মেঘমল্লার কথার সারি -তে অর্ণব সাহা

বাবাকে নিয়ে লেখা কয়েকটুকরো

১|
ভেন্টিলেশনে যাবার দু’দিন আগে, তখনও জ্ঞান রয়েছে, মস্তিষ্ক সচল, অ্যাপোলো গ্লেনঈগলস-এর ২৬৭ নম্বর বেডে শুয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে এই কবিতা লিখে গেছে বাবা। সময় যে ফুরিয়ে আসছে, নিশ্চিত টের পেয়েছিল। আমার মেয়েকে আদর করে “সোনাই” বলে ডাকত বাবা।
সারাজীবন বিয়ে, অন্নপ্রাশন, হাউজিং-এর দুর্গাপুজো, বিবিধ অকেশনে কবিতা লিখত লোকটা। আমি পাত্তাও দিতাম না ওই সব অ্যামেচারিশ ছড়াকে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার ঢের আগেই পাখনা গজিয়েছিল আমার। বাবাকে অস্বীকার ও অতিক্রম করাই আমার জীবনধর্ম তখন। পিঁপড়ের পাখা উঠলে যা হয়, আমিও ছিলাম, এখনও আছি তাই। অক্ষমের আভাঁগার্দ মুখোশ এঁটে নিজের মিডিওক্রিটি প্রাণপণ লুকোতে চাইতাম। তাতেই কী আর চোখ এড়ানো যায়? আমি কৃতঘ্ন, পাপ সারা অঙ্গে। যে সম্মান ও মর্যাদা বাবা ডিজার্ভ করত, আমি তার কিছুই দিইনি। এই আক্ষেপ আমায় বাকি জীবন কুরে কুরে খাবে। কে বলতে পারে বাবার ওই অপটু হাতের কবিতাগুলোই আমার পরবর্তী যাবতীয় লেখালেখির জেনেটিক প্রেরণা কীনা! জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাবার যে অ্যাওয়ার্ডেড ডক্টরাল থিসিস বাঁধাই কপি হয়ে পড়ে আছে, সেটাই আমার যাবতীয় অ্যাকাডেমিক অনুসন্ধিৎসার প্রচ্ছন্ন উৎস কীনা! বাবার লেখা কবিতাটা তুলে দিলাম:
“সোনাই কোথায়? সোনাই কোথায়? ডাকে রাঙা
নদী।
একটিবার বারান্দায় তাকে দেখতে পেতাম যদি
প্রাণটা যেত জুড়িয়ে আর মনটা যেত ভরে
সোনাই তোমায় এই কথাটা বোঝাই কেমন করে?
সবাই থাকেন ব্যস্ত কাজে মার তো সময় নাই
দিদাবাড়ি আসবে তুমি কেমন ভাবে চাই?
তার-ছাড়া বীণ কেমন করে বাজায় মীরাবাঈ?”
রণজিৎ দাশের কবিতার লাইন বদলে লিখতে ইচ্ছে করে: “পিতার মুখাগ্নি করে সন্তানের অকৃতজ্ঞ হাত…”।
২|
বিষাদ! বিষাদ!
তোমার আগাছা-ঘেরা মর্গে আমি ঘুমিয়ে ছিলাম
নদীর জলের গন্ধ!
তোমার ভেতর থেকে জেগে উঠছি আবার আবার
আতরের শিশি তবু জ্বলে ওঠে শ্মশানে আমার
কাঁদে না কাঁদে না, দ্যাখো কাঁদতে নেই বিদায়ের
দিনে
একটি শোককবিতা কি লিখে উঠতে পারব না
হুজুগে ফাল্গুনে?
তুষার চৌধুরীর এই মারাত্মক কবিতাটা আজ ফিরে আসছে বারবার। আমি দমদমের যে বাড়িটায় বড়ো হয়েছিলাম, সেটা আমার ঠাকুমা স্বর্গতা জ্যোৎস্নারাণী সাহা-র নামে। ঠাকুরদা একটা শ্বেতপাথরের ফলকে বাড়ির নাম খোদাই করেছিল–“জ্যোৎস্নালয়”। খুব সাধারণ পরিবার ছিল আমাদের। ঠাকুরদা যৌবনে পাট আর কাপড়ের ব্যবসা করত। ওপার বাংলার যশোরে আমাদের আদি বাড়ি। স্বাধীনতার আগেই ব্যবসা-সূত্রে কলকাতায় চলে আসে ঠাকুরদা। এখানে বিচিত্র পেশায় যুক্ত ছিল। সিনেমা কোম্পানির ম্যানেজার, রোড কন্ট্রাকটরির বিজনেস। প্রচুর পয়সা রোজগার করলেও রাখতে পারেনি। প্রায়-নিঃস্ব হয়ে যায়। বাবাকে সংসারের হাল ধরতে হয় দ্রুত। বাবা প্রথম চাকরি পায় বেড়াচাঁপা পলিটেকনিকে। তখন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের অসম্ভব স্বাস্থ্যবান এক পুরুষ আমার বাবা। সেই শক্তিমত্তার পরিচয় খুব ছোটোবেলায় আমি পেয়েছিলাম দু’বার, আমার চার বছর বয়সে।
প্রথম স্মৃতি খুব ঝাপসা। বাবা আমায় পিঠে নিয়ে রাজগিরের পাহাড় বেয়ে উপরে উঠেছিল। আর দ্বিতীয় স্মৃতি আরো স্পষ্ট অথচ ভয়াবহ। সেটা সম্ভবত ১৯৮০। আমরা আসাম বেড়াতে গেছিলাম। তখন অগপ ও আসু সদ্য ‘বঙ্গালি খেদা’ আন্দোলন শুরু করেছে। নিউ বঙ্গাইগাঁও স্টেশন থেকে এক কুয়াশাচ্ছন্ন মাঝরাতে মেইল ট্রেনে চাপলাম আমি, মা আর বাবা। ট্রেনে অসম্ভব ভিড়। মা কোনোক্রমে ভিতরে ঢুকে গেলেও আমায় বুকে জড়িয়ে বাবা চলন্ত ট্রেনে ঝুলছে। খুব ঠান্ডা চারপাশ। এক সর্দারজি দয়াপরবশ হয়ে আমি-সহ বাবাকে টেনে ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়েছিল।
শেষ কয়েক মাস বাবার রোগজীর্ণ কাঠির মতো রোগা শরীর দেখে কান্না পেত। মনে পড়ত ছোটোবেলার কথা। ওই বিশাল স্বাস্থ্যবান লোকটাই কী আমার বাবা? যেন সেসব বিগত জন্মের গল্প।
কতোদিন দমদমের বাড়ির ছাদে বসে মুড়ি খেতে খেতে আমরা সুদূর আকাশের উল্কাপতন দেখেছি। বাবা বলত: “তারা খসা”। বলত, “বাপ্পা আমিও একদিন ওরকম দূরের তারা হয়ে টুপ করে খসে পড়ব এই পৃথিবী থেকে”। ঠাকুরদা মারা যায় ১৯৮৪ সালে। তারা হয়ে গেছে আমার ঠাকুরদা, আমি জানতাম। আর ফিরবে না।
আমার বাবাও তবে ওই সুদূর নীহারিকাপুঞ্জের থেকে খসে-পড়া একটুকরো ভ্রাম্যমাণ তারা? মৃত বাবার মুখটা হাঁ হয়ে ছিল। জল দিয়েছিলাম আমি। আমাদের দমদমের সাবেকি বাড়ি ‘জ্যোৎস্নালয়’ আজ আর নেই। পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে সেখানে। আমার লেখা একাধিক গল্পে এসেছে এই বাড়ির কথা।
আচ্ছন্ন বিষাদের স্তরের ভিতর, তুমি ঘুমিয়ে আছো বাবা। আমি, অক্ষম, কিচ্ছু-হতে-না-পারা তোমার বিষাদগ্রস্ত সন্তান, আজ এই কর্মস্থলের এক কামরার ঘরে একাকী বসে ভাবছি, তোমায় আর একটু ভালোবাসতে পারিনি কেন? কেন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলোয় তোমার একটাও পরামর্শ কানে নিইনি আমি? কেন? কেন?
সেদিন তোমার কথা শুনলে আজ নিজেকে অন্য মানুষের সামনে প্রতিদিন এতো ছোটো করতে হত না…
৩|
১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর আততায়ীর গুলিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর কংগ্রেসের পালে দেশব্যাপী বিপুল সহানুভূতির হাওয়া। পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে বিরাট সংখ্যক আসন পেল কংগ্রেস। আমাদের দমদম লোকসভা কেন্দ্রে জিতে গেল কংগ্রেসের আশুতোষ লাহা। বাবা-কাকার চোখে দেখেছিলাম চাপা আতঙ্ক। ওরা বোধহয় ভয় পাচ্ছিল আবার ফিরে আসবে বাহাত্তর থেকে সাতাত্তরের কংগ্রেসি সন্ত্রাসের দিন। যদিও সেটা আর সেদিন সম্ভব ছিল না। কিন্তু আমাদের শেঠবাগান-চাষীপাড়া-জপুর-লালগড়-পাতিপুকুর-বহিরাগত কলোনির প্রত্যেকটা ইঁটের টুকরোয় লেখা ছিল ৭০-এর শ্বেত সন্ত্রাসের আখর।
১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসেছে। ১৯৮২-তে শক্তি বাড়িয়ে দ্বিতীয়বার ফিরেও এসেছে তারা। কিন্তু আমাদের ওই এলাকায় কংগ্রেসি সমাজবিরোধী শক্তির দাপাদাপি বন্ধ হয়নি। ১৯৮৩ সালেই আমার ডিওয়াইএফআই-করা যুবকর্মী কাকাকে এক রাতে তুলে নিয়ে গিয়েছিল কংগ্রেসি গুন্ডারা। বেদম মারে চোখমুখ ফোলা, সারা গায়ে কালশিটে-পরা কাকাকে পরদিন যখন পাওয়া গেল তখন সে চলৎশক্তিহীন। ঠাকুর্দা-বাবা-লোকাল কমিটি মিলে পুলিশে পিটিশন দাখিল হল। ছেলেগুলো ধরাও পড়েছিল। এমনকী পরে আমাদের বাড়ি বয়ে এসে পাঁড় কংগ্রেসি ঠাকুর্দার কাছে ক্ষমাও চেয়ে যায় তারা। কিন্তু অলক্ষে, এলাকার বাম-রাজনীতির চেহারা বদলে যাচ্ছিল, আর সেটা খুব কম বয়সেই টের পাচ্ছিলাম আমি।
১৯৬৫, অর্থাৎ বিয়ের আগে থেকেই হাবড়া কামিনীকুমার উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষিকা আমার মা। যখন চাকরিতে ঢুকেছিল, তখন স্কুলশিক্ষকদের কোনো বেতন-কাঠামো ছিল না। মায়ের মাইনে ছিল ১৭০ টাকা। ১৯৭৭-এ বামফ্রন্ট আসার পর স্কুলশিক্ষকদের জন্য সুনির্দিষ্ট বেতন-কাঠামো চালু হয়। মাইনে বেড়ে যায় একলপ্তে। মায়ের তাই বামফ্রন্টের প্রতি ভক্তি ছিল অনেকটা অন্ধের মতো। বামফ্রন্ট শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির হেজিমনি তৈরি করল পাড়ায় পাড়ায়। পার্টির প্রত্যেকটা কমিটিতে তখন করনিক-শিক্ষক-অধ্যাপকদের আধিপত্য। অর্থাৎ পেটিবুর্জোয়া নেতৃত্ব। যা সিপিআইএম দলটিকে খুব দ্রুত একটি আপসমুখী সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট দলে রূপান্তরিত করল। পার্টির বিপ্লবী চরিত্র জাস্ট উবে গেল। সোশ্যাল ডেমোক্রেসির অনিবার্য ফল ‘অর্থনীতিবাদ’। মাইনে যতো বাড়ল, ততোই রাজনৈতিক চেতনার মান নামতে শুরু করল। পার্টির সর্ব স্তরে একধরনের সুখী, আত্মতৃপ্ত, কেরিয়ারিস্ট, আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্বের উদ্ভব ঘটল, যারা ১৯৯১-এর সোভিয়েত পতনের আগে থেকেই ছিল বুর্জোয়া ভাইসের শিকার। এরাই পার্টির নয়া-মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব। ১৯৮৭-৮৮ থেকেই আমাদের দমদমে পুরোনো কংগ্রেসিরা ঢুকতে শুরু করল সিপিআইএম পার্টির বিভিন্ন স্তরে। প্রোমোটার শ্রেণির পার্টির লোকাল নেতৃত্বে ঢোকার সেই শুরু। আপস আর আপস। বিদায় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন। কোনোক্রমে তিনটে রাজ্যে চিরস্থায়ী মৌরসিপাট্টা গড়ে তুলে পার্লামেন্টারি সুযোগ-সুবিধা দু-হাতে লুটেপুটে খাবার নিম্নমেধাভিত্তিক কেরানি-সমাজতন্ত্রের সেই শুরু। ১৯৯৩-এ জ্যোতি বসু যখন নয়া শিল্প-নীতি ঘোষণা করলেন, ততোদিনে পার্টির অভিমুখ বদলে গেছে। কমরেডরাও বদলে গেছে।
দমদমের বাড়ি ছেড়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বহুতলে ফ্ল্যাট কেনার যে দুর্মর বাসনা আমার বাবার মনে বাসা বেঁধেছিল, তাকে কমিউনিস্ট পার্টির এই পরিবর্তিত চেহারার সাপেক্ষেই বুঝতে হবে। ততোদিনে সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকদের মাইনে বেড়েছে। পাশাপাশি রমরমিয়ে বেড়েছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর প্রাইভেট টিউশনের ওপেন চোরাবাজার। এবিটিএ-র নেতা সন্ধেবেলা ব্যাচ বসাচ্ছেন সদ্য গড়ে-তোলা দোতলা বাড়িতে। সিপিআইএম নেতার ছেলেমেয়েদের দলে দলে ভর্তি করানো হচ্ছে প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। আস্তে আস্তে বাংলা মাধ্যম সরকারি স্কুলগুলোর অন্তর্জলি যাত্রার সূত্রপাত এখানেই। একটা সার্বিক স্থিতাবস্থার কাল। যখন পুঁজি-র সন্ধানে দেশে-বিদেশে ছুটছেন জ্যোতি বসু, মউ স্বাক্ষর করছেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, আপাদমস্তক সিপিআইএম বাড়ির ছেলে আমি প্রবল প্রতিক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়ছি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় ধারার বাম ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে। এ যেন পূর্বপুরুষের পাপমোচনের জন্য হাস্যকর এক মরীয়া প্রয়াস। এই যে শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে সিপিআইএম পার্টির বিচ্ছিন্নতা শুরু হয়েছিল, তার শেষ পেরেকটা পোঁতা হল সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে। গ্রামীণ ও শহুরে সাব-অল্টার্ন জনগণ পাশার দান উলটে দিলেন ২০১১ সালে। ৩৪ বছরের বাম-সাম্রাজ্যের পতন হল।
অথচ এরকমটা হবার কথা ছিল না। ১৯৮৯-এর জোট-রাজনীতির পালে হাওয়া লাগার সময়েই পশ্চিমবঙ্গ-কেরল-ত্রিপুরা বাদে গোটা দেশ থেকে ১১৭ টা এমএলএ সিট পেয়েছিল বামেরা। সেবার বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, আসাম থেকে প্রচুর বিধায়ক এমনকী বেশ কিছু সাংসদ পদেও জিতেছিল বামেরা। আইপিএফ তখন নতুন পথ দেখাচ্ছে। কিন্তু ১৯৯০ থেকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই পোলারাইজেশন চূড়ান্ত হল। পিছু হটল বামেরা।
১৯৯১। আমরা দমদম থেকে চলে আসব। বাড়ির পিছনের পাগলিপুকুর পেরোলেই কালিন্দি হাউজিং এস্টেট। ওখানেই ভাস্করদার ড্রয়িং ক্লাস: ‘কালি-তুলি-মন’, পৃথাদের বাড়ি, শহিদ ক্ষুদিরামের মূর্তি পেরোলেই হিন্দোলদের ফ্ল্যাট। আরো একটু পিছনে থাকেন পরবর্তী বাংলা নাটকের কিংবদন্তী ব্রাত্য বসু। শেষ দুজনকে চিনতাম না তখন।
আমাদের ৭৬ নং শেঠবাগানের জীর্ণ পুরোনো দোতলা বাড়িটা আর নেই। ফ্ল্যাট উঠেছে। পড়ে আছে পাগলিপুকুর আর সম্পূর্ণ বদলে-যাওয়া কালিন্দি হাউজিং, আমার অচরিতার্থ কৈশোরের স্বপ্ন বুকে নিয়ে…
৪|
আমাদের সাদার্ন এভিনিউ-এর হাউসিং-এ মোট ৪৪ টা ফ্ল্যাট। বাবার মৃত্যুর পর রাতে আমি আর বউ প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীদের বাবার পারলৌকিক কাজে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে ফিরলাম। বারোতলার উপর আমার শোকগ্রস্ত মা, একলা, অন্য দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে বিষণ্ন, বসে ছিল। ফেরতপথের ট্যাক্সি দ্রুত ছুটে যাচ্ছিল লেক রোড সিসিডি, আমাদের চেনা মাসকাবারি মুদির দোকান, সেলুন, ফুচকাঅলাকে ঘিরে একঝাঁক কিশোরীর কলস্বর, বুটিক, মেডিক্যাল স্টোর, অওধ ১৫৯০ পেরিয়ে। এই পৃথিবীর কোথাও কোনো বদল ঘটেনি। প্রাত্যহিক জীবন ছুটে চলেছে রোজকার গতিতে। সমস্ত কিছুই যেরকম ছিল, অবিকল একই আছে। কিচ্ছু বদলায় নি। শুধু আমার বাবার কোনো অস্তিত্ব নেই। আমার চোখ বাষ্পে ঝাপসা হয়ে এলেও বাবা আর ফিরে আসবে না কোনোদিন…
একটা অকিঞ্চিৎকর অতি তুচ্ছ মানুষের ততোধিক মানডেন জীবন। যার প্রতি আলাদা ভাবে দৃকপাত করার কথা মনে হয়নি কোনোদিন। অথচ, দৈনন্দিন জীবনের প্রাত্যহিকতায়, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের যুগপৎ সম্মিলনে যে জীবন খুব সামান্যও নয়। কবীর সুমনের সেই অনবদ্য গানের মতোই:
ওহে ও গেরস্ত, ভীষণ ব্যস্ত
একটু ভালো চা পাওয়া যায় কোন্ দোকানে
ওই সবজিঅলাই বন্ধু তোমার
সবুজ-বেচা মানুষ আসে তোমার টানে
ওই প্রতিদিনের বাঁচার লড়াই
গান বাজে তার গেরস্থালির তালে তালে…
যখন প্রথম আমরা এই বারো তলার ফ্ল্যাটে এলাম, বাবা-মায়ের তখন আর্থিক টানাটানি বিপুল। বিরাট অংকের হাউজলোন, সংসার সামলেও আমার টিউশন-খরচের চাপ নিতে কুন্ঠিত হয়নি। ওই বছর, ১৯৯১-এর অগস্ট-এ, গর্বাচভ-বিরোধী কট্টরপন্থীদের একটা জোট রাশিয়ায়, সমাজতন্ত্র টিঁকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। গেন্নাদি জুগানভ তখনও সিনে আসেননি। গর্বাচভ অন্তরীণ। আনন্দবাজারের ফ্রন্টপেজ হেডলাইন: “অগস্টেই অক্টোবর এলো? আলিমুদ্দিনে উল্লাস”। উল্লসিত আমার বাবাও। গর্বাচভ নামক এক সংশোধনবাদী মার্কিন এজেন্টের হাত থেকে পবিত্র সমাজতন্ত্র রক্ষার লড়াই তাহলে অব্যাহত রয়েছে। ক্রেমলিনের মাথায় ফের উড়বে লাল পতাকা। কিন্তু স্বপ্নবিলাসীদের ঘোর ভাঙল অচিরেই। ক্যু-দেতা ব্যর্থ। অভ্যুত্থানকারীরা গ্রেফতার। গর্বাচভ ফিরে এলেও কাঠপুতুল। এবার মস্কোর রাস্তায় ভারী সামরিক ট্যাংক টহল দিচ্ছে। প্রণয় রায়ের ‘ওয়ার্ল্ড দিস উইক’-এ দেখাচ্ছে, ট্যাংকের মাথায় উঠে প্রকাশ্যে সমাজতন্ত্র-বিরোধী শ্লোগান দিচ্ছে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির একদা মস্কো শহর-কমিটির সম্পাদক, বরিস ইয়েলতসিন। আর কোনো আশা নেই। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১ আনুষ্ঠানিক ভাবে চুরমার হয়ে গেল সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্র।
এক ভাঙাচোরা দিশাহীন সময়ের সন্তান হিসেবে বেড়ে উঠছিলাম। প্রথম সারির বাজারি কাগজগুলোয় তখন প্রবল সমাজতন্ত্র-বিরোধী কুৎসা। তাতে আমার বাবার মতো মানুষও প্রভাবিত হয়েছিল। আর আমি নিরালম্ব মুহূর্তের ভগ্নদূত, নিজের খেয়ালে বেড়ে উঠছিলাম। সংসার আর হাউজিং সোসাইটির কাজে ব্যস্ত মানুষ, আমার বাবাকেও একদিন বলতে শুনলাম, “বাপ্পা, বিশ্বায়ন খারাপ কিছু নয়। এটা নতুন মধ্যবিত্তদের ফ্লারিশ করার একটা সুবর্ণ সুযোগ। তুই ভালো করে পড়াশুনো কর, বিদেশ যা, অ্যাচিভ কর”। ওহ্! আমি দু-বছর আগেও কলকাতা থেকে ২০০ কিমি দূরের এক জেলার কলেজের অধ্যাপক। বিদেশেই তো থাকতাম বাবা। আমার কলজের টুকরো ছোট্ট মেয়েটাকে ফেলে রেখে, গোটা সপ্তাহের মিথ্যে ঘানি টানছি প্রতিদিন।
আমার বাবার মতো অর্ডিনারি লোককে নিয়ে কোনো গল্প হয়? রণজিৎ দাশের কবিতায় বাবা ছিলেন দূরের লোক-“যেমন, শহরের একটু দূরে থাকে পাওয়ার স্টেশন”। আমার পাওয়ার স্টেশনের জেনারেটর আজ মৃত। বাবার মৃত্যুর পর এক সন্ধেবেলায় দমদমের পুরোনো পাড়ায় যে মেয়েটিকে ভালো লাগত, তার সঙ্গে আকস্মিক দেখা হবার গল্প। জানি না, আমি কি পারব এই গল্প লিখতে?
তোমাকে নিয়ে অনেক কিছুই লিখব বাবা। তুমি বেঁচে থাকার সময় যে সমস্ত লেখার কথা কল্পনাতেও আনিনি কোনোদিন। তুমি অজানা নক্ষত্রলোক থেকে পোড়ো আমার সেই সব লেখা। পেপারকাটিং করে রেখে দিও।
৫|
“ভাবিলাম আমি নাজিরও হই নাই, সেরেস্তাদারও হই নাই, গ্যারিবল্ডিও হই নাই, আমি এক ভাঙা স্কুলের সেকেন্ড মাস্টার, আমার সমস্ত ইহজীবনে কেবল ক্ষণকালের জন্য একটি অনন্তরাত্রির উদয় হইয়াছিল–আমার পরমায়ুর সমস্ত দিনরাত্রির মধ্যে সেই একটিমাত্র রাত্রিই আমার তুচ্ছ জীবনের একমাত্র চরম সার্থকতা”–রবীন্দ্রনাথের ‘একরাত্রি’ গল্পের কথক সেই ভয়ানক ঝড়-জলের রাতে একটুকরো বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ভূমিখন্ডের উপর এতো কাছ থেকে সুরবালা-কে দেখতে পেয়েছিল। অথবা “তারাপ্রসন্নর কীর্তি”-র সেই ব্যর্থ, নির্বোধ, জাগতিক জ্ঞানশূন্য অসফল লেখক, যে তার সদ্য-জন্মানো কন্যাসন্তানের নাম রেখেছিল ‘বেদান্তপ্রতিভা’, এইসব মূলস্রোতের ভিতর বয়ে-চলা অপাঙক্তেয় মানুষরাই তো আমরা, যাদের জমাট, ব্যর্থ স্বপ্ন কৌটোবন্দী ভ্রমরের মতো ঝাপট মারে আজীবন, যারা জানে ‘ইতিহাস’ আসলে কতকগুলো মৃত গল্পের সমষ্টি, ‘মতাদর্শ’ আসলে হাত-উড়ে-যাওয়া মানুষের কাটা আস্তিন, যা গোটানোর চেষ্টা বৃথা, আমাদের কবন্ধ স্বপ্ন যেন এক ছিন্নমূল সময়ের উৎকীর্ণ, পাঠোদ্ধার-না-হওয়া লিপি, যারা শুধুই অন্ধকার আর বিষাদের সন্তান…
বিকেলের আলো ফুরিয়ে এলে কলেজ থেকে এক কামরার এই বাসায় ফিরে আসি, কলকাতা থেকে ২০০ কিমি দূরের এই কয়লাশহরেও সন্ধে নামে, মৃদু বিষণ্নতায় ছেয়ে যায় চারপাশ। মাথার ভিতর কুয়াশা ঘনায়। কবে কোন সদ্য-কৈশোরের অনিশ্চিত দিনগুলোয় ভাস্কর-দার ড্রয়িং ক্লাসের সেই মেয়েটিকে ভালো লেগেছিল, তার কথা মনে পড়ে যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তাল দিনগুলোয় স্ট্রিট-মিটিং করার সময় রাস্তায় ছুটে বেড়াচ্ছিল কতকগুলো বেওয়ারিশ পথশিশু, তাদের উজ্জ্বল মুখের হাসি মনে পড়ে। ১৯৯৯-এর মে-দিবস কাটিয়েছিলাম ট্যাংরার চামড়া-কারখানার বস্তিতে, সঙ্গে ছিল ‘নিউ ডেমোক্রেসি’ গ্রুপের বিশ্ববসু, যে আমার সঙ্গে চুলচেরা তর্ক করত ভারতীয় বুর্জোয়াদের চরিত্র নিয়ে, বিপ্লবের স্তর নয়া-গণতান্ত্রিক নাকী সমাজতান্ত্রিক তা নিয়ে। আমার মেয়ে জন্মানোর দিন কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, আরো অনেকগুলো বাচ্চার ভিতর ওর ওই ফুটফুটে মুখটাও এ জীবনে ভুলব না। ভুলব না আমার সেই নব্বই দশকের কবি-বন্ধুকেও, যার সঙ্গে ‘এই মৈত্রী এই মনান্তর’-এর পর্ব চলল দীর্ঘ দু’দশক, এবার দুজনেই ৪৩ পেরোব। আমার এই বাসাবাড়ির সামনের বিরাট অট্টালিকার গেটে যার নাম পাথরে খোদাই করা আছে, সে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে আমার জীবন থেকে।
কবীর সুমন তাঁর ‘আলখাল্লা’ বইতে লিখেছিলেন, ১৯৮৪ সালের বিপ্লবী নিকারাগুয়ার রাস্তায় খেলে-বেড়ানো সেই কিশোরের কথা, নাম জিগেস করায় যে জবাব দিয়েছিল “সোই লা রেভলুসিয়ন”, “আমিই বিপ্লব”। বলেছিলেন সারা দুপুর খদ্দের-না-পাওয়া সেই অলস দোকানির কথা, বিপ্লবের কোনো ছাপই যার জীবনে পড়েনি। আসলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জীবনে ‘গণবিপ্লব’-এর প্রায় কোনো প্রভাবই পড়ে না। সমস্ত ‘বিপ্লব’-ই আসলে মুষ্টিমেয় বুদ্ধিমান মানুষের ক্ষমতাদখলের খেলা মাত্র। তারাই বিজয়ী। আমরা চাঁদের উলটো পিঠে থাকা মানুষ।
এই তুচ্ছ, না-হয়ে-উঠতে-পারা মানুষের কথাই লিখে যাব আমার যৎসামান্য ফিকশনে। মার্জিনের-বাইরে-থেকে-যাওয়া পথচলতি মানুষের ভিতরেই যেন আমার গোটা অন্তরাত্মাকে মিশিয়ে দিতে পারি।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।