ফিয়েট গাড়িটা একতলার জানলার ধারে দাঁড় হওয়া মাত্র পাড়ার অল্পবয়সী থেকে প্রবীণ সকলেই উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করল।ঘরের ভিতর থেকেই বুঝতে পারলাম কে এসেছেন।
আমাদের বাড়িতে যারাই আসতেন, তাদের নিয়ে একটা কৌতুহল ছিল পাড়ায়।এবং আমাদের নিজেদেরও।তার কোনও কারণ খুঁজে না পেলেও এটা বুঝতে পারতাম,যারা আসছেন তাঁরা সকলেই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে বিখ্যাত।
যেমন কোনও রাজনৈতিক নেতা এলে আগে পিছে তাঁর অনুগতরা আসতেন, প্রসিদ্ধ সাহিত্যিক এলে তাঁর সঙ্গে কিছু অল্পবয়সী সদ্য লেখালিখিতে যুক্ত দাদা দিদি,সবচেয়ে বেশি ভিড় হত কোনও অভিনেতা অভিনেত্রী এলে।তবে সেক্ষেত্রে একটা মজা ছিল। তাঁরা সচরাচর রাত বারোটার পর আসতেন,আর চলেও যেতেন ভোর হবার আগেই। কাজেই দিনের আলোয় তাঁরা এলে যতটা সমস্যা হত,তখন অতটা হত না।
আরেকটা মজা হল,তখন সাহিত্যিকদের ছবি ঘন ঘন ছাপা হত না,লেখককে পাঠক চিনতেন তাঁর লেখা দিয়ে।তাই বইমেলা চত্বর ছাড়া সাধারণ মানুষ অত চিনতে পারতেন না।
মা সবচেয়ে বিড়ম্বনায় পড়তেন,রাজনৈতিক নেতার আগমনে।বিশেষ করে সেন্ট্রাল থেকে কোনও ভি আই পি এলে তাঁর সাইরেন বাজানো গাড়ি,পুলিশের ঘনঘন আসা যাওয়ায় আমাদের ছোট্ট পাড়ার নিঃস্তব্ধতা ভঙ্গ হত।মা’ও তখন কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকাতেন।যদিও সে বিরক্তি কয়েক সেকেন্ডও থাকত না।কারণ মা বিয়ের পর থেকেই এই হই হট্টগোলে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলেন।
ফিয়েট গাড়ি থেকে নিজে নামতেন তিনি কে, এই প্রশ্ন পাড়ার লোকের মাথায় যত ঘুরত, আমাদের মাথায় তার থেকে কম কিছু ঘুরত না।
ভাবতাম তিনি বোধহয় বলিউডের কোনও বিখ্যাত নায়িকা।স্লিভলেস ব্লাউজ, সিফনের শাড়ি,কখনো বা শালোয়ার কামিজ,হাতে একটি হীরে বসানো ব্রেসলেট, ছোটো চুল,মোমের মত পিচ্ছিল শরীর,দুধের মতো গায়ের রং, অসাধারণ সুন্দরী সেই মহিলা নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে আসতেন।আটাত্তর ঊনআশি সালে, এই দৃশ্য দেখতে উত্তর কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পাড়া একেবারেই অভ্যস্ত ছিল না।
ভদ্রমহিলা সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের বলতেন,হ্যালো…হাউ আর ইউ…?
গালটা টিপে দিতেন,মিষ্টি করে হাসতেন,তারপর সিঁড়ি দিয়ে তিনতলার ছাদের ঘরে চলে যেতেন।আমাদের একতলার ঘরে বসার মতো কোনো জায়গা ছিল না।তিনতলার ছাদে ঘরটা বাবা বাড়িওয়ালার থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে করেছিলেন নিজের টাকাতেই।সেখানেই বাবা পুজো করতেন,কাকুরা রাতে ঘুমোতেন,অতিথি এলে সেখানেই বসতেন।
আমার তখন কাজ ছিল নিচ থেকে মা কোনও খাবার বানিয়ে দিলে দিয়ে আসা।অবশ্য হয়তো মিষ্টি বা জল এগুলোই নিয়ে যেতাম।চা,বা কোনও খাবার সচরাচর মা নিয়ে যেতেন।আমি তখন এতটাই ছোট যে ভারী কিছু বয়ে নিয়ে যাবার মতো ভরসা হয়তো মা করতেন না।
এই অবাঙালী মহিলা এলে তাঁর সঙ্গে আসতেন তাঁর স্বামী।তিনিও অসাধারণ সুন্দর, তবে বোঝা যেত তিনি বাঙালি। এবং এসে তাঁর স্ত্রী দু একটা কথা বলে ওপরে উঠে গেলেও,তিনি অনেকক্ষণ আমাদের সঙ্গে গল্প করতেন।এবং বাংলাতেই। অচিরেই তাঁর সঙ্গে আমাদের দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল।
মাঝে মাঝে তাদের গাড়িতে চড়ে আমরা আশেপাশে ঘুরতে যেতাম।
ঘুরে আসার পর বন্ধুরা জানতে চাইত,কোন ভাষায় কথা বললি?
কেন বাংলাতেই।
উনি বুঝতে পারলেন?
কে?
ওই সুন্দরী মহিলা।
তাঁর সঙ্গে আমাদের দোভাষীর কাজ করতেন সেই কাকু।কাজেই আমাদের কোনও অসুবিধা হত না।কিন্তু সে কথা না বলে একটু রহস্য রেখে বলতাম,হ্যাঁ।
অবশ্য তিনি ততদিনে বাংলা শিখতে শুরু করে দিয়েছেন। আমাদের সঙ্গে তাঁর সেই সদ্য শেখা – ক্যামন আছো?দিন কাল ক্যামন চলছে…স্টাডি করছ?…এসব বলছেন।
একদিন জানতে চাইলেন তোমরা কোন কারি পছন্দ করো?
কারি মানে কারি পাতা,ক্যারি মানে বহন করা।কিন্তু কোন কারি পছন্দ করি এ প্রশ্নের উত্তর কি দেব বুঝতে পারলাম না।
কিন্তু স্মার্ট ভাবে উত্তর দিলাম – সব কারি।
কিছু দিন বাদে নানান সাইজের টিফন কৌটোতে আসল কারি।মটন কারি,ফিস কারি,ফুলকপি কাজু কিসমিস দেওয়া বিরিয়ানি আর নানা রকম কাবাব।এর সঙ্গে রায়তা।
বুঝতে পারলাম কারি মানে তরকারি, মাংসের ঝোল,মাছের ঝোল।কিন্তু কোনও রান্নার স্বাদই বাঙালি খাবারের মতো নয়।
বাবা বললেন – এগুলো মহারাষ্ট্রিয়ান খাবার।
সত্যি বলতে কি আমাদের বাড়িতে যেহেতু গোড়া থেকেই একটা বিশ্ব সংস্কৃতি আর ভারতীয় ঐতিহ্যের পারস্পরিক সম্পর্ক জোরালো ছিল,এবং বহুজন হিতায় বিষয়টা ভীষণ ভাবে জড়িয়ে ছিল, তাই সব প্রাদেশিক রান্নার স্বাদই মোটামুটি পেতাম।কারণ যে বা যারাই আসতেন কিছু না কিছু বানিয়ে আনতেন।
বাবা খেতে যে খুব একটা ভালোবাসতেন তা কিন্তু নয়।
আমার কাকুরাই সেই সব খাবার চেটেপুটে খেয়ে মাকে বলত,বৌদি খেলাম বটে,কিন্তু মন ভরল না।দাও তো তোমার রান্না।
মা বলত,এই এত খেলি,পেটে ধরবে?
কাকুরা অম্লান বদনে বলত,তোমার হাতের রান্না না খেলে পেটই ভরবে না।
মা তখন সুন্দর করে যা রেঁধেছেন বেড়ে দিত।
তারাও মহানন্দে খেতে খেতে গান গাইত-
এমন রান্না এমন স্বাদ কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,সে যে আমার বৌদির রান্না, সে যে আমার বৌদি খালি…
যাহোক,এরপর ছত্রপতি শিবাজির বংশধর, মারাঠী মহিলা ক্রমশ হয়ে উঠলেন আমাদের সবচেয়ে কাছের কাকিমা। ক্রমশই নিঃসন্তান দম্পতীর আমরা তিন বোন হয়ে উঠলাম মেয়ে। তিনি কখন যেন মায়ের ঠিক পরেই আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
আর সেই কাকু হয়ে উঠলেন আমাদের তিনবোনের মেন্টর,প্রধান বন্ধু। বাবার পরেই অপরিহার্য হয়ে উঠল তাঁর সান্নিধ্য।
তেজস্বিনী নামে সেই মারাঠী মহিলা, পরবর্তী কালে কাকিমা- সেন মা একবার বলেছিলেন,জীবনে চলার পথে নানা বাধা আসে, উত্থান পতন ঘটে,কিন্তু দুটো জিনিস কখনো হারাবে না।নিজের প্রতি বিশ্বাস আর আত্মসম্মান।মানুষকে ভালোবাসবে,কিন্তু প্রতি ভালোবাসা আশা করবে না।গীতায় কৃষ্ণ বলেছেন,তুমি একা এসেছ,একাই যাবে,নিজের কাজটা মন দিয়ে করে যাও।ওটাই থাকবে।বাকি সব কালের স্রোতে ভেসে যাবে।