বছর তিনেক আগেকার কথা, আমার এতদিনে অনেকটাই ভুলে যাওয়া উচিত ছিল; কিন্তু পারিনি | একটা শব্দ, একটা দৃশ্যও ভুলতে পারিনি | সবকিছু সেই ঘটার মুহূর্তে যতটা জ্যান্ত ছিল, আজও ততটাই |
কিন্তু জীবন তো জীবনের মতো করে খাজনা নেবেই, তাই না ? আমার ক্ষেত্রেও নিয়েছে | ফিল্ম কিংবা টেলিভিশনের লাইনে আমার সমস্ত সম্ভাবনাকে তিলে তিলে মরতে দেখার পরও আমি তাই বেঁচে রইলাম | ঝুটো হয়ে গেল ওই সাউন্ড, লাইট, ক্যামেরা রোলিং, অ্যাকশন কিন্তু আগের থেকে আরও বেশি সত্যি হয়ে জেগে উঠল আমার পেটের খিদে | সেই খিদেকে কোনও ঘুমপাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়ানো যায় না, ঝুমঝুমি বাজিয়ে ভোলানো যায় না | যায় না বলেই আমি লাইন চেঞ্জ করলাম | চেহারার দৌলতে একটা চাকরিও জুটিয়ে নিতে পারলাম |
যেখানে মাথা কুটেও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারব না, সেখান থেকে সরে এসে সাধারণের পৃথিবীতে লড়ে বাঁচার যুদ্ধে নামলাম | এখানে লড়াইটা তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ | কারও মুখের কথায় কারও জীবন নষ্ট হয়ে যায় না |
চেহারার পাশাপাশি ওই সুন্দর করে কথা বলতে পারার ক্ষমতাটাও আমার কাজে লাগল এই নতুন চাকরিটার ক্ষেত্রে | ট্যুরিজমের ব্যবসা তো, এরা এমন লোক চায় যারা কিছুটা হলেও দর্শনধারী আবার একই সঙ্গে যাদের কথা বলে লোককে ইমপ্রেস করার ক্ষমতা আছে | আমি দু’দিক দিয়েই উতরে গেলাম এবং পিছুটান নেই বলে কাজও করতে লাগলাম নিজের সবটুকু দিয়ে |
সেই কাজের সূত্রেই এবার সিকিম আসা | পুজোর পরপরই যে ট্যুরটা হবে, সে ব্যাপারে আগে থেকে সব খোঁজখবর নিয়ে রাখা আমার উদ্দেশ্য | তাতে ব্যবস্থা করতে সুবিধে হয় | আরও একটা ব্যাপার অবশ্য আছে | এই টাফ কম্পিটিশনের বাজারে আমার কোম্পানি এমন সব নতুন ট্যুরিস্ট স্পটে ভ্রমণার্থীদের নিয়ে যেতে চায় যেখানে অন্য কেউ নিয়ে যাচ্ছে না | সেইসব নতুন স্পট, যার খবর এখনও অন্য কেউ রাখে না, খুঁজে বের করাটাও আমার কাজের মধ্যে পড়ে | আমি তাই উত্তর সিকিমের মাঙ্গান, চুংতাং, লাচেন আর লাচুং-এর এদিক-ওদিক চষে বেড়াচ্ছি ক’দিন ধরে। খুঁজে বেড়াচ্ছি, এমন দু’একটা স্পট যেগুলো সৌন্দর্যে তুলনারহিত কিন্তু খরচাপাতিতে সাধ্যের মধ্যে |
একটা জ্যাকপট মারতে পেরেছি বলেও মনে হচ্ছে | লাচুং-এর লাগোয়া তিনটে গ্রাম এবার আমার আবিষ্কার | গ্রামগুলোর নাম থোমচি, সিংগ্রিং আর বিচ্ছু | তিনটে গ্রামই দমবন্ধ করা সুন্দর | পাহাড়ি ঝরনা থেকে শুরু করে রডোডেনড্রন – কিছুরই অভাব নেই | আমি তিনটে গ্রামই দেখে-শুনে থোমচিকে বাছলাম আমার প্রথম টার্গেট হিসেবে | কারণ, থোমচিতে একটা বড় মনাস্ট্রি আছে যেটা দৃষ্টিনন্দন এবং দ্বিতীয়ত এখানকার বাড়িগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটাকে সরাইখানা হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যাবে |
ওই মনাস্ট্রি থেকে বেরোবার পথেই আমার কাঁধে একটা হাত পড়ল এবং আমি ঘুরে দাঁড়িয়ে যাকে দেখলাম, যমকে দেখলেও তার চেয়ে কম অবাক হতাম |
প্রতাপ সাক্সেনা একগাল হেসে বলল, কী করছ আজকাল ?
আমি অনেক কিছু বলতে গিয়ে সামলে নিলাম নিজেকে | বললাম, কিছু করার রাস্তা তো খোলা রাখোনি তাই ঘুরে বেড়াচ্ছি।|
– আমিও ঘুরতেই এসেছি, ইন ফ্যাক্ট রেস্ট নিতে এসেছি | চলো আমার ডেরায় চলো, একটা ড্রিংক হয়ে যাক | কতদিন পর দেখা, সম্পর্ক তো তোমার সঙ্গে আজকের নয়।
আমি ‘না’ বললাম, জোরের সঙ্গেই বললাম কিন্তু সেই বলার ভিতরে বোধ হয় ততটা জোর ছিল না নইলে প্রতাপ আমায় হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কী করে ? হতে পারে যে একটা অদম্য কৌতুহল আমাকে টানছিল | প্রতাপ নয়, সেই কৌতুহলের পিছুপিছু আমি গিয়ে হাজির হলাম একটা চমৎকার পাহাড়ি বাংলোর দোতলায় যেখানে প্রতাপের ছুটি কাটানোর সমস্ত ব্যবস্থা আছে আর সঙ্গে আছে ডোরা |
দু’পেগ খাওয়ার পর ডোরা বিছানা থেকে মাটিতে নেমে এসে বলল, আমিই তোকে লোকেট করেছি জানিস তো | তারপর প্রতাপকে বললাম তোকে এখানে ধরে আনতে | বিশ্বাস কর, এত ভালো লাগল তোকে আবার দেখতে পেয়ে। প্রথমটা অবশ্য খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে ভাবলাম, যাই হোক না কেন, তোকে একবার আমাদের এখানে নিয়ে আসতেই হবে।
– কেন, আর কী হিসেব-নিকেশ বাকি আছে আমার সঙ্গে তোদের এখনও? আমি ডোরার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করলাম।
– তুই ক্ষমা করে দে, প্লিজ আমাদের ক্ষমা করে দে | ডোরা ওর মুখে-চোখে একটা অনুতাপের ভঙ্গি ফুটিয়ে তুলল |সেটা যে নকল, তা হয়তো অভিনয় না করলেও বুঝতাম।
কোনও উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইলাম ডোরার দিকে | অনেকটা মোটা হয়ে গেছে, চেহারা আর অভিব্যক্তিতে ভালগারিটি আর ক্লান্তি একসঙ্গে ফুটে বেরোচ্ছে | মনে পড়ে গেল, সেই শ্যামলা রোগা মেয়েটাকে যার হাসি অন্ধকার আকাশে তারা হয়ে ফুটে উঠত।
– কী দেখছিস অমন করে? আমার ফিগার আর চাবুক নেই সেটা? ডোরা সেই আগের মতো করে চোখ নাচাল।
আমি ওর কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, তুই অভিনয় করিস না আর ?
– না | আমি এখন প্রতাপের প্রোডাকশন হাউসের সিইও | জাস্ট বিলো দ্য ম্যানেজিং ডিরেক্টর | ডোরা প্রতাপের দিকে তাকিয়ে হাসল |
– অ্যান্ড আই অ্যাম দি এম.ডি | প্রতাপ এক চুমুকে অনেকটা মদ সাবাড় করে বলল |
– তার মানে তুই প্রতাপের রক্ষিতা এখন ? আমি বললাম আর আশা করলাম যে ওরা রেগে যাবে |
কিন্তু ওরা দু’জনেই হেসে উঠল খুব জোরে | ডোরা বলল, তুই তোর বিয়ে করা বউকে সাতজন্মে সেগুলো দিতে পারবি যে সুখ, যে আরাম, প্রতাপ ওর রক্ষিতাকে দিতে পারে ?
– আমি বিয়েই করিনি |
প্রতাপ আর ডোরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল কথাটা শুনে | তারপর প্রতাপ বলল, শোন, আমার দুটো বউ | একটা বিয়ে সেই কোন ছোটবেলায় ইউ.পি-তে করেছিলাম ঠিক মনে নেই, আর তারপর এখানে আরেকটা | প্লাস আই হ্যাড লটস অব আদার উইমেন | স্টিল ডোরা আমাকেই ভালোবাসে | আর তুই শুধু ডোরাকেই ভালোবাসলি তবু ডোরা তোকে পাত্তা দিল না |
– শুধু ওটুকুই না, তোমাকে ডাউন করতে চেষ্টা করছিল বলে ওর পুরো কেরিয়ারটাই খতম করে দিলাম, সেটা বলো |ডোরা আধো-আধো গলায় বলল।
– সহি বাত ! প্রতাপ হেসে উঠল ডোরাকে জড়িয়ে ধরে |
– বাট আই ওয়ান্ট টু কমপেনসেট | আমার নতুন যে ফিল্মটা প্রোডিউস করছি, তাতে তোকে একটা ভালো রোল দিতে চাই রে | অলমোস্ট নেক্সট তো হিরো | তুই করবি তো ? ডোরা প্রতাপকে বড় একটা পেগ বানিয়ে দিয়ে নিজে একটা নিল তারপর আমার গ্লাসটা নিয়ে ভরে দিল আবার |
এবার আমি গ্লাসটা হাতে নিলেও ঠোঁটে ঠেকালাম না | জিজ্ঞেস করলাম, কিন্তু আমি যদি আবার প্রতাপকে ছাপিয়ে যাই ?
ডোরা আর প্রতাপ হেসে গড়িয়ে পড়ল কথা শুনে | একজনের শরীর আরেকজনের ওপর লুটোল আবার সোজা হল | তারপর আর একটু ঘন হয়ে বসল।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, কিন্তু আমার প্রশ্নটার উত্তর পেলাম না | যদি আবার প্রতাপকে ছাপিয়ে যাই ?
ডোরা বলল, আমার সাত পেগের নেশা কাটিয়ে দিলি তুই, এই একটা প্রশ্ন করে |
প্রতাপ বলল, আমার নেশা অবশ্য বাড়ল | তুম সোচো, ওর সবকুছ গেল লেকিন ঘমন্ড গেল না |
– অহংকার নয়, এটা অধীত বিদ্যা | যা ডোরা হারিয়ে ফেলেছে আর তোর কখনও ছিল না | বলে আমি গ্লাসের অর্ধেকটা ডোরার মুখে ছিটিয়ে দিলাম আর বাকি অর্ধেকটা প্রতাপের মুখে | দিয়েই একলাফে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি প্রায় টপকে নেমে এলাম নীচে |
নামতে নামতে যে কাঁপুনিটা টের পাচ্ছিলাম, বাংলোর বাইরের রাস্তায় পা দিতেই সেটা যেন দামামা বাজাতে লাগল আমার গোটা শরীরে | কী এমন নেশা করেছি যে আমার সর্বাঙ্গ কাঁপছে ?
তখনই চোখের সামনে বাংলোর অর্ধেকটাকে দেশলাই বাক্সের মতো চুপসে যেতে দেখলাম | আর মুহূর্তের মধ্যে শূন্যে ঝুলতে থাকা ব্যালকনিতে পা টেনে টেনে বেরিয়ে আসা ডোরার আর্ত চীৎকার কানে এল , বাঁচা, আমায় বাঁচা | আমি শুধু টাকার জন্য প্রতাপের সঙ্গে থাকি | আমি শিল্পী হতে চেয়েছিলাম, বেশ্যা নয় | আমায় ক্ষমা কর, আমায় বাঁচা, আমায় বিয়ে কর …
আমি কে জানে কোন অজানা মোহে এক পা, এক পা করে এগোতে যাচ্ছিলাম ডোরার দিকে কিন্তু তার আগেই পুরো বাংলোটা তালগোল পাকিয়ে বসে গেল মাটিতে | আর গড়াতে গড়াতে আসা একটা মস্ত পাথর আছড়ে পড়ল তার ওপর | এবার আর চীৎকার নয়, গোঙানি শুনতে পেলাম | সেটা ডোরা না প্রতাপের বুঝতেও পারলাম না ঠিকমতো | বোঝার সময়ও সেটা নয় কারণ আর একটা বড় পাথর আমার দিকেই এগিয়ে আসতে দেখলাম | আমি লাফ দিয়ে সরে গেলাম, যতটা পারলাম | তখন আমার পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে, বুক কাঁপছে, মাথা কাঁপছে, পায়ের নীচের পাতাল কাঁপছে, মাথার ওপরের আকাশও বোধহয় কাঁপছে | এটা কী হচ্ছে ? পৃথিবীর শেষের শুরু ?