নৈবেদ্যে বেদশ্রুতি মুখার্জী – ১

ভোজনরসিক বিবেকানন্দ – ১

মানুষ বড়ই অসহায় প্রাণী, অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের মতোই তার অন্যতম প্রধান চাহিদা হলো এক টুকরো আলোর সন্ধান, সে চায় তার হাতটা ধরে কেউ চলুক, প্রবল জ্বরে মাথায় জলপট্টি করুক প্রিয় কেউ। আর পরাধীনতার প্রবল দুর্দিনে যখন মননশীলতার দৈন্যে গোটা বাঙালি জাতি তথা দেশ অন্ধকারে নিমগ্ন, সেই সময় যে গেরুয়াধারী যুগপুরুষ আলোর দিশারী হয়ে সমগ্র জাতিকে উদ্ধার করেছিলেন, করেছিলেন বিবেকবদান- তিনিই যুগপুরুষ বিবেকানন্দ… আজ তাঁর জন্মতিথি, গোটা দেশে সাড়ম্বরে পালিত হচ্ছে।দিনটি, ঘোষিত হয়েছে জাতীয় যুগ দিবস, রাজ্যেও এই দিনে স্কুলে স্কুলে ব্লকে ব্লকে শুরু করা হয়েছে বিবেব চেতনা উৎসব, সবই সেই ক্ষণজন্মা সদা হাস্যময় যুগপুরুষের অবদান স্মরণ করে। কিন্তু চোখ বুজে সেই মহাপুরুষের মুখ মনে করলেই আমার ভীষণ কাছের, ভীষণ প্রিয় এক উদাসীন সন্ন্যাসী নয়, বরংচ তীব্র জীবনরসিক, ত্যাগী গুণী পণ্ডিত দুর্লভ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যাঁর কাছে বেদান্ত এবং বিরিয়ানি একইসাথে সমাদৃত… যুগপুরুষ বিবেকানন্দ, তাঁর দর্শন, অবদানকে নিয়ে নতুন করে আমার মতো আনকোরা লিখিয়ের কিছু বলা শোভা পায়না। তাইতো বিবেকানন্দের খাদ্যরসিকতা নিয়ে একটুখানি আলোকপাত করা যাক। ৫ই জানুয়ারি, ১৯০০ লস এঞ্জেলেসের ‘দ্য ওপেন সিক্রেট’ বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন-“কতবার আমি অনাহারে, বিক্ষতচরণে, ক্লান্ত দেহে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছি, কতবার দিনের পর দিন এক মুষ্টি অন্ন না পেয়ে পথচলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে… আর ওমনি মনে এই ভাব উঠত- আমার কোনো ভয় নেই, মৃত্যুও নেই, আমার জন্ম কখনো হয়নি, মৃত্যুও হবেনা, আমার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, সোহহম্ সোহহম্”… অনাহারকে, ক্ষুধাকে এভাবে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে যে ক্ষণজন্মা দেশের জন্য, জাতির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন, তিনিই বিবেকানন্দ, আবার অনাহার অর্ধাহারে দিনের পর দিন থাকা এই মানুষটিই কিন্তু খেত অসম্ভব ভালো বাসতেন। ছোট্ট নরেন নাকি বসে থাকতেন জাল ফেলা দেখতে, মার কাছে ছুটতে ছুটতে আসতেন বড় মাছটির মুড়োটার জন্য শীতের ভোরের কুয়াশার মতোই আদরমাখা মিষ্টি আব্দার নিয়ে। যে সংসারে বিলে বা নরেনের জন্ম, তাকে সোনার সংসার বললে অত্যুক্তি হয়না, বাবা বড় ব্যারিস্টার, অভাব কিছুই নেই, সুতরাং খাদ্যরসিকতা সেই থেকেই শুরু। ভোগ আর ত্যাগ একই কয়েনের পিঠমাত্র, সত্য সন্ধানী, পূতচরিত্র এই সন্ন্যাসীর শৈশব আর পাঁচটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের শিশুর মতোই শুরু হয়েছিল, বৈঠকখানায় জাতপাতকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে হুঁকো টানাই হোক কিংবা রায়পুরের রাস্তায় পাঁঠার মাংস রান্নাই হোক, নরেন ছিলেন সবেতেই সপ্রতিভ। ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথের বিবরণীতে পাই- “তখন কলকাতার রাস্তায় পাঁঠার দোকানে মুড়ো বিক্রি হতোনা, দাদা পাঁঠাওয়ালার সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন, দুই চার আনায় দশ বারোটা পাঁঠার মাথা জোগাড় হতো। সেসব মুড়ো ও সের দুই আড়াই কড়াইশুঁটি- একসঙ্গে ফুটিয়ে তরকারি। বিকেলে আমি ও দাদা স্কুল থেকে এসে ওই তরকারি ও খান পনের ষোলো করে রুটি জলখাবার খেতুম”। মহেন্দ্রনাথ দত্ত একবার একটা খুব দামি কথা বলেছিলেন যে -“মানুষের শেষজীবনে সমস্ত ছেলেবেলাকার ভাব, বংশের ধারা ফিরে আসে, এই দ্যাখ, ছেলেবেলায় যেসব খেতুম, যেসব শখ ছিল, এখন সেইসব মনে হচ্ছে, সেই কড়াইয়ের ডালের বড়া, ধোকার ডালনা”… এসব নাকি স্বামীজিরও বড্ডো প্রিয় ছিল। মাতৃকুল বৈষ্ণব আর পিতৃকুল শাক্ত, তাই দুই ভাবই নরেনের রক্তে প্রবাহিত হতো, কখনো দিদিমা রাইমণি দেবীর সঙ্গে ভোরে উঠে কৃষ্ণকথা শুনতেন চুপটি করে আর শেষে ছোট্ট নরেন হাত পাততেন মিঠাইয়ের জন্য, ঠিক যেন আমার আপনার ঘরের ছোট্ট গোপালগুলো। আসলে স্বয়ং দেবত্ব যার শরীরে তারই যত লীলাখেলা। সিমুলিয়ার তিন নম্বর স্ট্রিটে দত্ত বাড়িতে একদিন তুমুল অশান্তি, নরেনের বয়স তখন মাত্র পাঁচ,মতান্তরটা হলো ভুবনেশ্বরী দেবীর সঙ্গে তাঁর ছোট্ট বিলের, ডান হাতে খেতে খেতে উনি বাঁ হাতে গ্লাস থেকে জল খেলেন, তখনকার দিনে বাঁহাতে জল খাবার রেওয়াজ ছিল না, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বঙ্গীয় রীতি পাল্টালেন, আসলে জন্মেইছেন তো জড় মূঢ় মূক মুখে ভাষা দিতে, ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলে দিতে। তাই পাঁচ বছরেই বৈপ্লবিক হবেন এতে আর আশ্চর্য কি। তখন ভুবনেশ্বরীদেবীর সংসারে বিদেশি ফুলকপিও যেখানে অচল ছিল, এহেন বাড়ির নরেন কিন্তু সব খাবারেই ঐশ্বরিক উপলব্ধি খুঁজেছেন আজীবন তাইতো সন্ন্যাসী হয়েও তিনি শেষ অবধিও কখনোই নিরামিষাশী নন, মহেন বাবুর বর্ণনায় জানা যায় -” রায়পুরের পথে যাবার পথে ঘোড়াতলাতে মাংস রান্না হলো, আমি খাব না, দাদা মুখে মাংস গুঁজে দিয়ে পিঠে কিল মারতে লাগল, বলল- খা খা। তারপর আর কি, বাঘ রক্তের আস্বাদ পেলে যা হয়।” আগেই বলেছি ভুবনেশ্বরীদেবীর কুল বৈষ্ণব, বিশ্বনাথ বাবু ঘোরতর শাক্ত। মামাবাড়িতে শুধু নিরামিষ নয়, সেখানে গোবর তুলসী গ্রহণও ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। এর ফলেই ফিরে এসে একবার নরেন পাতে কিছুই নিচ্ছেন না, কেননা খাবারের সঙ্গে মাছের তরকারির ছোঁয়া ঠেকেছে, কিন্তু বিশ্বনাথ বাবু ভোজনরসিক, ছেলেকে ধমকে উঠলেন, -” ওর চোদ্দ পুরুষ গেঁড়ি গুগলি খেয়ে এলো আর এখন ও সেজেছে বেহ্মদৈত্যি, মাছ খাবেনা”। এমনকি দত্তবাড়িতে বাবুর্চি আনিয়ে মোগলাই রান্নার রেওয়াজও ছিল। দিদিমা রাইমণি দেবীর হাতের রান্না বিলেকে বড্ডো টানত, সন্ন্যাস গ্রহণের পরও দলবল নিয়ে স্বামীজি তাঁর তৈরি মোচার ঘন্ট, থোড়ের ডালনা, শুকতো, লুচি খেতে ছুটতেন। ছোট্ট বেলার বর্ণনায় দেখা যায়, দিদার হাতের নিরামিষ রান্নার জন্য স্বামীজি নিরেমিষ হেঁশেলের খোঁজ নিয়মিত রাখতেন, শাকসব্জি থেকে শুরু করে ডাল বেঁটে বড়া, বড়ি দিয়ে শুক্ত, ধোকা তাঁর হট ফেভারিট ছিল। এভাবেই খাবারের ছড়াছড়ি ছিল যেখানে, এহেন স্বচ্ছল পরিবারেও পিতা বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যু ও সম্পত্তি নিয়ে শরিকি মামলা মোকদম্মা দারিদ্র্যের তীব্র দাবদাহ নিয়ে আসে। স্বামীজির ভাষায় -“মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল, অনাহারে ছিন্নবস্ত্রে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে অফিস হইতে অফিসান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম।” -সেই থেকে শুরু হলো অনাহার অর্ধাহারের জীবন, বাবারাই হন, বটবৃক্ষ আর যার এই বটগাছের ছায়া মাথা থেকে সরে যায়, সেই জানে আজীবন কতখানি ঝড় ঝাপটা রোজ সইতে হয়। স্বামীজির মুখে এই শোচনীয় অবস্থা আরো শোনা গেছে- “প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম, গৃহে সকলের পর্যাপ্ত আহার্য নাই, সেদিন মাতাকে ‘আমার নিমন্ত্রণ আছে’ বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোনদিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোনদিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম, অভিমানে ঘরে-বাইরে কাহারও নিকট ঐকথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না।” মাংস খেতে ভালোবাসা ছেলেটি এভাবেই সংযমের পাঠ শিখতে থাকেন। ঐ পর্যায়েই এক সময় পরমহংস দেবের সঙ্গে নরেনের সাক্ষাৎ ঘটে, একদিন ঠাকুর তাঁর হাতে স্বয়ং প্রসাদ অর্থাৎ মাখন, মিছরি, সন্দেশ তুলে দেন, পরবর্তী কালে দেখা গেছে, স্বামীজিও ঠিক মৃত্যুর আগে একইভাবে নিবেদিতাকে খাইয়ে ছিলেন, এই লাস্ট সাপার বা শেষ খাওয়ানোটাও যেন তাৎপর্যপূর্ণ, অর্থাৎ আজ থেকে নিজের সব দায়িত্ব ভার প্রিয় শিষ্যকে অর্পণ। নরেন কচুরি, সিঙারা, খিচুড়ি ভীষণ ভালো বাসতেন। পোলাও এর চাইতেও খিচুড়ি তাঁর বেশি প্রিয় ছিল। চপ কাটলেট ও তাঁর প্রিয় তালিকায় ছিল, নরেন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন-” এরপর দেখবি কলকাতা শহরের গলির মোড়ে মোড়ে, পাড়ায় পাড়ায় পানের দোকানের মতো চপ কাটলেট এর দোকান হবে।” হাই লেভেলের ইনোভেটিভ শেফও ছিলেন তিনি, তাঁর সবচেয়ে সফলতম গবেষণামূলক রান্না আবিষ্কার হলো- হাঁসের ডিম খুব ভালো করে চালে ফেটিয়ে কড়াইশুঁটি ও আলুসহ ভুনি খিচুড়ি, পোলাও এর চেয়েও শতগুণে উপাদেয়। স্বামীজির খাদ্যরসিকতা নিয়ে পড়তে গিয়ে শিখেছি আমি এই রান্না এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় নিজে করে বলছি, সত্যিই পোলাও ফ্রাইড রাইসের চেয়ে এটা বেশি সুস্বাদু। শ্রীমায়ের হাতের রান্নাও নরেনের ভীষণ পছন্দের ছিল, শ্রীমায়ের নিজের মুখেই নরেনের রান্না বিষয়ে শুনুন-” আমি যখন ঠাকুরের জন্য রাঁধতুম কাশীপুরে, কাঁচা জলে মাংস দিতাম, কখানা তেজপাতা ও অল্প মশলা দিতুম, তুলোর মত সিদ্ধ হলে নামিয়ে নিতুম, নরেন বড্ডো ভালো বাসতো, নরেন আমার নানা রকমে মাংস রাঁধতে পারত, চিরে চিরে ভাজত, আলুচটকে কীসব রাঁধত, তাকে কী বলে? বোধহয় চপ কাটলেট হবে”… এভাবে বোঝা যায়, নরেন্দ্রনাথ কতখানি খাদ্যরসিক ছিলেন, তিনি পারফেকশনিস্ট, ভোজনেও বা দর্শনেও…
(পরের পর্বে পুরোদস্তুর সন্ন্যাসী হয়ে ওঠার পর স্বামীজির ভোজনরসিকতা)
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।