তিতলি এখন ঘরে একা। উমা মাসি আজ ছুটি নিয়েছে। তার মেয়ের অসুখ। জয়নগর গেছে। কালোও আসবে না। মেয়ের জ্বর কমলে আসবে।
কিন্ত তার মাকে দেখ, মা, মাএ দু দিন ছুটি নিয়েছিল। তারপর অফিস জয়েন করেছে। বাবার কথা বলে কোন লাভ নেই। বাবা দিল্লিতে
চাকরি করে।
বাবা মা আর সে। এই তিন জনের সংসার। দাদু মারা গেছে গত বছর। দুই কাকার সংগে বাবার ঝগড়া বাড়ি ভাগাভাগি নিয়ে। তারপর এই এতো বড় ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছে বাবা। দাদুর বাড়িতে তার খুব মজা হতো। কাকাদের দুই মেয়ে মানে তার দু বোন। তারা সকলে মিলে
খেলতো। বৃষ্টিতে ভিজতো। গান করতো। কত আনন্দ ছিল। এখানে সে একদম একা। জানলার সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখে। কখনো বারান্দায় চলে যায়। গাডি ঘোড়া লোকজন দেখে। কিন্তু মনের একা ভাব কাটে না। মাঝে মাঝে মনে হয় সে আসলে এই বড় ফ্ল্যাটে বন্ধী। এতটুকু ভালো লাগে না। বোনদের সংগে গল্প করে
ল্যান্ড ফোনে। মা এসব পছন্দ করে না। মা যখন অফিস চলে যায় তখনই গল্প করে। বোনরাও কখনো কখনো তাকে ফোন করে। নিজেদের ফেলে আসা দিনগুলির গল্প বলে। তিতলির তখন চোখ দিয়ে জল এসে যায়। বাবা একবারও ভাবলো না ফ্ল্যাটে তিতলি একা কি করে থাকবে? বড়রা শুধু নিজেদের কথাই ভাবে।
তিতলি বারান্দা থেকে ঘরে চলে এলো।
একোরিয়ামের কাছে চলে এল। বেশ বড় কাচের
বাক্স। তার ভিতর নীল জল। গাছ। ঝরনা। কত মাছ। রেড মলি। গোল্ডফিস। ফাইটার কিসিং
ফিস এঞেল আরো কত মাছ। যখন খুব একা
লাগে তিতলি চলে আসে মাছেদের কাছে। কাঁচের গায়ে মুখ লাগিয়ে কথা বলে মাছেদের সংগে। মাছেরা বলে-এই বাক্সের ভিতর আমাদের ভালো লাগে না। এতটুকু জায়গা। আমরা থাকি
সমুদ্রে। এখানে বড় একা লাগে।
তিতলি বলে–আমিও তো তোমাদের মতো বন্ধী।
কি করবো বলো?
-রেড মলি বলে-দেখলে কাল আমার বন্ধু মারা গেল।
তিতলি জানে কাল একটা রেড মলি মরে গেছে। তার জন্য তার মন খারাপ ছিল।
–মানুষ কেন বোঝে না বলতো আমাদের দু:খ।
ফাইটার বলল।
–বসার ঘরে একটা বাক্সে আটকে রেখে ওরা আনন্দ পায়। কিন্তু আমরা? কিসিং ফিস বলল।
–আমি কি করতে পারি বলো? আমিও তো তোমাদের মতো বন্ধী।
–তুমি পারো আমাদের মুক্তি দিতে।
–কি ভাবে?
—তুমি একটু ভাবো। তুমি তো স্কুলে পড়ো।
তিতলি সোফায় বসে অনেকখন ভাবলো। তারপর এক সময় উঠে দাঁড়াল। কিচেন থেকে
একটা কাঁচের জার নিয়ে এল। তারপর জাল দিয়ে একে একে সব মাছ গুলো তুলে জারের ভিতর রাখল। জারের অল্প জলে ওরা ছটফট
করছে। তিতলি ভারি জারটা দু হাতে নিয়ে
বাথরুমে চলে এল। তারপর জার থেকে একটা
একটা করে মাছ হাত দিয়ে তুলে ড্রেনের মুখে
ছেড়ে দিল। এক বালতি জল ঢেলে দিল ড্রেনের
মুখে।
তারপর সোফায় এসে বসলো। মনে বড় আনন্দ হচ্ছে। ওরা এখন মুক্ত। এই ড্রেনের জল রাস্তার বড় পাইপে চলে যাবে। এই পাপের জল
গংগায় গিয়ে পড়বে। গংগার জল গিয়ে মিশবে
মোহনায়। তারপর সমুদ্র ।ওরা ফিরে যাবে ওদের
মুক্ত সাগরে। কি আনন্দ! কি আনন্দ!
সন্ধ্যায় নমিতা ফিরে বলল-তিতলি ওষুধ
খেয়ে ছিলে?
–হ্যাঁ
–টেমপাচার নিয়ে ছিলে?
–হ্যাঁ
–কত আছে?
–একশো।
–খাবার খেয়ছিলে?
–হ্যাঁ
-গুডগাল তুমি।
তারপর ফেস হয়ে কফি নিয়ে টি ভি দেখতে
বসলেন নমিতা। হঠাৎ তার নজরে গেল
একোরিয়ামের দিকে। চিৎকার করে উঠল–
তিতলি মাছ গুলোর কি হলো?
–আমি ওদের ছেড়ে দিয়েছি।
–মানে?
–ওদের মুক্তি দিয়েছি।
–হোয়াট?
তিতলি কিছু বলে না। চুপ করে থাকে?
–কে তোমাকে বলেছে ওদের মুক্তি দিতে?
–আমি।
–কেন?
–আমি যে একটা মাছ।