প্রাচীন মিশরের রাজাদের উপাধি ছিল- ফারাও। মিশরীয়রা মনে করতো , ফারাওদের মৃত্যুর পর যতদিন তাদের দেহ সংরক্ষণ করা যাবে ততদিন তারা স্বর্গে বাস করবেন। তাই মৃত্যুর পর তাদের দেহ মমি করে রাখা হতো। এতো গেলো প্রাচীন মিশরীয় রীতি। যার অস্তিত্ব আজ আর নেই। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তার মধ্যেই সবচেয়ে ক্ষমতাধর ফারাওয়ের এই আধুনিক যুগেই তৈরী হয় পাসপোর্ট আর তা করে মিশর প্রশাসন। একমাত্র এই প্রাচীন ফারাও বিদেশ যাত্রা করেন ও পান ভিন্ন দেশের আধুনিক মর্যাদায় সামরিক সম্মান। বিষয়টি অদ্ভুত! শুনে মনে হতেই পারে, প্রাচীন ফারাও প্রথা এখন আর মিশরে নেই তাহলে তার পাসপোর্ট, বিদেশী সম্মান কিভাবে ? আজ সেই সত্যি বলবো।
খৃস্টপূর্ব ১৬ – ১১ শতকের মধ্যেই মিশরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও সুদীর্ঘকালের ফারাও ছিলেন দ্বিতীয় রেমেসিস। তিনি ছিলেন মিশরের ১৯ তম রাজবংশের তৃতীয় ফারাও। খ্রিস্টপূর্ব ১২ শতকে তার রাজ্যাভিষেক ঘটে ও আনুমানিক দীর্ঘ ৬৭ বছর শাসক ছিলেন। যে কোনো ফারাওয়ের জন্য এটি দীর্ঘ সময়। দ্বিতীয় রেমেসিসের পিতা প্রথম রেমিসেস দ্বিতীয় রেমেসিসের ১০বছর বয়সে সেনাপতির দায়িত্ব দেন। মাত্র ১৪বছর বয়সে রাজপুত্র হিসেবে রাজ্য শাসন শুরু করেন। তারপর দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ২৫বছর বয়সে ‘ রাজা’ হিসেবে অভিষিক্ত ও অধিষ্ঠিত হন এবং ৯২বছর বয়েস পর্যন্ত ( আমৃত্যু) ফারাও হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন। তিনি’ রেমেসিস দি গ্রেট’ নামেই পরিচিত ছিলেন। মিশরীয় পুরাতাত্ত্বিক আধুনিক মিশর, সুদান ও ফিলিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে বহু সমাধি, মন্দির , প্রাসাদ ও দরগা আবিষ্কার করেছেন – যার সবগুলোই দ্বিতীয় রেমিসেসের সম্মানে তৈরী। এগুলোর মধ্যেই সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক থিবান নেক্রোপোলিসে অবস্থিত রেমেসিয়াম , আবুসিম্বল।
অতীতে কোনো ফারাও মারা গেলে নতুন ফারাও এসে তার পূর্ববর্তী ফারাওয়ের মূর্তির চেহারা বদলে নিজের চেহারা অঙ্কন করতেন। দ্বিতীয় রেমেসিসের মূর্তির চেহারা যাতে কেউ বদলাতে না পারে তাই তিনি অত্যন্ত গভীর রেখা দিয়ে মূর্তির চেহারা অঙ্কন করেন। অন্যান্য ফারাওদের মতো তিনিও অত্যন্ত আত্মমুগ্ধ ছিলেন। পিটা মন্দিরের সামনে তার ৯১টন ওজনের একটি বিশাল মূর্তিসহ একাধিক মূর্তি আছে। তার একটি মূর্তির ভগ্নাংশ ১৮২১সালের ব্রিটিশ মিউসিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়।
থিবান নেক্রোপোলিশ নীলনদের পশ্চিমতীরে অবস্থিত ফারাওদের কবরস্তান। ফারাওদের সমাহিত করার সময় তাদের মমির সাথে প্রচুর ধনসম্পদ দেওয়া হত। কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল – মৃত্যুর পর তারা মৃতদের রাজা হিসেবে আবির্ভূত হতেন। তাই সম্পদশালী না হলে, রাজার সম্মান ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। আবার ওইসব বহুমূল্য সম্পদ চুরি করতে অনেকেই পিরামিডে হানা দিতো। তাই পূর্ববর্তী ফারাওরা পিরামিডের বদলে পাহাড়ের অত্যন্ত গভীরে বিশেষ কুঠুরিতে সমাহিত করার প্রথা চালু করেন। প্রথানুযায়ী রেমেসিসকেও সমাহিত করা হয় রাজাদের উপত্যকার মূল সমাধি ক্ষেত্রে। যদিও সোখানেও আক্রমণের আশঙ্কায় এক পুরোহিত দ্বিতীয় রামেসিসের মমি ও ধনসম্পদ দেয়ার – এল – বাহারি নামক পাহাড়ের এক গোপন গুহায় লুকিয়ে রাখেন।
১৮৮১সালে আব্দুল- আল-রসূল এক রাখাল এই গোপন কুঠুরির সন্ধান পায়। যেখানে রামেসেস ছাড়াও ৫০টি রাজকীয় মমির সন্ধান পাওয়া যায়। তারপর পুরাতত্ত্ব বিভাগের তৎপরতায় রেমেসিসের মমি উদ্ধার করা হয় যা সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল। এমনকি ৩০০০বছরেও তার কোনো বিকৃতি ঘটেনি। ১৮৮৫সালে উদ্ধারের পর কায়রোতে মিউসিয়ামে রাখা হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সমস্যা ঘটে – মিউসিয়ামের কক্ষের আদ্রতায় মমিটি ধীরে ধীরে ব্যাকটেরিয়া আক্রান্ত হয়ে নষ্ট হতে থাকে , ধরতে থাকে পচন। মিউসিয়াম কতৃপক্ষ তা সংরক্ষণের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেন। কিন্তু সে সময় শুধুমাত্র ফ্রান্সে মমি পুনরুদ্ধারের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু ফ্রান্সের নিয়মানুযায়ী জীবিত বা মৃত কোনো ব্যক্তি ফ্রান্সে প্রবেশ করতে চাইলে অবশ্যই তার সাথে বৈধ ছাড়পত্র পাসপোর্ট থাকতে হবে। যেহেতু এই ঐতিহাসিক সম্পদটি টিকিয়ে রাখা মিশরের প্রধানও অত্যাবশ্যক কর্তব্য ছিল তাই মিশরীয় প্রশাসন ৩০০০বছরের মৃত ফারাওয়ের পাসপোর্ট তৈরী করে। আবার ফ্রান্স যাতে ওই মমি ফেরত পাঠানো নিয়ে কোনো আইনি জটিলতা না করতে পারে তাই মিশরীয় প্রশাসন ও বৈধ কাগজ তৈরী করে। ১৯৭৬সালের ৯ই মার্চ ৭ বছরের জন্য passport এর বৈধতা ধার্য হয়। পাসপোর্টে তার জন্মতারিখ দেওয়া হয় ১৩০২ খ্রিস্টপূর্ব। পেশা উল্লেখ করাহয় : রাজা ( মৃত ) এই প্রথম কোনো মৃত ফারাওয়ের পাসপোর্ট হলো ইতিহাসে।
রামেসেসকে বহনকারী বিমান লা- বুর্জে বিমানবন্দরে অবতরণ করলে রাষ্ট্রীয় সফরে আসা যে কোনো রাজার মতোই ফারাওয়ের মমিকেও তাদের সামরিক অভিবাদন জানানো হয়। একমাত্র ফারাও যিনি অন্যদেশের পূর্ণাঙ্গ সামরিক মর্যাদার অধিকারী হন। ফান্সের এথনোলজিক্যাল জাদুঘরে তার পরীক্ষা হয় , যাতে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। যেমন তিনি ৫’৭” লম্বা ছিলেন , ছিলেন আর্থারাইটিস, অঙ্কোলজিঙস্পন্ডিলাইটিস ( মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়ার সমস্যা ) ও দাঁতের সমস্যায় জর্জরিত। যাই হোক ফ্রান্স থেকে সতেজ হয়ে ফেরার পর তার ঠিকানা হয় আবার কায়রোর মিউসিয়ামে। প্রতিদিন প্রায় হাজার হাজার মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হয় তার।
বলা যেতেই পারে সংরক্ষণের কারণে হলেও একমাত্র এই সুপ্রাচীন ফারাও একমাত্র বৈধ পাসপোর্ট ও ভিন্ন রাষ্ট্রের সম্মানের অধিকারী হলেন। স্থাপিত হলো আধুনিকতার সঙ্গে সংযোগ তাও মৃত্যুর এতো হাজার বছর পর।