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ৯)

দার্শনিক হেলাল ভাই – ৯

সৈয়দ সাহেব গরম চোখে তাকালেন মেয়ের দিকে। গাব্বু আমার পেছনে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল: এই মেয়ের হাসির প্রবলেম আছে। যাকে বলে লাফিং প্রবলেম। প্রবলেমটা মোটামোটি জটিল। সে যদি এখন থেকেই প্রবলেমটা সলভ করার চেষ্টা না করে তো ভবিষ্যতে সাফার করবে। যত হাসি তত কান্না বলে গেছে বাবা মান্না।
: বাবা মান্না কে?
: জানি না। চেনা প্রবাদ তো…….।
: বাবা মান্না নামে কেউ এ কথা বলে নাই।
: তাহলে কে বলেছে?
: রামশন্ন্যা।
: এটা আবার কে? এটা কি হেলাল ভাইয়ের মতো দার্শনিক ছিল?
: চুপ কর।
সৈয়দ সাহেব বললেন: আমি মাঝে মাঝে ভাবি, তোমাদের খালাম্মার মত সহজ-সরল একজন মানুষ এরকম প্যাঁচ দিয়ে জিলাপি বানায় কীভাবে।
আমরা কেউ কিছু বললাম না। আমাদের মনে হল, তারা স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের একমাত্র মেয়ে তিনজনই খুব সহজ-সরল।
চা-নাস্তা পর্ব শেষ হলে আমরা সোফা থেকে মাদুরে নেমে বসলাম। তারপর শুরু হবে হেলাল ভাই আবৃত্তি অনুষ্ঠান। শুরু হবার আগ মুহূর্তে সৈয়দ সাহেব হেলাল ভাইকে বললেন: তোমার কাছে তো বই-খাতা কিছু দেখছি না। কবিতা পড়বে কোথা থেকে?
: আমার হার্ডডিস্ক-এ সংরক্ষিত কবিতাগুলো আবৃত্তি করব আজ।
: কতগুলো কবিতা তোমার হার্ডডিস্ক-এ সংরক্ষিত আছে?
: শ’ খানেক কবিতা তো আবৃত্তি করতে পারবোই।
: বলো কী!
সৈয়দ সাহেব বিস্ফোরিত নেত্রে তাকালেন হেলাল ভাইয়ের মুখে। আমরাও বিস্ময় নিয়ে তাকালাম তার মুখে। অনেক কবিতা হেলাল ভাইয়ের মুখস্ত তা জানি। তাই বলে শ’খানেক কবিতা আবৃত্তি করতে পারবে তা ভাবতে পারিনি।
সৈয়দা নার্গিস জাহান শুধু বিস্ফোরিত নেত্রে তাকাল না, নিজের ব্যাপারে একটা বিস্ফোরন ঘটিয়ে বলল: আমি সাত দিন ধরে ট্রাফিক জ্যাম প্যারগ্রাফটা মুখস্ত করতে গিয়ে শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছি। এদেশের ট্রাফিক জ্যাম প্রবলেম দূর না হলে আমি আর ট্রাফিক জ্যাম প্যারাগ্রাফ পড়ব না।
আমরা কষ্ট করে হাসি চেপে রাখলাম। তাদের বাসায় মেহমান হয়ে এসেছি। তাকে বিব্রত করা ঠিক হবে না।
হেলাল ভাই প্রথমে আবৃত্তি করল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’। কবিতাটার মধ্যে রোমান্টিকতা আছে। আবার আছে দুঃখ, কষ্টের কথাও। হেলাল ভাই মধুমাখা কন্ঠের কারুকাজে দুঃখ, আবেগ, রোমান্টিকতা খুব নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।
সৈয়দা নার্গিস জাহানের ভীষণ মন খারাপ হল। সে দুঃখ মাখা কন্ঠে বলল: আচ্ছা, বরুনা কথা রাখল না কেন? কেউ কথা দিয়ে কথা না রাখলে আমার খুব মন খারাপ হয়।
হেলাল ভাই কী জবাব দিবে বুঝতে পারছিল না। সৈয়দ সাহেব বললেন: সে এসেছে আবৃত্তি শোনাতে। কবিতার ক্লাশ নিতে আসে নাই। দিন দিন তোমার মাথার নাট-বল্টু লুজ হয়ে যাচ্ছে। চুপ করে আবৃত্তি শোনো।
‘নাট-বল্টু লুজ হয়ে যাচ্ছে’-এ কথা শোনার পর আমরা তাকালাম বল্টুর দিকে। বল্টু লজ্জা পেয়েছে।
হেলাল ভাই নিশ্চয় বুঝল, দুঃখ আছে এরকম কবিতা আবৃত্তি না করে এখন একটা নিখাদ রোমান্টিকতার কবিতা আবৃত্তি করা দরকার। তাই সে আবৃত্তি করল জীবনানন্দের বনলতা সেন। তারপরই দেশ প্রেমের কবিতা জীবনানন্দের-আবার আসিব ফিরে।
আমরা সবাই মজে গেছি আবৃত্তির মাদকতায়। আমাদের রন্দ্রে রন্দ্রে রিনরিন করে বেজে যাচ্ছে কবিতার ছন্দ-গন্ধ-সুধা।
হেলাল ভাই তার মতো একের পর এক আবৃত্তি করে চলল-
রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর হাড়ের ঘর, হেলাল হাফিজের ফেরিওয়ালা, জীবনানন্দের সুরঞ্জনা, রবীন্দ্রনাথের ক্যামেলিয়া, বাঁশি, খোয়াই, সাধারণ মেয়ে, কাজী নজরুল ইসলামের বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি, শহীদ কাদরীর অভিবাদন, আরও অনেক। আবৃত্তির ফাঁকে ফাঁকে চা হল কয়েকবার।
রাত সারে নয়টায় ভাঙল আবৃত্তির জলসা। রাতের খাবার না খেয়ে তারা কেউ আমাদের ছাড়বেন না। আমাদের জন্য রান্না হয়েছে বিরিয়ানি। বিরয়ানির সাথে মুরিগর ঝাল ফ্রাই। সালাদ। তারপর মিষ্টান্ন। তারপর কোমল পানি। খাবার টেবিলে সৈয়দা নার্গিস জাহান ধপ করে বলল: হেলাল ভাই, আপনি এক কাজ করেন।
হেলাল ভাই মাথা নিচু করে খাচ্ছিল। ঝট করে মাথা তুলল। মাথা তুলে সৈয়দা নার্গিস জাহানের মুখে তাকাতে পারছিল না। ডান পাশের জানালায় তাকিয়ে রইল। তার চিবানো বন্ধ হয়ে গেল। মুখের ভেতর মনে হয় গরুর ছোট একটা হাড্ডি দিয়েছিল। সেটা মুখের বাম পাশে ডিমের মতো ফুলে রইল।
সৈয়দা নার্গিস জাহান বলল: হেলাল ভাই, আপনি একটা আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন।
আমরা জানতে পারলাম সৈয়দা নার্গিস জাহানের কাজের কথাটা। প্রস্তাবটা আমাদেরও মনে ধরল। সারাদিন মোজাফ্ফরের চায়ের দোকানে বসে টাইম কিল করি। ফাও তর্ক, ঝগড়া এসবই তো হয়। একটা আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করলে সময়টা ভাল কাটবে।
হেলাল ভাই কিছু বলল না। মিটিমিটি হাসল। সে হয়তো মনে মনে বলছে, আবৃত্তি সংগঠন চালাবার প্রস্তাব না করে যদি প্রেম প্রস্তাব করতে তো ভাল হত।
সৈয়দ সাহেব কিন্তু এবার মেয়েকে ধমক দিলেন না। মনে হল, প্রস্তাবটা তারও মনে ধরেছে। সৈয়দা নার্গিস জাহান বলল: আমাদের ছাদঘর ছেড়ে দিব আবৃত্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য। কোনো ভাড়া দিতে হবে না।
মেয়ের পাশাপাশি সৈয়দ সাহেবও বললেন: তুমি যদি আবৃত্তি সংগঠন দাঁড় করাতে চাও, তো নিয়ে নাও আমার ছাদঘরটা। আমি তোমার সংগঠনের একজন প্রশিক্ষণার্থী হব। তোমার মত তো আর আবৃত্তি করতে পারব না। তবে মাঝে মাঝে তোমার খালাম্মা আর খালাত বোনকে শোনাব।
: বাবা, তোমার আবৃত্তি আমি শুনব না। চট করে বলে দিল সৈয়দা নার্গিস জাহান।
সৈয়দ সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন: তুমি নিশ্চয় শুনবে?
: এতগুলো বছর ধরে তোমার কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত। আবার আবৃত্তি কেন?
: কেউ একটা কিছু চর্চা করতে চাচ্ছে। তাকে আগে থেকেই এভাবে হতাশ করে দেয়া কি ঠিক?
সৈয়দা নার্গিস জাহান বলল: বাবা, তুমি হতাশ হয়ো না বাবা। তুমি হেলাল ভাইয়ের কাছে আবৃত্তি শিখবে সেটা খুব ভালো কথা। তবে আমি তোমার আবৃত্তি শুনব না। আমি শুধু হেলাল ভাইয়ের আবৃত্তি শুনব।
‘ আমি শুধু হেলাল ভাইয়ের আবৃত্তি শুনব’-এই কথার মধ্যে আমরা কিসের একটা গন্ধ পেলাম যেন।
কোনো সংগঠন চালাবার ক্ষেত্রে স্থানটা প্রথম বিষয়। ঢাকা শহরে একটা খুপরি ভাড়া করতে গেলেও দশ/বারো হাজার টাকা গুণতে হয়। আমরা চাচ্ছিলাম, হেলাল ভাই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাক। কিন্তু সে মুখে কিছুই না বলে আবার খাওয়ায় মন দিল।
এক ফাঁকে সৈয়দা নার্গিস জাহান হেলাল ভাইয়ের ফোন নাম্বারটাও চেয়ে নিল। আমরা আশান্বিত হলাম। হয়ত অন্যরকম কিছু ঘটবে। সরাসরি সে ফোন নাম্বার চাইতে পারছিল না। তাই আবৃত্তি সংগঠনের প্রশংগ টেনে এনেছিল।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।