ক্যাফে ধারাবাহিকে বিতস্তা ঘোষাল (পর্ব – ৩৮)

কু ঝিক ঝিক দিন

৩৮

মহালক্ষ্মী দেবীর সবচেয়ে বড় কন্যা আমার দিদা।দিদা দাদুকে পাগলের মতো ভালোবাসত,আবার দাদুও দিদা অন্ত প্রাণ।
দাদুর কর্মস্থলের বাইরে পুরো জগৎটাই ছিল দিদাকে কেন্দ্র করে।রেলের টি টি ছিলেন তিনি।ডিউটি সেরে কোয়াটারে ফিরে হাত পা ধুয়ে জামা ছেড়ে সোজা রান্না ঘরে চলে যেতেন।সেখানে দিদা হয়তো রান্না করছে।
দাদু মাটিতে শতরঞ্চি পেতে বসে বঁটি নিয়ে কুটনো কাটতে শুরু করল,কিংবা রুটি পরোটা বেলতে লাগল।
দিদা চা জলখাবার দিয়ে সেখানেই বসে দাদুকে খাইয়ে দিতে লাগল।দাদু খেতে খেতে সারাদিনের গল্প দিদাকে বলল।
দাদুকে দেখে ভীষণ রাগী আর গম্ভীর মনে হত।কিন্তু দাদু যা কিছু সাংসারিক সিদ্ধান্ত দিদার থেকেই নিতেন।এমনকি বাইরের কোনো ঝামেলা বা অফিস সংক্রান্ত কোনও বিষয় দিদার সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করতেন।
দাদু বরাবর মনে করতেন দিদার থেকে ভালো ঘরনী হয় না।দিদার প্রখর বুদ্ধি, অসম্ভব ব্যক্তিত্ব দাদাকে মুগ্ধ করে রাখত।
দাদুকে রান্নাঘরে কাজ করতে দেখলে অবাক হতাম।আমার বাবা জীবনে কখনো রান্না করা তো বহুদূর,চা পর্যন্ত করে খায়নি।জলটাও তার হাতের সামনে দিতে হত।একবার মা আমাদের তিনবোনকে নিয়ে ঠাম্মার কাছে গেছিল।ঠাম্মা তখন অসুস্থ। ফলে বাবাকে একা থাকতে হয়েছিল।
পাশের বাড়ির কাকিমা আমরা ফেরার পর বলেছিলেন,ভাইতো তো কাজে একেবারে নিপুণ। ভাগ্যিস তুমি দেখতে বলে গেছিলে তাই জানতে পারলাম যে সে রান্নাতেও সিদ্ধ হস্ত।
মা শুনে দারুণ অবাক। কাকিমা হেসে বলল,ভাই আমাকে বলল,উনুন জ্বালিয়ে দিতে।আমি জিজ্ঞেস করলাম, রান্না করতে পারেন?
বলল,হ্যাঁ হ্যাঁ ভাত ডাল মাছ করে নেব।এ আর এমন কী কঠিন কাজ?
উনুন জ্বালিয়ে দিয়ে আমি চলে এলাম।যদিও একটা আশংকা হচ্ছিল।খানিকক্ষণ বাদে পায়ের আওয়াজ আর একটা গন্ধ পেয়ে তোমার ঘরে এসে দেখি ভাই ওপরে পুজো করতে চলে গেছে।ভাতের হাঁড়ি উনুনে ফুটছে।সেখান থেকেই গন্ধটা আসছে।
আমি ভাবলাম হয়তো জল নেই। তলা ধরে গেছে। ওমা!ঢাকনা সরিয়ে দেখি জলের তলায় একমুঠো চাল,আর মাছ,একসঙ্গে সেদ্ধ হচ্ছে। তাই অমন গন্ধ।
মা রান্নার রেসিপি শুনেই মুখটা কেমন করল।
কাকিমা বলল,আমি হাঁড়ি শুদ্ধু নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে নিজের রান্না দিয়ে গেলাম।আর এ কদিন আমিই রেঁধে দিলাম।ভাইয়ের দ্বারা কি এসব হয়?
বাবা অফিস থেকে ফেরার পর বাবাকে জিজ্ঞেস করল মা , হ্যাঁগো তুমি ভাত মাছ সব একসঙ্গে সেদ্ধ করতে দিয়েছিলে?
বাবা বলল,দিয়ে তো ছিলাম।পুজো শেষ করে নিচে নেমে রান্নাঘরে গিয়ে দেখি সে মাছ নেই। তার বদলে সরসে দেওয়া মাছ।
বদলে গেল কি করে?মা জানতে চাইল।
তাতো জানি না।আমি ভাবলাম সেদ্ধ মাছ এমনই হয়।তবে খুকু একটা জিনিস শিখলাম।
মা এরপরও বাবা কিছু শিখেছে শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল- কি?
বাবা বলল,রান্না করা এমন কোনও কাজ নয়।চালের মধ্যে সব ফেলে দিলেই নিজে নিজে হয়ে যায়।
তাহলে এ কদিন তুমি রান্না করেছিলে?
না।দিদি তো রোজই দিয়ে যাচ্ছিল।তাতেই হয়ে যাচ্ছে বলে আর করিনি। তবে তোমার হাতের রান্নার স্বাদ পাচ্ছিলাম না।
এসব শুনে মা হাসবে না কাদঁবে বুঝতে না পেরে শুধু বলল,তুমি তো আচ্ছা মানুষ! দিদি যে তোমার রান্না ফেলে দিয়ে অন্য রান্না দিয়ে গেছে,তোমার ভাত মাছ সেদ্ধ দিয়ে যে পচা গন্ধ বেরচ্ছিল তুমি কিছুই বুঝতে পারোনি?অদ্ভুত মানুষ তো তুমি!
দিদি তোমার কীর্তি দেখে ভাগ্যিস খাবার দিয়ে যাচ্ছিল।
বাবা অনেকক্ষণ বাদে বলল,আমি ভাবছিলাম আমার ভাত আর মাছ কিভাবে বদলে যায়!রোজ আলাদা রান্না কি করে হয়?আর কেই বা খাবার দেয়!
তারপর বলল,যাক,এখন আর এসব ভাবতে হবে না।তুমি এসে গেছ।আর চিন্তা নেই।
এহেন বাবাকে দেখে অভ্যস্ত আমরা অবাক হয়ে দাদুকে দেখতাম। একজন পুরুষ যে রান্নাঘরে এত কিছু পারেন সেটা
আমাকে বিস্মিত করত।
দিদা বলত,তোর দাদু তো মাসির কাছে মানুষ। মা বাবা ছিল না।মাসিই বড় করেছে।মাসিরও ছেলে পুলে ছিল না।তোর দাদু ছোট থেকেই হাতে হাতে কাজ করে দিতেন মাসির।তাই সব জানেন।তবে রান্না আমি করতে দিই না।নেহাত গল্প করার জন্য টুকটাক করে দিতে ভালোবাসে মানুষটা।সেই জন্য বাঁধা দিই না।যে যাতে শান্তি পায়।
দিদাকে জিজ্ঞেস করি,তুমি দাদুকে বেশি ভালোবাসো নাকি দাদু তোমাকে?
দিদা বলে,তোর দাদুর মতো বর পাওয়া আমার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য।
আমি বলি, কেন?এত খিটমিট করে, তাও তুমি তাকে ভালোবাসো?
হ্যাঁ, ভালো তো বাসিই,শ্রদ্ধাও করি।এমন বড় মনের মানুষ যদি সব মেয়েরা পেত তবে মেয়ের মায়েদের চোখের জল ফেলতে হত না।
আমি আশ্চর্য হয়ে যাই।মনে হয় শরৎরচনাবলীর থেকে উঠে আসা কোনো নায়িকার মতো দিদা ডায়লগ দিচ্ছে।
দিদা বলে,আমার তো গায়ের রং একটু চাপা।তাছাড়া বাপের পয়সাও কম,ফলে বিয়ে হতে দেরি হচ্ছিল। তারপর তোর দাদুর সঙ্গে সম্বন্ধ হল।দাদু তো আমাকে প্রথমে দেখেনি।তার মাসি,মেশো দেখে গেছিলেন।তা একে বয়স বেশি, তার ওপর গায়ের রং ফরসা নয় তেমন,তাই তারা বেশ ভালো মত গহনা আর যৌতুক চেয়েছিলেন।
কালো বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে পাড় করতে হবে বলে মা রাজি হয়ে গেলেন।
দিদাকে থামিয়ে প্রশ্ন করি,তুমি কালো?
হ্যাঁ, সেই সময় আমার মতো রংকে কালোই বলত।আর তোর দাদু তো ধবধবে সাদা,তোর মায়ের মতো।খুখু একেবারে তার বাবার গায়ের রং পেয়েছে।
আমি ভাবি তাহলে আমার গায়ের রংকে কি বলবে লোকে?কালো?আমার দুই বোনের তুলনায় তা অনেকটাই চাপা।বাবা বলত,দৌপদীর মত গায়ের রং আমার।দৌপদীর রং কেমন ছিল চোখে দেখিনি।কিন্তু জানতাম ফর্সা নয়।বরং নীল বা কালোই।তাকে শ্যামবর্ণ বলা হয়। আমিও তাই তাহলে এভাবেই নিজেকে স্বান্তনা দিতাম।
দিদার রং কালো শুনে নিজের দিকে একবার তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করি, তারপর কি হল?
দিদা বলে,কথা ছিল নগদ পঞ্চাশ টাকা আর দশ ভরি গহনা দেওয়া হবে।মা চেয়ে চিন্তে কিছু যোগাড় করলেন।ঠিক হল মায়ের বাপের বাড়ি থেকে বাকিটা বিয়ের দিন সকালে মায়ের ভাই, আমার মামা নিয়ে আসবেন।
সেই মতো প্রস্তুতি নেওয়া হল।যথাসময়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম।হঠাৎ দেখি মেশো শ্বশুর প্রচন্ড চিৎকার করছেন আর তোর দাদুকে বলছেন পিঁড়ি ছেড়ে উঠে যেতে।
কি না!টাকা ও গহনা কোনটাই পরিমাণ মতো দেওয়া হয়নি।
আমার মনের মধ্যে তখন নিরুপমার গল্প ঘুরছিল।তাকিয়ে ছিলাম দিদার মুখের দিকে।
দিদা যেন বুঝতে পারল,আমি কি ভাবছি!বলল,না, আমার পরিনতী নিরুপমার মতো হয়নি।তোর দাদু সে সময় একটা সাংঘাতিক সাহস দেখিয়েছিলেন। তিনি পিঁড়িতে বসেই বললেন,আমি বিয়ে করতে এসেছি,পাওনা-গন্ডা নিতে নয়।আজ আমি যদি মন্ডপ ছেড়ে চলে যাই মেয়েটা লগ্ন ভ্রষ্টা হবে।আর কোনওদিন এ মেয়ের বিয়ে হবে না।তারপর যদি কোনও অঘটন ঘটে তার দায় কে নেবে?
তাছাড়া আপনারা আপনাদের পুত্র বধূ নিতে এসেছেন। আমি তাকে নিয়েই ফিরব।
তারপর?আমি অবাক হচ্ছিলাম দাদুর প্রতিক্রিয়া দেখে।দেনা পাওনা গল্পের প্রতিটি লাইন চোখের সামনে ফুটে উঠছিল।আমি ছোটো থেকেই এসব পড়তে ভালোবাসতাম।ফলে এই চরিত্র গুলোর করুণ পরিনতী আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখত দীর্ঘ সময়।
দিদা বলল,তারপর আর কি!বিয়ে করে তবে পিঁড়ি ছাড়লেন তিনি।
আর দাদুর মেশো?
দীর্ঘদিন কথা বলেননি।মাসি অবশ্য আমাকে বরণ করেছিলেন। প্রথম দিকে খুব কথা শোনাতেন।তারপর তোর দাদু নিজের রোজগারের টাকা থেকে গহনা ও বকেয়া অর্থ মেশোর হাতে তুলে দিলেন আমার মায়ের নাম করে।
আমিও মুখ বুজে সব অপমান সহ্য করেছি। আর প্রাণপনে ওদের সেবা করেছি। একসময় ওরাও মেনে নিল আমাকে।আর বয়সকালে তো আমাকে আকঁড়েই বেঁচে ছিলেন।
কিন্তু তোর দাদু যেভাবে এক বিধবা মায়ের চোখের জল মুছিয়ে ছিলেন তাকে শ্রদ্ধা করব না?তিনি তো মানুষ হয়েও ভগবানের মতো কাজ করেছেন।আমার ভগবান তাই তিনিই।
আমি সেই মুহূর্তে আমার প্রচন্ড রাগী দাদুর মাথার ওপর একটা সুদর্শন চক্র ঘুরতে দেখলাম।সেই চক্র দিয়ে তিনি সেই সব লোভী মানুষের মুন্ডুচ্ছেদ করছেন যারা পণের জন্য ছেলের বউকে অত্যাচার করে,বিয়ে ভেঙে দেয়।মনে হল আমাদের সাহিত্য কেন দাদুর মতো প্রতিবাদী চরিত্র লেখা হয় না?সবই কেন আপোষের গল্প?আমি যদি কখনো বড় হয়ে লিখি আমার গল্পের নায়ক দাদুই হবে।সব্যসাচী মতো তার একহাতে থাকবে চক্র,একহাতে গদা।(গদাটা সিম্বলিক,আসলে থাকবে বন্দুক) যেখানেই এমন ঘটনা ঘটবে সেখানেই অরণ্য দেবের মতো পৌঁছে যাবে।হাজার হাজার অসহায় দুঃখী মেয়ের মা বাবার মুখে হাসি ফুটবে।
পাশাপাশি এটাও মনে হত তাহলে কি দাদু দিদাকে একা রেখেই দেশ উদ্ধারে নেমে পড়বেন?সব্যাসাচী উপন্যাসের নায়কের মতো?
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।