।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় বেদশ্রুতি মুখার্জী

এক দুগ্গা এলো, বাকি দুগ্গা গুলো???

পেঁজা পেঁজা তুলোর বলের মতো মেঘের অভিসারীকা চলন, কাছের প্যাণ্ডেল থেকে ভেসে আসা ঢাকের বাদ্যি, ঘুম ভেঙে উঠেই আপনার রান্না ঘর থেকে ভেসে আসা লুচি ক্ষীরের গন্ধে প্রথম প্রেমের ছুকছুকানির মতো পাগল জিভটা, আপনার আমার টাইমলাইন জুড়ে সদ্য হেয়ার স্ট্রেটনিং স্মুথনিং করানো চকচকে স্কিনধারী মামণিরা, মলগুলোয় জুতো জামা প্রেমী বাঙালির করোনাসুরকে এড়িয়ে চিয়ারলিডার হওয়া, আর পাশের ক্লাবের ঠাকুর আনার ধুম আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে আপনার মাস্ক এর ম্যারাপ বাঁধা কানকে চুপিচুপি এসে বলে-
এসে গেছেন দুগ্গা ঠাকুর, বলো দুগ্গা মাইকি জয়… এই চাট্টি দিন বাঙালির সেরা সুখের সময়, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভুবন মাতে উৎসবের আমেজে, ডিজিটাল আলো আর পোশাকের, ডিপির বিজ্ঞাপনী মেলায় মুখ ঝলসে যায়। এবারে অনেক কিছুই ভাইরাসের বিধিনিষেধের আওতায় আন্দামানের সাজাপাওয়া বন্দীদশায়, তবুও হুজুগে বাঙালি মাতবে না- তাই হয় নাকি… অনেক জায়গায় ঘট পুজোই হবে, তবুও পুজো তো পুজোই। দুগ্গা ঠাকুরকে স্বাগত জানাতে তৈরি মর্ত্যবাসী।
কিন্তু ঘরের কোণে ঠিক কেমন আছে আমার আপনার লাখো কোটি গোপন দুর্গারা???
তারাও লাখে লাখে আছেন দশভুজার এই জৌলুসের উল্টোপীঠে ঠিক আজো টিকে…
এক দশভুজা বৃদ্ধাশ্রমের গরাদ ধরে অনাগত ছেলের অপেক্ষায় আজো অভ্যেসবশত তৈরি করা নাড়ুর বয়মটা দেখছেন আর ভাবছেন- “বাবু ভীষণ নাড়ু ভালোবেসে, আসলে খুব খুশি হবে দেখে, আচ্ছা আসবে তো একটিবার এইবার অন্তত???”… বাবুও অবশ্যি বড্ডো ব্যস্ত সপরিবারে, সপরিবারে আগত দুর্গার মূর্তি মুঠোফোনে বন্দি করতে। দুগ্গা দেখছে বাবু বৌ বাচ্চা নিয়ে, বুড়ো কাতু গণেশা ব্যাকডেটেড বলেই মায়ের সঙ্গে থাকে, প্রাইভেসি চায় না, আজো মায়ের হাত ধরে মামাবাড়ি আসে। হয়তোবা বৃদ্ধার বাবুও আসবেন একদিন, তাঁর চিরঅবহেলিত মাতৃমূর্তির চোখদুটো বন্ধ হলে।
বাড়িতে চির শশব্যস্ত দাপুটে স্বামীর অপেক্ষায় সারাদিন সংসার ঠেলে ঠেলে রান্নার তাপে পোড়া সো কলড সুখী গৃহিণীও রাত অবধিও ভেবে যায়- এই বুঝি আসবেন উনি, খেয়েই বলবেন, রেডি হও বের হতে হবে। উনিও আসেন, কিন্তু বন্ধুদের সঙ্গে ফুর্তি করে ক্লান্ত তাঁর সময় নেই আর ওত ঘ্যানঘ্যান শোনার, সারা বছর কাজ করার পর সত্যিই তো উনি চারটেই দিন পান ছুটি, ওত টইটই কীসের তবে, আর তাছাড়াও সারাদিন রিসর্টে প্রচণ্ড ঘাম ঝরেছে তরুণী এসকর্টকে প্রৌঢ় বয়সেও পৌরুষ দেখাতে গিয়ে। এখন এত টিকটিক করলে কী ঘর করা যায়, এজন্যই তো তাঁর এক বন্ধু ডিভোর্স দিয়েছিলেন স্ত্রীকে, এরকম বৌদের জন্য ই তো তাঁর মতে, অন্য জায়গায় যায় স্বামীরা, শান্তির খোঁজে!!!শেষে তাঁর রাগের ঝাল মেটে একটা মাত্র নিরীহ চড়ে, আমার দুর্গা অঝোর ধারায় এখন মাটিতে লুটিয়ে, শাশুড়িমাও তো ছেলেরই পক্ষে রায় শোনান, একদিন অবশ্য উনিই বলেছিলেন একদিন বড় মুখ করে, তাঁর স্বামীটি নাকি সারা জীবন তাকে কত যত্নআত্তি করে গেছেন সেই গল্পগাছা, যাগ্গে আমার দুর্গা তো পরের মেয়ে, ছেলের বৌ তাই একদম বোবা সাজলেও তো শুনতে হবে- বড্ডো মুখে মুখে তক্কো করে। দুর্গাটার যে ফিরে যাবার পথও নেই, সবটাই যে সবাই জানে, সেই তো দাদাদের এক কথা, “মানিয়ে নে না”… গালের কালশীটেয় রক্ত মুছে ঘুমন্ত ড্রাংক বরকে যেন মশা না কামড়ায় তাই মশারিটা খাটিয়ে দিয়ে, চুল বেছে শার্টটাকে ওয়াশিং মেশিনে ফেলে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ওপরের ফ্যানের দিকে, পাশের ঘুমন্ত ছেলেটা না থাকলে পেত সেও মুক্তি, নিত স্বেচ্ছা বিসর্জন, কিন্তু মাধ্যমিক যে এইবার…
এজন্মে মুক্তিটা থাক নাহয়…
আমার আর এক দুর্গা বিদ্রোহীর পুজো প্যাণ্ডেলের সামনে এবছর রোল চাউ এর দোকান দিয়েছে, লাভ ভালোই হলো এই প্যান্ডেমিকেও , কাল ঠাকুমার ওষুধ কেনা যাবে, পঙ্গু ভাইটাকেও একটা সস্তার ছিটের জামা দেওয়া যাবে, বিধবা মার হাতে কটা টাকা এতদিনে যাক দিতে পারবে, টিউশন করে করে কলেজে পড়ার খরচটাই জোটে খালি, কিন্তু টিবিরুগী মায়ের সেলাইয়েই সংসারটা তো চলে খুঁঁড়িয়ে খুঁঁড়িয়ে। ফিরবে সে রাত সোয়া এগারোটার শেষ বারসই লোকালে, পুজোর ভিড়- অত ভয় নেই, অনেক লোক থাকবেই, ছিলও তবে গ্রামে বাড়ির ঠিক আগের শীতলা চন্ডীর মাঠটা পেরোতে গিয়েই… ছিঁড়েখুঁড়ে খেল একপাল মাতাল কুকুরের দল, ছড়িয়ে পড়ল রক্ত, মাংস দেবীর চোখের সামনেই। লজ্জায় রেলে গলা দিলো স্বর্গের সব দেবীরা, গলে গলে চুঁইয়ে চুঁইয়ে যোনী দিয়ে ভেসে ডুবে গেল দেশ… তবুও হাতে ধরা কত কষ্টের শেষ টাকাকটা… কাগজে ফলাও করে সাংবাদিকেরা ব্রেকিং নিউজ দিয়েছিল পরদিন, ওর দুই পা চেরা বডির খবর বেচে বড়লোক হয়ে গেল চ্যানেল গুলো, প্রিন্টেও প্রতিটা শব্দের দাম উঠেছিল চড়া…
আমার এই দুর্গা স্বয়ংসম্পূর্ণা, চাকুরিরতা, উচ্চ শিক্ষিতা, উচ্চ প্রতিষ্ঠিতা ডক্টর, অকুতোভয়, অকুণ্ঠ সম্মানীয়া, সদ্য ফিরেছে সে নতুন কেনা ফ্ল্যাটটায় নিজেই ড্রাইভ করে, আবৃত্তির অনুষ্ঠান ছিল আজ বোধনে, ঐ যে মন্ত্রী উদ্বোধনে এসেছিলেন, সেই মণ্ডপেই, আজকাল ওর মোটামুটি নামডাক হচ্ছে শহর ছাড়িয়ে ভিনশহরেও আবৃত্তিতে, লেখালেখিতেও। শত কাজের ফাঁকেও বারবার খোঁজ নিয়ে গেছে প্রেমিককে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ করে, ওর জ্বরটা এখন কমেছে কিনা, কিছু খেল কিনা, কেমন আছে, উত্তর পায়নি, অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়, ও অবহেলাই শুধু পায় ওর ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকে, যখনই মেসেজ আসে, জোটে ভয়ংকর খোঁচা মারা টেক্সট, আদৌ তার অপরাধ কী, সে তো চিরকালই ওই ছেলেকে পাগলের মতোই ভালোবেসে যোগিণী রাই হয়ে গেল, প্রেমিকই বরং হঠাৎই আর এক সত্যভামার হয়েও খোঁচা দিয়ে যায়।
কেন এরকম করছ আজ জানার জন্যই কল করে ফিরেই আমার দুর্গা, দশটা ফোন বেজে যাবার পর ছোট্ট মেসেজ আসে, বৌ নিয়ে বেরিয়েছি, ডিসটার্ব কোরো না…তবে যে কাল থেকে বলে গেল জ্বর, এতদিন বলে গেল, ডিভোর্স ফাইল হয়েছে!!! সব ফাঁকি ছিল বুঝি, লিখতেই জবাব এলো তীরের বেগে- উত্তর দিতে ভালো লাগছে না ওত, তাই সব শেষ, এমনিও তোমার আমার ওপর কোনো রাইট নেই বুঝেছ, কবেই বা ছিল, নয়তো হুট করে মিথ্যে বলে বিয়ে…
ব্যস তারপর ডিজিটাল ঘেন্নার নিলাম… কল, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক সব ব্লক… কিন্তু কী হলো, কেন??? তাঁর অপরাধ কী??? সারা দিনের এত সম্মানের পর, সারা জীবনের এত ত্যাগের শেষে তকমা জুটল দ্বিতীয় নারীর??? কালভোরে আমার সো কলড ডক্টর দুর্গা টাও নিজেরই নার্সিংহোমে আইসিইউ তে যাবে, চোখ খুলবে কী আর??? হাতে গভীর ক্ষত, তবে মনের ক্ষতটা??? থাক… সব ক্ষতের প্রলেপ হয়না, কিছু ক্ষতে মলমটাই হয়তোবা আরটু গভীর অসুখ…
আমার আর এক দুর্গা বড্ডো কান্নায় ভেঙে পড়েছে পুজোর ছুটির ঠিক আগের দিন স্কুলেই, সে শহরের নামী স্কুলে পড়ায়, কিন্তু তার প্রতি কদিন ধরেই অকারণ কিছু কলিগ ভীষণ বিরূপ, তার এক্সের সঙ্গে ফেসবুকে দফরম মহরম তাদের, সুবিধা পেলে এজাতীয় লোকেরা নিজের মাকেও বেচে দিতে পারে। আর অন্য দিকে, বেচারি তেমন একটা মিশতেও পারে না যে কেননা ব্যক্তিগত জীবনে সে অনেক ঝড় ঝাপটা সামলাতে সামলাতে এখন ক্লান্ত সে, সদ্য বিনা দোষে তৃতীয় সম্পর্কে জড়িয়ে তার প্রাক্তন আশীর্বাদটাও ভেঙেছে, তাই দুঃখীকে তার অভাববোধে খোঁচা মেরে কতিপয়ের বড্ডো ইগো স্যাটিসফায়েড হয় এই দুনিয়ায়, তাই কথায় কথায় খোঁটা দিয়ে কতিপয় তার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে স্কুলে, অথচ স্টাফ মিটিং এ সে এই অন্যায়ের বিচার চাইতে ওঠায় এক মেল কলিগের নোংরা কটাক্ষে কেউ কেউ হাসিতে ফেটে পড়তেই সেও ভেঙে পড়ল কান্নায়… মনে পড়ে গেল, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে… জীবনের কাছে শেখা হলো, আদতে সেও শুধুই মেয়ে, ম্যাডাম নয়…

আমার আর এক দুর্গা ট্র্যাফিকে, আমার আপনার পুজোর আনন্দে জনজোয়ার সামলাতে ব্যস্ত, এই চারদিন ছুটি মেলেনা, অভ্যস্ত হাতে ওয়াকিটকিতে আপাদমস্তক কড়া, পেশাদার… বারবার বেজে ওঠে ফোন, পকেটের ভাইব্রেশনে জানান দেয়, ছোট্ট শিশুর অবোধ প্রশ্ন বারবার- “কখন আসবে মামমাম”? চোখ জ্বালা করে ওঠে, তবুও পেশাদার চোয়াল শক্ত করে বলে হ্যালো কন্ট্রোলরুম…

আমার এক দুর্গা কোভিড সেন্টারের ছাদ থেকে মেয়েকে ভিডিও কল করে চোখ মোছে, কী মিষ্টি লাগছে তার এক বছরের ছোট্ট মেয়েকে তার কেনা নতুন লাল জামায়, ডাক পড়ল, সিস্টার…
আমার ছোট্ট দুর্গা অনাথ আশ্রমে, কিশলয় সংস্থা টি ওদের নতুন জামা দিয়ে গেছে, আজ অন্য সংস্থা মুক্তির দিশারী ওদের অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে নিয়ে যাবে দল বেঁধে, প্যাণ্ডেলের সামনে কত বেলুন, কত খাবার, কত বাচ্চারা বাবার কোলে চেপে, মা ওয়াটার বটল থেকে জল খাইয়ে দিচ্ছেন, ওর বাবা মাও ছিল বটে, গেলবার বন্যায় ঘর যখন ডুবে গেল, ওর ঠাঁই হলো এই আশ্রম, আচ্ছা ঠাকুর সবাইকে কেন বাবা মা দেয় না, দিলেও কেন তাড়াতাড়ি তুলে নেয়, অনাথ হওয়া এত অভিশাপ কেন? … ছোট্ট মনে প্রশ্নের বন্যা, মুখে কুলুপ দিয়ে পেটের খিদেয় খেয়ে ফেলল সংস্থার দেওয়া খাবার, আর চোখ দূরের সেই সব বাচ্চার দিকে… জল গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে… পিছন ফিরে চট করে চেটোয় মুছে ফেলল। আমার দুর্গা অন্ধকারটার সদ্ব্যবহারটা শিখে গেছে এটুকু বয়সেই…
আমার দুর্গা চ্যাংরাবান্ধায়, অপরিস্কার গলিতে পা রাখতেই মাছের ডিম ভাজার আঁশটে গন্ধ, চেঁচামেচি আদিম পসরা এড়িয়ে একটার পর একটা খুপড়ি ঘরে আর ভাইরাস নেই… নারী মাংসের জাত হয়না, ভাইরাস লাগে না। শুধু তাদের নিতে হয় ভাইরাস। ডানদিকের কোণের ঝুপড়িতে আমার দুগ্গা টা একটার পর একটা মাতাল, পাগল, গুণ্ডা, ভদ্দরলোক সব খদ্দেরের ঠাটানো মাংসের দাবি মিটিয়ে সবে যখন শিশুটার মুখে নিজের রক্তাক্ত স্তনটা ঠুসে দেয়… বাড়ি ছিল ওপারের দিনাজপুর, চ্যাংরাবান্ধা দিয়ে এনে প্রেমিক বেচে দিয়েছে, তবুও সে তো মা, ওপারের ঐ আমিনা এখন আমার দু্র্গা, হাইয়েস্ট পেইড সাদা চামড়াওয়ালী গরিবের ক্যাটরিনা- কিন্তু ঢাকের বাদ্যিতেও চিন্তায় বেশ, কাল অষ্টমী, লোক কম আসে যদি, বাচ্চাটার ফুডটাও এদিকে শেষ হয়ে আসছে… দুধটাও খাওয়া শেষ হলোনা ক্ষুদার্থ শিশুটার, ডাক এলো- থানার মেজোবাবু এয়েছেন, আয় মাগি…
এভাবেই জগতবাসী অসুরদলনী নিয়ে জগত মাতামাতি করতে থাক, আর প্রদীপের তলার শত শত দুর্গা আঁধারে কাটাক, আসলে মাও সে তো পুরুষশাসিত সমাজের অংশ, তাইতো দেবতাদেরই যুগে যুগে অস্ত্র দিতে হয়, দেবীরা তবেই জাগে, আর মাটির রূঢ় বাস্তবে বেশিরভাগ দেবীরা কখনোই জাগেনা, কেবল হারিয়ে যায়, বোধনের ঢাকেও তাদের আদতে চিরদশমীই…
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।