19/03/2020 বার বছর তিন মাস ছাব্বিশ দিন। এতদিন পর আজ হঠাৎই দেখা মৈনাকের সঙ্গে। কিছুটা আকস্মিক। মুনাইয়ের স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকদিন হল। এখন চারদিকে যা করোনা আতঙ্ক চলছে, বিকালে পার্কে ঘুরতে নিয়ে যেতেও সাহস পাচ্ছি না। পাবলিক ট্রান্সপোর্টেও অফিস যেতে অবধি ভরসা পাচ্ছে না ঋষি। কদিন থেকে তাই বাড়ির গাড়ি নিজে ড্রাইভ করে অফিস যাচ্ছে। মেয়েটা ঘরে বসে বসে ভীষণ রকম বোর হচ্ছিল বলে আজ মায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। মায়ের বাড়ি থেকে এমন কিছুই দূরত্ব নয় আমাদের বাড়ি। ট্যাক্সিতে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট লাগে। তবে আজ অফিস যাওয়ার পথে ঋষিই গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছিল।
মা একা থাকে, মিনুদি অবশ্য সবসময় থাকে। মুনাইকে স্কুলে দিয়ে মাঝেমধ্যেই মায়ের কাছে যাই। পাড়ার সবার সঙ্গেই টুকটাক দেখা হয়, কথা হয়। কিন্তু মৈনাকের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি। তবে জানতাম মৈনাক এখন দিল্লিতে থাকে।
সেই কলেজে পড়ার সময় যখন মৈনাকের সঙ্গে আমার প্রেমের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল, তখন থেকেই মৈনাকের নামটাই আমাদের বাড়িতে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিল। মৈনাকের মা বাড়ি এসে যথেষ্ট অপমান করে গিয়েছিল আমার বাড়িতে এসে। বাবার কাছে সেই প্রথমবার চরম বকুনি খেয়েছিলাম। মা হাত তুলেছিল আমার গায়ে। মাথার দিব্যি দিয়েছিল, আর যদি কখনও ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলি মায়ের মরা মুখ দেখব। তবে আমাকে মায়ের দিব্যি মানার জন্য কথা বন্ধ করার সুযোগটুকু মৈনাক আমাকে দেয়নি। নিজেই কথা বন্ধ করে দিয়েছিল আমার সঙ্গে। পাড়ার রাস্তায় দেখা হলেও না চেনার ভান করে সাইকেল নিয়ে পেরিয়ে যেত। মা দিব্যি দিয়েছিল, কথা না বলতে। তখন তো ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ ছিল না। তবে মোবাইল এসেছিল আমাদের হাতে। এসএমএস করেছিলাম মৈনাককে। কোন উত্তর দেয়নি।
তারপর মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে যেমন হয়, আমার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছিল। বাবা উঠে পড়ে লেগেছিল আমার বিয়ের জন্য। ভালো ছেলেও পেয়ে গেল কয়েক মাসের মধ্যে। বিয়ে হয়ে গেল আমার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মৈনাকের নামটা ফিকে হয়ে আসতে থাকল। ধূসর বিকাল অথবা মেঘলা দুপুরে শুধু মাঝে মাঝে ফিরে এসেছে নামটা।
ঋষির অফিস থেকে ফিরে খাওয়ার জন্য লুচি ভাজছিল মিনুদি। মায়ের প্রেসারের ওষুধটা কিনতে পাড়ার মোড়ের মাথার ওষুধের দোকানটাতে গিয়েছিলাম। মৈনাকও এসেছিল ওষুধ নিতে। এতবছর পরে প্রথম কথা অবশ্য ওই বলল। বাবা অসুস্থ তাই কলকাতা এসেছে গতকাল। বাবাকে একা রেখে ওখানে চিন্তা হয়। এবার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি ফিরে যাবে। অপ্রাসঙ্গিক ভাবেই যেন এখনও বিয়ে না করার কথাটাও জানাল।
সম্পর্ক ভাঙার দিনের সেই একাকী বিনিদ্র রাতগুলো কাটিয়ে এসেছি অনেক বছর হল। আজ তাই এই খবরটা আমার কাছে নিতান্তই মূল্যহীন।
ওর সঙ্গে কথা না বলার দিব্যি দিয়েছিল মা। আজ হঠাৎ করেই কথা বলে ফেললাম মৈনাকের সঙ্গে। কিছু হবে না তো!
জানি সবটাই কুসংস্কার, তবু একটা অস্বস্তি হচ্ছে মনের মধ্যে। বাবা মারা যাওয়ার পর আমি ঋষি দুজনেই বলেছিলাম মাকে আমাদের কাছে এসে থাকতে বলেছিলাম। মা রাজি হয়নি। সবসময় মায়ের জন্য কেমন যেন একটা টেনশন হয়। মা কেন যে সেটা বোঝে না!
22/03/2020
শীতকালেই সচরাচর এমন শ্বাসকষ্টের সমস্যাটা হয় আমার। এখন হঠাৎ করে এমন কষ্ট শুরু হল কেন কে জানে! জ্বরও রয়েছে। আজ দেশ জুড়ে জনতা কার্ফু। ঋষি সারাদিন বাড়িতে ছিল বলে মুনাইকে সামলিয়েছে। কিন্তু কাল তো অফিস যাবে ঋষি। মেয়েটাও সারাদিন গায়ের কাছে ঘুরঘুর করবে। চারদিকে যা সমস্ত খবর শুনছি, ভয় করছে। তবে একটাই আশা মনের মধ্যে, কোন বিদেশীর সংস্পর্শে তো আসিনি! কাল ডাক্তারবাবুর কাছে যাওয়ার কথা বলছে কিন্তু ভয় করছে। এখন কোথা থেকে যে কীভাবে সংক্রমণ হবে বোঝা মুশকিল।
হে ঈশ্বর, মানুষকে এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি দাও।
23/03/2020
আজ সকালেই মিনুদি ফোন করে জানিয়েছিল, মায়ের গতকাল রাত থেকে খুব কাশি হচ্ছে। আজ দুপুরে জানাল, জ্বরও এসেছে। লকডাউন চলছে। নিজের শরীরটা ভালো না থাকলেও গাড়ি পাঠিয়ে যে মাকে নিজের কাছে নিয়ে আসব সে উপায়ও নেই। ড্রাইভার এখন আসবে না। তাছাড়া মনে হল ঋষিরও যেন ইচ্ছা নয়, এইসময় মা এসে এখানে থাকুক। প্রথমটা ভীষণ রাগ হলেও পরে মনে হল ঋষি যা সাবধানী মানুষ, ওর এমন ভাবাটাই বোধহয় স্বাভাবিক। মুনাইকেই কাল থেকে আমার কাছে আসতে দিচ্ছে না। তবু কেমন যেন স্বার্থপর মনে হচ্ছে নিজেকে। সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমি কি মায়ের প্রতি কর্তব্যে অবহেলা করলাম!
কিন্তু ওখানে তবু তো মিনুদি আছে। এখানে এলে কে মায়ের দেখাশুনো করবে! কাজের মাসি, রান্নার দিদি কেউ আসছে না। অপটু হাতে সংসার সামলাচ্ছে ঋষি। আমি তো নিজেই বিছানাবন্দী। ইনহেলারেও কাজ করছে না যেন। শ্বাসকষ্টটা বেশ কষ্ট দিচ্ছে। ডাঃ বসু আমাকে বরাবর দেখেন। ওনাকে ফোন করেছিল ঋষি। কাশিটা তেমন নেই বলে উনি আশা করছেন সমস্যাটা কমে যাবে। তবু ভয়টাকে যেন কাটিয়ে উঠতে পারছি না।
27/03/2020
আজ তিনদিন হল হাসপাতালে। সেদিন রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্টটা এত বেড়ে গিয়েছিল যে সেই রাতেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। দুদিন ডাক্তারদের নজরবন্দী থাকলেও, গতকাল রাত থেকে আমি একাকী ঘরে বন্দী। আমি এখন আইসোলেশেনে। আমার স্যালাইভা রিপোর্টে করোনা পজিটিভ এসেছে।
আমি এবার মরে যাব! কোনদিন আর দেখা হবেনা ঋষি, মুনাই আর মায়ের সঙ্গে। গতকাল বিকালেও শেষ কথা হয়েছে বাড়িতে। তখনও ওরা নিজের বাড়িতেই গৃহবন্দী ছিল। আমার রিপোর্ট পজিটিভ আসার পর ওরাও এখন হাসপাতালে। এখন হসপিটাল কোয়ারেন্টাইনে ওরা। আমার থেকে রোগটা ওদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছে কি না দেখার জন্য ওদেরও পরীক্ষা হবে। মুনাইকে কি ওর বাবার সঙ্গে রেখেছে, নাকি আলাদা ঘরে! একা থাকতে বড্ড ভয় পায় আমার মেয়েটা।
গতকাল রাতে অক্সিজেন সাপোর্ট লেগেছিল। এখন অক্সিজেন লাগছে না বলে ডাক্তারবাবুর কাছ থেকে একটু লেখার অনুমতি চেয়ে নিলাম। তবে কাল থেকে ইউরিন হয়নি, তলপেটে অসম্ভব ব্যথা হচ্ছে। ডাক্তারবাবুরা চিন্তায় আছেন। কিডনিও বুঝি কাজ করা বন্ধ করে দিল। কদিন আগেই তো টিভিতে দেখেছিলাম, করোনা আক্রান্ত রোগীদের মাল্টিঅর্গান ফেলিওরেই মৃত্যু হয়। আমিও প্রতি মুহূর্তে বোধহয় মৃত্যুর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছি একটু একটু করে।
গতকাল শেষবার ঋষি যখন ফোন করেছিল তখন বলেছিল,
আমার মায়ের বাড়ির পাড়ায় কদিন আগে দিল্লি থেকে একজন ছেলে নাকি তার বাবাকে নিতে এসেছিল। দিল্লি ফেরার পর ধরা পরেছে, সে করোনা পজিটিভ।
ঋষি ওই দিল্লিবাসী ছেলেটাকে না চিনলেও ওটা যে মৈনাক আমি বুঝতেই পেরেছিলাম। বার বছর তিন মাস ছাব্বিশ দিন পর হয়ত নিয়তির টানেই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল সেদিন।
আর লিখতে ইচ্ছা করছে না। খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখের সামনে ভেসে আসছে অনেক বছর আগের এক বৈশাখী বিকালের ছবি। গঙ্গার ধারে দেখা করেছিলাম আমি আর মৈনাক। সেদিন মৈনাক বলেছিল, ও নাকি ভালোবেসে জীবনের সবটুকু আমাকে দিয়ে দিতে পারে।
এতবছর পরে নিজের অজান্তেই হয়ত সেদিনের সেই কথা রেখেছে মৈনাক। নিজের শরীরে বয়ে আনা বিষাক্ত জীবাণুটুকু দান করে গেছে আমাকে!