এই যে অনন্ত আলোর বিচ্ছুরণ, তারপর আবার রাত নামে,তখনও কিন্তু অন্য গোলার্ধে আলো। মানে পৃথিবী কখনো আলোকহীন নয়।বলতো এসব কার খেলা?
প্রশ্নটা করে নদীর দিকে তাকিয়ে আপন মনে বিড়ি ফুকঁতে লাগল করিম চাচা।
খানিক বাদেই আবার বলল- এসবই হচ্ছে আল্লার শক্তি।সবই তাঁর মায়া।
করিম চাচা নৌকা চালায়।তার সুচালো দাঁড়ি,আর শীত গ্রীষ্ম বর্ষা মাথায় একটা কালো রুমাল বাঁধা।
গায়ে ফতুয়া কিংবা স্যান্ডো গেঞ্জি আর চেক চেক নীল অথবা সবুজ ঘেঁষা কোনও লুঙ্গি।
রোগা চেহারার মানুষটাকে দেখে ভাবাই যায় না সে দাঁড় বাইতে পারে।
করিম চাচার মুখের দিকে আমি অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম।
চাচা বিড়িটার শেষ অবধি টেনে ফেলে দিল।তারপর বলল,এই যে নদী দেখছিস,এতে কত ঢেউ আসে যায়,পাড় থেকে যখন নৌকা বাওয়া শুরু করি তখন বেশ জোর লাগে।অথচ মাঝনদীতে পৌঁছে গেলে নৌকা দিব্বি তড়তড় করে চলে।গতি নিজের মতোই তখন তাকে নিয়ন্ত্রণ করে।আসল বিষয় হল মনটাকে এইভাবে আয়ত্তে রাখা।একবার যদি পোষ মানাতে পারিস তবে আর ভাবনা নাই।
এত সব আমি বুঝি না।তুমি কি এখন ওপাড়ে যাবে?
আমার তখন উল্টো দিকের ফেরি ঘাটে যাবার ভীষণ ইচ্ছে।তবে নামব না।ফিরতি নৌকাতে চাচার সঙ্গেই আবার এপাড়ে চলে আসব।নৌকার দুলুনি,বিভিন্ন মানুষের টুকরো টুকরো কথা আর করিম চাচার গান মুড ভালো থাকলে শোনার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
করিম চাচা যে সবসময় জিয়াগঞ্জই যায়,তেমন নয়।অনেক সময় আমাকে নিয়ে বড়নগরও গেছে। যাত্রী ছাড়াও গেছে, হয়তো খালি আমিই। এবং আমার জন্য যেতে বাধ্য হয়েছে।
চাচা উঠছে না দেখে আমি উঠে পড়লাম ধার থেকে।লাফিয়ে নামলাম নৌকায়।দাঁড়টা হাতে নিলাম।তারপর ভয় দেখানোর ভঙ্গিতে বললাম- যাবে?নাকি আমি একাই চলে যাব?
পাড়ে বাঁধা আরেক নৌকার ফুল কাকা বলে উঠল- মুনাইয়ের মাথায় কিন্তু ছিট আছে।করিম যা নিয়ে,নইলে এ মেয়ে একাই নৌকা ছাড়ি দেবে।
করিম চাচা যেন সে কথা শুনতেই পেল না।কিংবা শুনেও না শোনার ভান করল।যেখানে বসে ছিল সেখানে বসেই বলল-
দিন রাত চড়ে বেড়াস কেন?থিতু হতে পারিস না? তোকে নিয়ে বড়দার তো মহা বিপদ।আল্লার যে কি ইচ্ছা তোকে নিয়ে কে জানে!
আল্লার আবার কি ইচ্ছে? এখন আমার ইচ্ছে তুমি নৌকা ছাড়বা।দেরি হলে ছোটকা ফিরে যাবে কোর্ট থেকে।আমি তখন বকুনি খাব।
খাবা তো খাবা।এমন দস্যি মাইয়ার বকা খাবাই উচিত।
এসব কথার মাঝেই ফুল কাকা উঠে গিয়ে আলুর চপ আর ফুলুরি নিয়ে এল।ইদিকে আয়।লে খেয়ে লে।তারপর যাবি।
আমি সেই ঝাল চপ খেতে খেতে বললাম- তোমার আল্লার ইচ্ছেয় যদি সব কিছু হয় তবে কেন তুমি মাঝি!আর আমি কেন এতবার তোমাকে বলা সত্বেও তুমি বৈঠা ধরছ না? তোমার আল্লা কি চান না আমি এখন ওপাড়ে যাই?
করিম চাচা বলল,হতেও পারে।তাই আজ হয়তে আমার গা ম্যাজ ম্যাজ করছে।তবে আল্লা চাইলে…
আমি বললাম,আল্লার ইচ্ছায় যখন সব হয় তখন আল্লাই আমাকে আজ ওপাড়ে নিয়ে যাবে।তুমি পাড়ে বসে দেখো।আমি চললাম।
করিম চাচা লুঙ্গি গুটিয়ে এক লাফে নৌকার পাটাতনে নেমে এল।তারপর নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল- আল্লা এ মাইয়ার সুমতি হোক।তাড়াতাড়ি কলকাতা ফিরে যাক।নইলে মহা মুশকিল। শান্তিতে বিড়িও খাতি দেবে না,তোমারে ডাকতেও দিবে না।
আমিও ততধিক গম্ভীর মুখ করে বললাম- হে আল্লা,তুমি তোমার এই অবোধ পোলারে হুকুম দাও,এখনি পাল তুলতে।আমার মেলা কাজ পড়ে। মিছিমিছি সময় নষ্ট হচ্ছে।
আমাদের এই ঝগড়া অনন্ত কাল চলত,যতক্ষণ না নৌকা চারদিক ঘুরে আবার আমাকে পাড়ে নামিয়ে দিত।করিম চাচা বলত- মা গঙ্গা একে রক্ষা করো।মূর্তিমান বিচ্চু এ মাইয়ারে লয়ে বড়দার সমুহ বিপদ।
আর আমি বলতাম- হে আল্লা করিম চাচারে রক্ষা কোরো।সবই তো তোমার লীলা।
করিম চাচা একদিন বলেছিল,আমার সুফি হবার মন ছিল।হলাম না।কিন্তু যেদিন ডাক আসবা চলে যাব।আর থাকবনি।
সেই দিন বাড়ি ফিরে বারান্দায় বসে অন্ধকারে তারায় ভরা আকাশ দেখতে দেখতে আমি ভেবেছিলাম, করিম চাচার যেদিন সুফি হবার ডাক আসবে আমিও সেদিন সুফি হয়ে তার সঙ্গী হব।সুফি হলে আর ফিরতে হবে না কলকাতায়। বহুদূরে কোনও এক গাছ তলায় বসে আপন মনে সাধনা করব।শেষ পর্যন্ত সাধনাতেই মুক্তি।বাকি সব করিম চাচার কথায় – মায়া।