সাপ্তাহিক ধারাবাহিক গল্পে আনোয়ার রশীদ সাগর (পর্ব – ৪)

দিদি ও চন্দ্রিমা

।৪।
আজ পূর্ণিমারাত। চাঁদ জ্যোৎস্না ঝলমলিয়ে পূর্ব আকাশ আলোকিত করে উঠে আসছে। আমরা উঠানেই বসে আছি।
পাড়াপ্রতিবেশীরা উঁকিঝুঁকি মারছে। ফিসফাস শব্দও কানে আসছে। কেউ বলছে শফিক বিয়ে করে আনলো নাকি,কেউ বলছে আগের বউডা আসিনি তো?
আমি দিদির সাথে কথা বললেও আমার কান খাড়া হয়ে আছে ওদেরই সাকিসুকির দিকে।
এরপর ধীরে ধীরে দুই এক পা ফেলতে ফেলতে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়ে কেউ কেউ। দাঁড়িয়ে থাকে ঘাড়ের উপর।
আমি ওদের জিজ্ঞাসা করি,কী ব্যাপার?
চাচাতো ভাবী সম্পর্কের একজন বলেই ফেলে,ব্যাপার তো তোমার কাছে।
দিদি শান্তভাবেই বলে,আমরা ওই যে পালবাড়ির মেয়ে। অনেক আগেই বাবা-মা’র সাথে শহরে চলে গেছি। দিদির কথা শুনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে সবাই।
এমন সময় ইউসুফ ভাইয়ের ছোটবোন আশান্নুরী এসে, দিদি ও চন্দ্রিমার মুখের দিকে বার বার তাকাতে থাকে।
তখন আমি পরিচয় করিয়ে দিই, এ হচ্ছে মালতি-দিদি আর ও চন্দ্রিমা।
ইউসুফ ভাইয়ের ছোট বোন আশান্নুরী, বয়সে আমার দু’এক বছরের বড়। ছোটবেলায় ওর সাথে তুই তুকারি করতাম। এখন আমার সাথে তুমি-আমি সম্পর্ক।
আশান্নুরী অনেক বুড়িয়ে গেছে। ভাগ্য ওকে বার বার বিড়ম্বনায় ফেলেছে। বিয়ে হয়েছিল পাশের গ্রামের এক মাস্টারের সাথে। দশ-বারো বছর সংসার করার পর স্বামীটা ক্যান্সারে মারা যায়। রেখে যায় এক ছেলে ও এক মেয়ে। দূর্ভাগ্যক্রমে মেয়েটা বাড়ির পাশের পুকুরে ডুবে মারা যায়। সে বছরই ইউসুফ ভাইয়ের ছোট ভাই ডিভি লটারী পেয়ে আমেরিকায় চলে যায়। এর দু’বছর পর ইউসুফ ভাইও চলে যায় আমেরিকায়।
দু’ভাই মা-বাবাকে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু পরের বছরই বাবা সর্দিকাশি জ্বর এবং ডায়রিয়া রোগ হয়ে মারা যায়। বৃদ্ধ মা একা থাকতে পারবে না,সে কারণে আশান্নুরীকে এ বাড়িতে নিয়ে এনে রেখেছে।
আশান্নুরী চন্দ্রিমার গালে-মুখে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে, কি সুন্দর হয়িছো গো! ছেলিমেয়ি কডা?
চন্দ্রিমা আশান্নুরীর কথা শুনে হাসে, বিয়ে হয়েছিল। সে হতভাগ্য আমাকে থুয়ে আর একজনকে বিয়ে করেছে। তাই দেশে চলে এসেছি-রে।
সব কপালে সুখ সয় না।
আশান্নুরী আঁচলে চোখ মুছতে থাকে চন্দ্রিমার কথা শুনে। বলে,আমারও এ দুনিয়ায় কেউ নেইরে! ছেলিডাও বাপের মত ক্যান্সার হয়ি মইরি গেল। এখন মা আর আমি থাকি এই বাড়িতে।
মালতি দিদি খুব আগ্রহী হয়ে ওঠে দাঁড়ায়, আশান্নুরী আমাকে চিনেছিস?
ভেজা গলায় বলে,কেন চিনবো না দিদি! তুমি তো আমাদের বড় বু।
মালতি দিদি আশান্নুরীকে জড়িয়ে ধরে আবেগে।
ইউসুফ ভাইয়ের খবর নিতে থাকে মালতি দিদি। আশান্নুরী খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সব বলতে থাকে। আমি ধীরে ধীরে চন্দ্রিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।আস্তে আস্তে বলি,আজ তোমার হাতের রান্না খাবো।
চন্দ্রিমা আমার চোখে চোখ রাখে,কোথায় রান্না করতে হবে,খড়ি দিয়ে না গ্যাসে?
আমি বলি,গ্রামেও এখন অনেকেই গ্যাসে রান্না করে। আর আমি তো একলা মানুষ,বউতাড়িত হতাগা একা-একা গ্যাসেই রান্না করি।
চন্দ্রিমা প্রসঙ্গ পাল্টায়, আচ্ছা তোমাদের সেই আটচালা টিনের ঘরটা আছে?
-পাগল নাকি! কুন্ আমলেই ভেঙে ফেলেছে। চারদিকে দেখছু না বিল্ডিং আর বিল্ডিং।
-ওই যে আটচালা ঘরের পূর্বদিকে একটা বড় পুকুর ছিল।
-সে পুকুরটা রয়েছে। তবে আগের মত গভীরতাও নেই,পানিও থাকে না সারা বছর।
-চলো না একটু পুকুরের ধারে যায়।
-সে তো বেশ দূরে। সকালে দিদিকে নিয়ে তিনজনে মিলে গেলেই হবেনি।
-এই চাঁদমাখা রাতে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
আমারও ইচ্ছে কম করছে না। সেই কিশোর বেলায় দু’জন পালিয়ে অনেক রাতে অনেক সময় ধরে গল্প করেছিলাম। মনে মনেই বললাম।
চন্দ্রিমা চাঁদের দিকে মুখ করে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে। চাঁদের সবটুকু আলো এসে পড়েছে ওর মুখে।

সমাপ্ত

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।