কাব্যক্রমে বদরুদ্দোজা শেখু

১| হে মান্যবর

দরখাস্ত দিতে দিতে ফতুর হয়ে যাচ্ছি হে মান্যবর
না হয় বেশী বুদ্ধিমান নই
না হয় ডিগ্রীটা টেনেটুনে পাশ
না হয় গ্রামের ছেলে বেশী স্মার্ট নই,
না হয় নিত্য খবরের কাগজ পাইনা পড়তে
কেরিয়ার কীভাবে গড়তে হয় কিছুই জানি না,
ইংরেজী জানি তবে খই ফুটে না মুখে,
টুকে পাশ করিনি কখনো,
কেতা কায়দায় মোটেও চালাক চতুর নই,
না হয় গাঁয়ের গন্ধ কথাবার্তা পােষাক-আষাকে,
অবশ্য এতে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে
যথার্থ বিরক্ত হবেন-ই যদিও, হে মান্যবর,
আপনারা কি জানতে চান আমাদের জীবনের পটভূমি
কোন্ পরিবার থেকে কীভাবে এসেছি,
কখনাে গাইড ছিল কি ছিল না,
রোড থেকে ক’মাইল হেঁটে যেতে হয় বাড়ি,
বাড়ি থেকে ক’মাইল দূরে হাইস্কুল,
ক’ পয়সা টিফিন পাই মাসে
সাদা খাতা কিনতেই কত টানাটানি,
সংবাদ পত্র কোনােদিন না পড়েই তার রচনা লিখেছি কিনা,
কোনােদিন কাদান রুপনি ক’রে ক্লাশে গেছি কিনা,
বিনা টিকিটেই ট্রেনে কখনাে চেপেছি কিনা, আর
বাপ মা-র ন্যূনতম স্বাক্ষরতা জ্ঞান ছিল কিনা,হে মান্যবর
আমাদের অনুপযােগী সাক্ষাৎকার নিতে নিতে
আপনারাও কি ফতুর হ’য়ে যাচ্ছেন?

২| একজন বেকারের বক্তব্য

কাজকাল বেকারত্বের জ্বালা বড়ো বেশী ক’রে বুঝছি।
বিশাল অঙ্কের পণ ছাড়া বর নেই, রাত্তিরে নিশ্চিন্তে
ঘুমোবার ঘর নেই, ঘরে বাইরে
কোথাও কদর নেই, বেকার শিক্ষার
আর কাল নেই, সংসারের হাল নেই, চাল ডাল
লকড়ি নেই, জুতাে নেই, জামা নেই, মামা নেই —
চাকরি নেই — ছুকরী নেই, বেঁচে কোনাে
সুখ নেই, দেখাবার মুখ নেই শুধু এই
অসুখেই দিনরাত ধুঁকছি আর
চাকরির দুঃস্বপ্নে ভুগছি।
আজকাল বেকারত্বের জ্বালা বড়াে বেশী ক’রে বুঝছি।
ধার-করা বই পড়ছি।
পত্রিকায় প্রেম করছি।
আড্ডা দিচ্ছি, হ্যাংলা হতচ্ছাড়া
বাউন্ডুলে হচ্ছি, বাড়িতে
গঞ্জনা খাচ্ছি আর খাচ্ছি দাচ্ছি বেরিয়ে যাচ্ছি, দু’বেলা
কর্মখালি ঘাঁটছি, ইতস্ততঃ দরখাস্ত ছুঁড়ছি,
কাজ খুঁজছি কাজ খুঁজছি কাজ খুঁজছি
আপনারা সিনেমা সার্কাস পার্ক প্রদর্শনী
জমজমাট করছেন, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার
ব্যালান্স ইনসুরেন্স পলিসি করছেন
আপনাদের নতুন নতুন স্ফূর্তির
ব্যবস্থা হচ্ছে, বেকারত্ব দূরীকরণের পন্থাপদ্ধতি
উদ্ভাবনের জন্য দেশের দশের নেতাগণ
নিম-নেতাগণ করছেন সভা-সেমিনার গোল-টেবিল,
দেশ-জোড়া কর্মকাণ্ডের সাহায্য আর, সময়-সংক্ষেপ
করতে আসছে কম্পিউটার, খােলামকুচির মতাে
যাচ্ছে সরকারী টাকা,
কাজ হচ্ছে, দেশ এগােচ্ছে
দিন যাচ্ছে, ‘এজ’ বাড়ছে —
ঘুরছি ফিরছি দেখছি শুনছি
কাজ খুঁজছি কাজ খুঁজছি কাজ খুঁজছি
মধ্যে মধ্যে মনের গাঙচিলগুলাে বেজায় চঞ্চল হ’য়ে উঠে।
ঘুম নেই, ঘুম নেই, গাঙচিলগুলো
পাখসাট খায় :
কর্মখালি, বিজ্ঞাপন, দরখাস্ত, ফর্ম, ফিস, পােষ্টাল অর্ডার, লাস্ট ডেট,
বইপত্তর, এ্যাডমিট, পরীক্ষা, রেজাল্ট,
ফর্ম ফিস্, পােষ্টাল অর্ডার, লাস্টডেট, পরীক্ষা
রেজাল্ট, ইন্টারভিউ, চাকরি, চকচকে
নােটের তাড়ার মতো সুপ্রসন্ন ভবিষ্যৎ
( কারাে কারাে ভবিষ্যৎ), গুটিকয়
বিজ্ঞাপন, লাখ লাখ কর্মপ্রার্থী, প্রচুর
পােষ্ট্যাল অর্ডার, লম্বা লাইন, অসংখ্য মুখ,ছেলে ও মেয়ের
অসংখ্য মুখ, মেয়েদের মুখ, পথ-চলতি মেয়েগুলোর
দেহ, ফিনফিনে সালোয়ার কামিজ, শ্লিভলেস লো-কাট ব্লাউজ, পিন-আপ
পত্রিকা, লাে-কাট ব্লাউজ, যুগল টিলার উদ্ভিন্ন ভাঁজ,মেদন্যূব্জ
নাভিমূল, গন্ধ-ভরা ঝোপ, কসমেটিকের তীব্র ঘ্রাণ, লাে-কাট ব্লাউজ, পিন-আপ – – –
অতি দ্রুত বুকের একান্ত ঘড়ি, প্রতিটি নি:শ্বাস
হাপরের প্রতিধ্বনি এবং মুহূর্ত্তকালেই…
শরীরের মীড়ে মীড়ে আত্মহননের বিদঘুটে ধিক্কার,করুণ অতৃপ্তির
মরীচিকা-দগ্ধ অবসাদ এবং অকথ্য
ঘিনঘিনে সর্বাঙ্গ, পােষাক-আশাক, বিছানা কাগজ-পত্তর ;
ঘুম পায়, ঘুম বড়াে ঘুম ; মনস্তাপে
ঝিমায় শরীর, ঝিমায় পৃথিবী, ঝিমায় দুঃস্বপ্নগুলাে
দূরতম নক্ষত্ররাজির সাজঘরে।
তবু
মধ্যে মধ্যে সুখের বেসুরো গান গেয়ে উঠে মগজের পাখি,
চাকরির দুরাশাগুলাে রাতের জোনাকি
সার্টিফিকেট সমস্ত যেন আস্তাকুঁড় অকেজো কাগজ
রাজ্যের অশ্লীল স্বপ্নে লিপ্ত হয় অলস মগজ,
বিভ্রান্ত দশায় দ্রুত লেগে যাচ্ছে লেগে যাচ্ছে যৌবনের কাঁচা কাঠে ঘুণ,
দুঃসাধ্য — তবুও বাছি অসহায় আত্মার উকুন
দিনরাত, ‘ট্রেজার আইল্যান্ড” লাগে উদুখলে চাকুরের কপি,
গড়ের মাঠ পকেটে নােংরা নোট মনে হয় আস্ত আশরফি,
চাকরির দুরাশাগুলাে রাতের জোনাকি,
মধ্যে মধ্যে সুখের বেসুরাে গান গেয়ে উঠে মগজের পাখি।
দোহাই আপনাদের, ওকে মারবেন না,
ওর ইচ্ছামতাে গান গাওয়ার অধিকারটু’-ও
দয়া ক’রে কাড়বেন না।
ধার-করা বই পড়ছি।
পত্রিকায় প্রেম করছি
আড্ডা দিচ্ছি, হ্যাংলা
হতচ্ছাড়া বাউণ্ডুলে হচ্ছি, বাড়িতে
গঞ্জনা খাচ্ছি আর খাচ্ছি, দাচ্ছি, বেরিয়ে যাচ্ছি,দুবেলা
কর্মখালি ঘাঁটছি, ইতস্ততঃ দরখাস্ত ছুঁড়ছি,
কাজ খুঁজছি কাজ খুঁজছি কাজ খুঁজছি
সমস্ত জ্বালার অগোচরে
সদাই আমার যৌবনের বিপন্ন সবুজ
অস্থির আত্মার রণ্ধ্রে বসন্তের গান গায় গান গায় গান গায়

৩| আলোমতি

জানলা খুলে’ দেখছি দুলে বোগেনভেলিয়া ফুল
থোকায় থোকায়, ওই ঝরোকায় দুলে হৃদয়কূল —
কোথায় কবে দেখেছি তবে এমন দৃশ্যরাজি ?
পাহাড়ে নাকি ? ভাবতে থাকি, ঝাড়তে থাকি ধুলো
স্মৃতির পথে, কোনোমতেই খোলে না গ্রন্থিগুলো ,
মন উদাসী শুকনো কাশি, অকাজের খই ভাজি —
ভাবতে থাকি , এটাই নাকি বেহেস্তের বিভাস ?
আমি তো নই কী বলে — ওই ভক্ত ধর্মদাস ,
তবে অকারণ কেন এ মোহন স্বর্গের হাতছানি
আমার কাছে ? —- সবুজ গাছে দৃশ্যপটের রাণী
হৃদয় খুলে’ দিচ্ছে তুলে নিজস্ব নজরানা
ভাবনাগুলোয় পাঠাও চুলোয় , খুল্লম খাজানা
গ্রহণ করো , হৃদয়ে ধরো শ্রেষ্ঠ কুদরতি
প্রকৃতিরাণীর মেহেরবানির অপার আলোমতি ।

৪| এই পৃথিবীর বন্ধু হও

মহাকাশে চলে তারায় তারায় কৃষ্ণগহ্বর আর্তনাদ,
অমনি ক’রে আমাদের দিবাকরও একদিন হবে বরবাদ —
ইয়াদ করো সেই দিনটা যখন সৌরজগৎ পড়বে ধ্বসে
বিজ্ঞানীরা এখনো পাননি তার দিনক্ষণ অঙ্ক কষে ।
এই পৃথিবী গ্রহটায় ব’সে করছি আমরা গৃহবিবাদ
মারণাস্ত্রের করছি লড়াই, গড়ছি পরম ধ্বংসবাদ,
বন্ধ করো এই গোঁয়ার্তুমি , এই পৃথিবীর বন্ধু হও
মানবিক আর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানেই ঋদ্ধ রও !
হও সব্বাই পৃথিবী-প্রেমী, হও সব্বাই অহিংস
মানুষ যদি না হয় সে প্রেমী, বাঁচবে কি এই প্রাণের বিশ্ব ??
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।