ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ১৭)

কিশোর উপন্যাস

ঢাকা টু মানিকগঞ্জ

১৭।।
চিত্রকলার ওপর?
: না। এডুকেডেট এন্ড মেরোটোরিয়াস ক্রিমিনাল চেনার ওপর।
আকমল ভাই দেখলেন, তার চিত্রশিল্পী পরিচয়টা বিশেষ গুরুত্ব পেল না। তাই দ্বিতীয় পরিচয় দিলেন: আমি একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা বিভাগের লেকচারার।
পুলিশ বলল: আমিও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের খন্ডকালীন লেকচারার। সপ্তাহে দুইটা ক্লাশ নেই।
: কী পড়ান আপনি?
: ক্রিমিনাল ল। বিশেষ করে জেন্টাল এন্ড এডুকেডেট পিপল যখন ক্রিমিনাল হয় তখন তাদের সাথে কেমন আচরণ করতে হয়-এসব পড়াই।
: আমি এজন চিত্রশিল্পী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তা জানার পরও আপনার মনে হচ্ছে আমি ক্রিমিনাল?
: পত্র-পত্রিকা পড়েন? অপরাধ থেকে কেউ-ই বাদ যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গায়ে হাত দেয়। আর মাদ্রাসার শিক্ষকদের কথা কি বলবো…..ওফ! কাউকেই ধোয়া তুলসিপাতা ভাবার উপায় নেই। নেমে আসুন নৌকা থেকে। না হলে কোমড়ে দড়ি বেঁধে, পাছায় বাড়ি দিয়ে নামাবো।
এরপর আর কোনো কথা চলে না। কোমড়ে দড়ি পড়ার আগে, পাছায় লাঠির বাড়ি পড়ার আগে নেমে যাওয়া ভালো।
মাহাবুব ভাই আস্তে আকমল ভাইয়ের কাছে সরে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন: এই যাত্রা রক্ষা পেলে তোর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবো না। পথে-ঘাটে দেখা হলে-‘কেমন আছিস, ভালো আছি’ এই সমাচার বার্তা শেষে কেটে পড়বো। তুই একটা কুফা।
: কুফা মানে কী?
: ডিকশনারি ঘেটে দেখ গিয়ে। এই সিচুয়েশনে তোকে ভাষা শেখাতে পারব না।
: আমি কী করলাম?
: তুই-ই তো যত পেজগির মূল। এসেছি মেয়ে দেখতে, মেয়ে দেখে চলে যাব। কী এত বাউল গান, বিশ্ববিদ্যালয় ভ্রমণ, নদী দর্শন! এবার জেলে বসে পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস লিখতে হবে।
: ওটা তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গেছেন, আমি আর কী লিখবো?
: তোর মতো পাতলা বুদ্ধির আর্টিস্ট উপন্যাস লিখতে পারবে না। তুই বসে বসে ওটা কপি করবি।
পুলিশ বললেন: আপনারা অযথাই সময় নষ্ট করছেন। আর বেশি সময় নিতে চাইলে আপনাদের বিপদ হবে। টাইম ইজ মোর ভেলুঅ্যাবল দ্যান মানি।
প্রথমেই লাফ দিয়ে নেমে গেল গুল্লু। পুলিশের সাথে যেতে ওর যেন কত আগ্রহ! তারপর নদু। তারপর একে একে সবাই। সবার শেষে নামলাম আমি। আমার আগে আকমল ভাই, আর মাহাবুব ভাই। পুলিশের ব্যাপারে আমাদের তিনজনেরই সমান ভয়।
নৌকায় বসে রইল দুই মাঝি। লম্বা ও পাতলা টিংটিং-এ চেহারার পুলিশটা বলল: আপনারা বসে রইলেন কেন? নেমে আসুন।
আমি প্রথম থেকেই ভাবছিলাম, এই লোক পুলিশে চাকরি পেল কেমন করে? কিন্তু কন্ঠ শুনে মনে হল সব ঠিক আছে। বেশ ভরাট, যাকে বলেদ জলদ গম্ভির কন্ঠ।
মাঝি দু’জন ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে। প্রবীণ মাঝি কাঁপা কন্ঠে বললেন: আমরা নামবো ক্যান? আমরা কী দোষ করছি?
: ক্রিমিনালদের নৌকায় আশ্রয় দিয়েছেন, আবার বলেন, কী দোষ করেছি।
: আমরা মাঝি। লোকে আমাগো নৌকা ভাড়া করলে আমরা ভাড়ায় চালাই। ভালো-মন্দ বিচার করা তো আমাগো কাজ না।
: এত প্যাঁচ দিয়ে কথা বলবেন না। যে মাইক্রোবাস করে ছিনতাই হয়, সে মাইক্রোবাসের ড্রাইভার দুধে ধোয়া তুলসী পাতা থাকে না। যে বাড়িতে জঙ্গিরা আশ্রয় পায় সে বাড়ির মালিক সাধু-সন্যাসী না। নেমে আসুন বলছি ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর……।
মাঝি দু’জন ভয় পেয়ে তাড়াহুরো করে নামতে গেল। যুবক মাঝি দ্রুত নেমে এলেও, বৃদ্ধ মাঝিটা পা পিছলে পড়ে গেল। তা দেখে ফেকু ফিকফিক করে হেসে উঠল। বৃদ্ধ মাঝি বললেন: মানুষের দুঃখ দেইখা হাসা ঠিক না।
লম্বা, পাতলা পুলিশ ফেকুকে বলল: তুমি ফিকফিক না করে তাকে হাত ধরে টেনে তোলো। ফেকু চুপসে গেল। কিন্তু পুলিশের আদেশ অমান্য করতে পারল না।
পুলিশদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে মাহাবুব ভাই বললেন: আপনারা কিন্তু রায় দিয়ে দিচ্ছেন যে, আমরা শিশু পাচারকারী।
বেঁটে ও মোটা পুলিশ বলল: সরি, এক্সটার্মলি সরি। বয়স্ক মাঝিটা অযথা ভ্যাজর ভ্যাজর করার জন্য তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। লম্বা এবং পাতলা মানুষরা সহজে রেগে যায়। মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে আমার মত মোটা মানুষরা।
লম্বা ও পাতলা পুলিশ গরম চোখে তাকালো বেঁটে ও মোটা পুলিশটার দিকে।
মাঝি দু’জন ভীষণ ঘাবড়ে গেছে। মুখ শুকনো। কিছুটা কাঁপছে যেন। পায়ে পায়ে বাড়ি খেয়ে পড়ে না যায়। গরিব মানুষ। এরকম পরিস্থিরি কথা কল্পনাও করেনি। বৃদ্ধ মাঝিটা আমার কাছে সরে এসে ফিস ফিস করে বলল: সত্যিই কি আপনাগো পাচারের জন্য আনছে?
আমি বললাম: ধুর! কী বলেন এইসব। চুপ করেন। দেখবেন কিচ্ছু হবে না। মাহাবুব ভাই আর আমরা একই পাড়ায় থাকি। আমাদের পাড়ায় মাহাবুব ভাইদের চারতলা বাড়ি আছে।
: আরেকজন?
: তিনি মাহাবুব ভাইয়ের স্কুল জীবনের বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ঘাবড়াবেন না। কিচ্ছু হবে না।
: তোমার সাহস দেখে মরি। এই বয়সে…..। পুলিশ কী জিনিস জানো?
লম্বা ও পাতলা পুলিশ ধমকে উঠল: চুপ, একদম চুপ! হাঁটতে হাঁটতে কোনো কথা বলা যাবে না।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।