ধারাবাহিক উপন্যাসে আবুল কালাম আজাদ (পর্ব – ৬)

কিশোর উপন্যাস

ঢাকা টু মানিকগঞ্জ

৬।।
কন্ডাক্টর বাসের গায়ে থাপ্পর মেরে বলল: ওস্তাদ নামবো।
খালাম্মা চিৎকার করে বললেন: ওস্তাদ নামবো মানে? বল মহিলা নামবে। এই দেশের পুরুষের নারীর প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধা একেবারে উঠে গেছে। যতই উন্নতি দেখাস, দ্যাশ উচ্ছন্নে যাবে।
কন্ডাক্টর বাসের গায়ে আরেকটা থাপ্পর মেরে বলল: ওস্তাদ, মহিলা নামবে।
গাড়ি থেমেছে। খালাম্মাও সহি সালামতে নেমেছেন। গাড়ি আবার চলতে শুরু করবে। তখনই আমার ডান দিক থেকে কে যেন চিৎকার করে বলল: এই গাব্বু, আমি ঢাকা যাচ্ছি। তুই কোথায় যাচ্ছিস? আমাদের বাড়িতে নাকি?
আমি চকিতে পাশ ফিরে তাকিয়ে এক ঝলক দেখলাম কঙ্কনা আপুর মুখ। সে বাস ছিল গতিশীল। আমাদের বাসও চলতে শুরু করলো।
আকমল ভাই বললেন: কে?
: কঙ্কনা আপু। তাকেই তো দেখতে যাচ্ছি মাহাবুব ভাইয়ের জন্য।
: বলিস কি! মাহাবুবের কপাল বলতে হবে।
: কেন?
: এমন সুন্দর মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মেয়ে দেখি। এর চেয়ে সুন্দর এই জীবনে একটাও দেখি নাই।
: কিন্তু সে তো ঢাকা যাচ্ছে। এখন কী হবে? এখন মাহাবুব ভাই গিয়ে কাকে দেখবেন? মাহাবুব ভাই এমন একটা মানুষ। সে যায় ডানে, তার কপাল যায় বামে।
মাহাবুব ভাই উঠে এসে আমার পেছনের আসনে বসলেন। বললেন: কী হয়েছে? আমার কপালের কথা বলছিলি যে?
আমি বললাম: কঙ্কনা আপু মাত্রই ঢাকা চলে গেল।
: তোকে ফোন করেছিল?
: না।
: তাহলে?
: বিপরীতগামী বাস থেকে ডেকে বলল।
: ফোন করে জিজ্ঞেস কর কবে ফিরবে।
আমি ফোন করলাম। কঙ্কনা আপুর ফোন বন্ধ। আমার মুখ দেখেই মাহাবুব ভাই সেটা বুঝে ফেললেন। বললেন: ফোন বন্ধ রেখেছে কেন?
আমি বললাম: সুন্দর মেয়েদের নিয়ে সমস্যা।
মাহাবুব ভাই রেগে উঠলেন: আমি জানতে চেয়েছি সে ফোন বন্ধ রেখেছে কেন? এখন যদি তার বাপ ফোন করে, যদি তার মা ফোন করে?
: ফোন যে বন্ধ রেখেছে তা বলা যাবে না। সুন্দর মেয়েরা এক সীম বেশিদিন ব্যবহার করে না। নতুন নাম্বার নিশ্চয় তার বাপ-মায়ের কাছে আছে।
: সুন্দর মেয়েরা ঘন ঘন সীম পাল্টায় এরকম কথা কখনো শুনিনি।
: নারী বিষয়ক অনেক কিছুই আপনি শোনেননি। জীবনে না করেছেন প্রেম, না করেছেন বিয়া।
: বেশি পাকামো করিস না। মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তোর মামাবাড়ি ফোন দে’। তারা নিশ্চয় জানেন, তাদের মেয়ে কবে ঢাকা থেকে ফিরবে।
আমি মামাবাড়িয়ে ফোন করতে যাচ্ছিলাম। মাহাবুব ভাইয়ের কথা তো ফেলতে পারি না। আদেশ করেন মহাশয়/ খাস দিলে তা মানতে হয়। কিন্তু আমাকে নিরস্ত করলেন আকমল ভাই। তিনি বললেন: তোরা অযথাই উত্তেজনা, উদ্বিগ্নতার মধ্যে যাচ্ছিস। স্থিরভাবে তোরা কিছু চিন্তা করতে পারিস না। নিশ্চয় সে কোনো কাজে গেছে। ছয় মাস থাকবে না। দু/এক দিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। তোরা বরং আজ আমার সাথে থাক।
মাহাবুব ভাই তাকালেন আকমল ভাইয়ের মুখে। তার চোখের মধ্যে প্রশ্ন ঝুলে গেল-তোর কাছে কই থাকবো?
আকমল ভাই চিত্রশিল্পী। মাহাবুব ভাইয়ের চোখের ভাষা বুঝে নিয়ে বললেন: এখানে আমার দুই কক্ষের একটা বাসা আছে। মাঝে মাঝে আমি এখানে দুই/চারদিন থাকি। কাল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়টা ঘুরে দেখিস। তারপর বিকেলের দিকে……। মানিকগঞ্জ যেতে কতক্ষণই আর লাগবে? না হয়, আমিও তোদের সাথে গেলাম।
আকমল ভাইয়ের প্রস্তাব আমার পছন্দ হলো। মাহাবুব ভাইও রাজি হয়ে গেলেন। মেয়ে দেখার মতো ব্যাপার। এখানে কিছু ছেলেপেলে নিয়ে যেতে কেমন লাগে। একজন সমবয়সী বন্ধু সাথে থাকলে ভালো হয়। বন্ধুতো যেনতেন কেউ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার এবং নামকরা চিত্রশিল্পী। আর মেয়েও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বিশেষ মূল্যায়ন পাওয়া যাবে।
গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে আকমল ভাইয়ের দুই কক্ষের বাসায়। তিনি আমাদের বাসায় ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন: তোরা বস, আমি আসছি……।
আমরা প্রথমে ওয়াশ রুমে গিয়ে শরীর ধুলাম। আমি যেহেতু ম্যানহোলের ঘূর্ণীতে পড়ে গিয়েছিলাম, আমি লাইফবয় গোল্ড সাবান মেখে গোসল করে ফেললাম। তারপর তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছে সুস্থির হয়ে বসলাম।
আকমল ভাইয়ের বসার রুমটা সুন্দর। বেশ বড় একটা রুম। সাথে একটা বারান্দা। দুইসেট সোফা। একটা আলমারি। বুকসেলফ। দেয়ালে নিজের আঁকা অসাধারণ কিছু ছবি। মেঝেতে কার্পেট। বারান্দায় ছোট একটা রাউন্ড টেবিল। তার চারদিকে চারটা চেয়ার। গ্রিলে বগেনভেলিয়া আর মানিপ্ল্যান্টের লতা। বারান্দার দুই পাশ ভ্যানগগের আঁকা দুইটি ছবি।
আকমল ভাইয়ের বাসাটা নিচ তলায়। কাছাকাছি বাড়ি নেই। সামনে খোলা জায়গা, সবুজ ঘাসে ঢাকা লনের মতো। তারপর ছোট একটা রাস্তা চলে গেছে হাইওয়ের দিকে। বাড়িটার চারপাশে বৃক্ষশোভাও মুগদ্ধকর।
মাহাবুব ভাই আমাকে বললেন: আকমলের পুরান ঢাকার সেই বাসাটার কথা তোর মনে আছে?
: মনে থাকবে না আবার? সে বাসার কথা এই জীবনে ভুলবো না। বিষ্ঠা না কিসে যেন পা পিছলে পড়ে যেতে লাগছিলাম। পেছন থেকে আপনি না ধরলে হাত-পা ভাঙতো, মাথাটাও ফাটতো।
: বাসাটা কেমন গুদামঘরের মতো করে রেখেছিল।
: সেটা ছিল মশা, তেলাপোকা আর ইঁদুরের অভায়রণ্য।
: সেই মানুষ নিজেকে কত সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে।
: এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তিনি।
: ওর মতো গোছালো জীবন-যাপন করতে ইচ্ছা করে।
: তিনি তো দুইটা মাত্র রুম গুছিয়ে নিয়েছেন। আপনি যে বাবার চার রুমের এক ফ্ল্যাট গুছিয়ে নিয়ে রাজার হালে আছেন।
: আমি যা বলতে চেয়েছি তা ধরতে পারিসনি।
: কী বলতে চেয়েছেন?
: বলতে চেয়েছি, বাবার আদোর, মায়ের স্নেহের বাইরে এসে আকমলের মতো এরকম একাকি থাকতে ইচ্ছা হয়।
: সেটা তো আপনি পারবেন না। যাচ্ছেন মেয়ে দেখতে। বিয়ে করে বউয়ের শাসনের মধ্যে গিয়ে নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবনে।
: শাসন আবার কী? ভয় দেখাসনে। মাঝে মাঝে মনে হয়, বিয়ে করলে জীবন ত্যজপাতা হয়ে যাবে।
: কারও কারও জীবন তো ত্যাজপাতা হয়ই। তবে কঙ্কনা আপুকে বিয়ে করলে তেমন হবার সম্ভাবনা নেই। নাটক করে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে থাকে। আপনার সাথে দারুন মিলবে।
: তোর কথা শুনে খুব ভালো লাগছে। মনে হয় তোর কারণেই আমার জীবনটা মধুময় হবে।
: সবই তার কারসাজি। আমি উছিলা মাত্র।
: সে কে?
: চিনি না।
আকমল ভাই এলেন। সাথে একটা ছেলে। ছেলেটা আমাদের চেয়ে বেশ বড়। তার দুই হাতে দুই ব্যাগ। ব্যাগ থেকে গুণে প্যাকেট বের করে নামাতে লাগলো।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।