• Uncategorized
  • 0

ধারাবাহিক বড় গল্পে বদরুদ্দোজা শেখু (পর্ব – ২)

নানার হুঁকো – ২

আমার তৌগান নানার এক চাচাতো ভাই আরফান নানা। সেও গাঁজা দিয়ে হুঁকো টানতো । আফিম খেতো। দুই নানার চোখগুলো টকটকে জবা ফুলের মতো লাল হ’য়ে থাকতো। ইয়া-ব্বড়ো গোঁফ, মাথায় পাগড়ি , গায়ে ফতুয়া , খাটো ক’রে লুঙ্গী পরা, হাতে একটা পাকানো সাট লাঠি। লাঠিয়ালদের মতো।
সে দু’ক্রোশ দূরের খুনিয়ারনগর গ্রামে মুদীর দোকান চালাতো। খুব হিম্মৎওয়ালা লোক ছিল। অনেকবার সে বাঘের কবলে পড়েছিল । সে নজরবন্দী করার মন্ত্র জানতো। তাই মন্ত্র আর সাহসের জোরে বেঁচে ফিরতো।
তো সে দূপুরের ভাত খেয়ে বেলা ৩•০০টা নাগাদ দোকানে যেতো। ফিরতে ফিরতে রাত ১০•০০ টা হ’য়ে যেতো। বাড়িতে এসে খাবার খেয়ে হুঁকো টেনে ঘুমিয়ে পড়তো। আবার সকালে বাঁহুকে ক’রে জিনিসপত্র নিয়ে দোকানে যেতো আটটা নাগাদ। তারপর বেলা ১•০০টা নাগাদ দোকান থেকে ফিরতো। কোনো কোনো দিন বাড়ি না ফিরতে পারলে ব’লে যেতো, তার ছোট ভাই বা নাতি দুপুরের খাবার দোকানে দিয়ে আসতো।
একদিন মাঘ মাসের জাড়ের দিন হলো কি—, তার নাতি আফজল দুপুরের খাবার নিয়ে গেলো। দোকানে খদ্দেরের চাপ থাকায় বিকাল হ’য়ে গেলো খেতে। তারপর নাতিকে বললো, তু বাড়ি চলি যা ,
আমার যেতে রাত হবে। নাতি কিন্তু সন্ধ্যার মুখে একা একা ফাঁকা মাঠ দিয়ে ফিরতে সাহস করলো না। বললো, আমি তুমার সাথে যাবো। নাতির মনোভাবে নানা বললো, থাক তাইলে, এক সাথেই যাবো। যেহেতু তার নাতি সাথে থাকবে আর জাড়ের রাত, তাই সে দোকান তাড়াতাড়ি বন্ধ ক’রে রাত সাড় আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরে আসার জন্য বেরোলো। দু’টো গ্রামের মাঝখানে একটা বিশাল ফাঁকা মাঠ পড়তো।
দূরে চারিপাশে মনিগ্রাম ভূমিহরের বিয়াবন জঙ্গল, শালবন । বনে বাঘ ভাল্লূক শিয়াল আরো অন্যান্য হিংস্র জন্তুজানোয়ার থাকতো। তারা যখন প্রায় মাঝ মাঠে পৌঁছেছে এমন সময় আরফান নানা একটা শাঁ -শাঁ শাঁশাঁ মতো আওয়াজ শুনতে পেলো যেন ঝড় আসছে । জাড়ের শুনশান অন্ধকার রাত। মুহূর্ত্তেই নানা বুঝতে পারলো, ঝড়ের বেগে বাঘ ছুটে আসছে।
আশপাশ চেয়ে দেখলো, পূর্বে মনিগ্রামের দিক থেকে অনেক জোনাকি যেন ছুটে আসছে। তৎক্ষণাৎ সে নাতিকে ঝট ক’রে টেনে পিছনে নিয়ে নিলো আর একমুঠো লিকের ধুলো তুলে’ নিয়ে ফুঁ দিয়ে চারপাশে ছিটিয়ে দিলো। বললো, তু একদম ঘাবড়াবি না,শেলা বাঘ আসছে। নজরবন্দী ক’রে দিয়াছি, কিছু করতে পারবে না। তু শুধু আমার পিছন ধ’রে থাক ।
পলকের মধ্যে শেলা বাঘ সামনে এসে দাঁড়ালো। তার চোখদুটো আগুনের গোলার মতো জ্বলছে। তার চোখে চোখ পড়লে চোখচাঁদি লেগে যাবে। চারিপাশ অজস্র জোনাকিতে ঘিরে ধরেছে। নানা শুধু লাঠিকে সামনে বাড়িয়ে হুঙ্কার ছেড়ে বললো, এই ,দূরে দাঁড়া ! এক পা-ও এগোবি না !– – বাঘের হুঙ্কারে নাতির তো আত্মারাম প্রায় খাঁচাছাড়া ! তবু সে তার নানার কোমর জাপটে’ ধ’রে দাঁড়িয়ে থাকলো। আর শেলা বাঘ তো হামলে নানার গায়ের ওপর পড়তে আসছে ! নানা লাঠিটা সামনে ধ’রে ততোবার এগোতে মানা করে —- খবরদার ! এক পা-ও এগোবি না ! নানার লুঙ্গী ফতুয়া তো বাঘের লালে-ঝোলে ভেসে যেতে লাগলো। সে সামনে বিশাল হাঁ ক’রে দাঁড়িয়ে আছে আর ফুঁসছে হাঁপাচ্ছে আর ঝাঁপিয়ে পড়তে আসছে ! কিন্তু নানাও হিম্মৎওয়ালা ! সারা রাত তারা নানা নাতি ওইভাবে বাঘের সামনে ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো । শুনশান অন্ধকার রাত। সামনে শেলা বাঘ হামলে’ পড়তে আসছে গায়ে। কিন্তু নির্দিষ্ট গণ্ডীরেখার মধ্যে ঢুকতে পারছে না । কী ভয়ঙ্কর ! জান যায় যায়। নানা সামনে লাঠি হাতে আর পিছনে নাতি !
ওদিকে আরফান নানা আর তার নাতি বাড়ি না ফেরায় কাঁদাকাটা শুরু হয়েছে বাড়িতে। নিশ্চয় ওদেরকে বাঘে ধরেছে ! বাঘের হুঙ্কার দূর থেকে শোনা গেছে।।প্রায় ভোর রাতে যখন পূর্ব দিকে আবছা আলোর রেখা ফুটে উঠছে তখন নানা উত্তর-পশ্চিম দিকে হাত তুলে’ বললো , এইবার যাঃ ওই দিকে। তৎক্ষণাৎ শেলা বাঘ ঝড়ের বেগে ছুটে চললো উত্তর-পশ্চিম দিকে । মিনিট দু’য়েকের মধ্যেই ক্রোশ তিনেক দূরে কালাচিতির মাঠে গিয়ে ডাক ছাড়লো ভুবন-কাঁপানো ডাক। — – –
তারপর নানা নাতিকে ঘাড়ে নিয়ে ছুটলো বাড়ি ।
নাতি তখন অজ্ঞান। বাড়িতে লোকজন দু’জনের সেঁকাপোড়া করলে তবেই তারা ধাতস্থ হয়।
নানার গল্প তো শেষ হলো, এবার আমরা তো ভয়ে বাড়ি যেতে পারছি না ! তৌগান নানা তাড়া দিয়ে বললো, এবার ভাগ্, সবে সন্ধ্যা রাতে আবার গাঁয়ের মধ্যে ভয় কিসের !

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।