শিকড়ের সন্ধানেতে আজ “মহারাজ কীর্তিচাঁদের বিজয় নিশান” – লিখেছেন দেবেশ মজুমদার

মহারাজ কীর্তিচাঁদের বিজয় নিশান
বা
বারোদুয়ারির ইতিহাস

শহরের কথা লেখা থাকে তার ইতিহাসে। ইট-কাঠের পরতে-পরতে জড়িয়ে থাকা সেই সব গল্পই বলে দেয় শহরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। বর্ধমান শহরে রয়েছে এমনি অনেক ইতিহাসের পদচিহ্ন। মহারাজ কীর্তিচাঁদ প্রতিষ্ঠিত বারোদুয়ারি তার অন্যতম নিদর্শন।

বর্ধমান শহরের পশ্চিমে কাঞ্চনগরে অবস্থিত মহারাজ কীর্তিচাঁদের বিজয়তোরণ বারোদুয়ারী। অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপত্য তোরণটির উচ্চতা প্রায় দশমিটার এবং প্রস্থ সাতমিটার। তোরণের মাথায় বারোটি ছোট ছোট দ্বার আছে। পূর্বদিকে আর পশ্চিম দিকে আছে পাঁচটি করে দ্বার। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে আছে একটি করে। দুদিকে চতুষ্কোণ খাঁজ কাটা থামে আছে। মাঝে মাঝে টেরাকোটার কাজ। দুটি থামের সংযোগ ঘটেছে খিলান দিয়ে । মাঝে প্রবেশ দ্বার। একেবারে শীর্ষে গ্রাম বাঙলার চালাঘরের ছাঁচে তিনটি দেউল। মাঝেরটি আকারে বড়ো, ঠিক পাল্কীর মতো দেখতে দু’পাশের দেউল দুটি ছোট।

অষ্টমবঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের স্মারক গ্রন্থ থেকে জানা যায় ১৬৯৬ খ্রীষ্টাব্দে চেতুয়া ও বরদার রাজা শোভা সিংহ ও আফগান সর্দার রহিম খাঁ মুঘল সম্রাট অওরেঙ্গজেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। দক্ষিণ দামোদরের মোগলমারি নামক স্থানে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী মুঘল বাহিনীকে পরাজিত করে। মুঘলদের স্নেহধন্য বর্ধমানের জমিদার কৃষ্ণরাম রায় তাদের পথ আটকায়। এই যুদ্ধে কৃষ্ণরাম রায় পরজিত ও নিহত হন। বিদ্রোহীরা কামান দেগে প্রাচীর ভেঙে বর্ধমান রাজবাড়ি দখল করেন। কৃষ্ণরামের পুত্র জগৎরাম রায় ঢাকার নবাব জবরদস্ত খানের রাজপ্রাসাদে আত্মগোপন করেন। শোভা সিংহের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা রাজ-অন্তঃপুরে প্রবেশ করে রাজপরিবারের মহিলাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। নিজেদের সম্মান রক্ষা করার জন্য ১৩ জন রাজপুরনারী বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন। এরপর শোভা সিংহ কৃষ্ণরামের কন্যা সত্যবতী ঘরে প্রবেশ করে তাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে, মাথার চুলের খোঁপার মধ্যে লুকিয়ে রাখা ছুরি দিয়ে তিনি শোভা সিংহ কে হত্যা করে নিজে আত্মঘাতী হন। শোভা সিংহের মৃত্যুর পর বিদ্রোহী গোষ্ঠী ফের দক্ষিণ দামোদর আঞ্চলে পালিয়ে যায় ও রাজবাড়ি দখলমুক্ত হয়।

১৭০২ খ্রীষ্টব্দে কৃষ্ণসায়রে স্নানরত অবস্থায় জগৎরাম নৃশংস ভাবে খুন হলে তার পুত্র কীর্তিচাঁদ জমিদারি লাভ করে। রাজপুরনারীদের উপর পাশবিক অত্যাচার এবং পিতা ও পিতামহের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধযাত্রা করেন। ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি শোভা সিংহের ভাই হিম্মৎ সিংহকে হত্যা করেন ও তার রাজ্য বরদা ও চেতুয়া (ঘাটাল ও মেদিনীপুর) দখল করেন। এছাড়া কীর্তিচাঁদ দক্ষিণবঙ্গের ছোট ছোট রাজ্য চন্দকোণা, তারকেশ্বর, বলাগড়, ভূরশুট, মনোহরশাহী, সেলিমাবাদ, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি জয় করেন। এই জয়ের স্মারক হিসেবে কাঞ্চননগর রাজবাড়ির সামনে থেকে পশ্চিম দিকে দামোদর পর্যন্ত পরপর বারোটি তোরণ নির্মাণ করেন। তখন বর্ধমান রাজবাড়ি ছিল কাঞ্চননগরে। এখন যে রাজবাড়িটি রয়েছে তা পরবর্তীকালে মহতাব চাঁদের রাজত্বকালে নির্মিত হয়। যদিও বর্তমান পুরাতন রাজবাড়িটির কোন চিহ্ন নেই এবং বারোটি তোরণের মাত্র একটি অবশিষ্ট আছে।

বারোদুয়ারি তোরণে দু’দিকে দুটি মার্বেল ফলক আছে। তাতে বাংলায় লেখা আছে, “বর্ধমানধিপতি বীরবর কীর্তিচাঁদ রায় চিতুয়া ও বরদার জমিদার শোভা সিংহ-এর পাশবিক অত্যাচারের প্রতিশোধার্থে তাহার ভ্রাতা হেম্মত সিংহ প্রমুখকে সম্মুখ সমরে ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের কিছুকাল পূর্বে পরাজয় করিয়া কাঞ্চননগরের প্রবেশদ্বার বারদ্বারী নামক স্থানে যে দ্বাদশটি বিজয় তোরণ সংস্থান করেন তন্মধ্যে এইটি মাত্র বর্তমানে তার এই প্রাচীন কীর্তি ঘোষণা করিতেছে”। এই একই কথা ইংরজি, হিন্দী এবং ফারসি ভাষাতেও লেখা আছে।
বর্ধমানের আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ নীরদবরণ সরকারের কথায় ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে মহারাজ বিজয় চাঁদের আমলে এই তোরণটির সংস্কার করা হয়েছিল। তখনই এই শিলালিপি গ্রথিত হয়েছিল কারণ মহারাজ কীর্তিচাঁদ এই তোরণটি স্থাপন করেছিলেন ১৭৩০ সালের কিছু আগে তখন বাংলাদেশে কোথাও ইংরেজি প্রচলিত ছিল না। বর্ধমানে তো নয়ই। তাছাড়া শিলালিপিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে সেই ভাষা অনেক আধুনিক।
বর্ধমানের আরেক আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ প্রয়াত সুধীরচন্দ্র দাঁ তার ‘ বারোদুয়ারির এগারোটি তোরণ ও কাঞ্চননগরের রাজবাড়ি কোথায় গেল?’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “ আমি যখন কলেজে পড়ি, প্রায় পঞ্চাশ- পঞ্চান্ন বছর আগে ডঃ পঞ্চানন মণ্ডলের সঙ্গে দামোদর ও বাঁকার তীর বরাবর অনেক ঘোরাঘুরি করি। ডঃ পঞ্চানন মণ্ডল তখন বর্ধমানে জৈন প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছিলেন। জৈন-দিগম্বর সম্প্রদায়গণ যেসব গুহায় থাকতেন, সেগুলি অনুসন্ধানই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। সেই সময় আমাদের ঐ তোরণটি দেখা মনে প্রশ্ন জেগেছিল, একটি মাত্র তোরণ বর্তমান, বাকিগুলো কোথায় গেল? তোরণের নাম এককথায় স্থানীয় ছেলে-বুড়ো সবাই বলে, বারোদুয়ারি। সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন প্রায় ৯০ বৎসরের এক বৃদ্ধ নাম পঞ্চানন দাস। তিনি আমাদের নিয়ে গিয়ে কয়েকটি ভগ্নাবশেষ দেখিয়ে বলেন, এখানে আরও দু-তিনটি তোরণ তিনি ধসে যাওয়া অবস্থায় দেখেছেন। বিশাল রাজবাড়ি কোথায় গেল? এই প্রশ্নের তিনি জানান, দামোদরের ধারে এই রাজবাড়ির ধ্বংসস্তুপ তিনি দেখেছেন, কিছু অংশ দামোদরের গর্ভে চলে যায়। বাকি অংশে ছোট ছোট ইট মজবুত ছিল তা লরি করে পাচার হতে তিনি দেখেছেন। এখন সবটাই দামোদর খেয়ে নিয়েছে”।
ভূগোলবিদদের মতে দামোদরের তীরবর্তী অঞ্চলের উপত্যকা রিফট ভ্যালি, তাই দামোদর তীরবর্তী অঞ্চল কোথায়াও উঠেছে বা বসেছে। যেমন গন্ডোয়ানা ল্যান্ডের চাপে টেথিস সাগর থেকে আস্ত হিমালয় উঠে এসেছে,আবার সংযুক্ত ভূখণ্ড বসে গিয়ে অষ্ট্রেলিয়াকে পৃথক ও বিচ্ছিন্ন করেছে। কাঞ্চননগরের রাজবাড়ি ও এগারোটি তোরণ অনুরূপভাবেই ভূগর্ভে ডুবে গিয়েছে। আজও দামোদরের বাঁধের ধারে ইদিলপুরের বাঁধের ডানদিকে মাটিতে চাপা পড়ে যাওয়া মন্দিরের মাথা দেখতে পাওয়া যায়।

বর্ধমান ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব চর্চা কেন্দ্রের সম্পাদক সর্বজিত যশ তার ‘বন্যাবিধ্বস্ত বারোদুয়ারিঃ তর্ক ও যুক্তি’ প্রবন্ধে লিখেছেন দামোদরের বিধ্বংসী বন্যায় তলিয়ে গিয়েছে বাকি তোরণ গুলি। ১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বন্যায় বর্ধমান ২৭ বার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। এই তোরণটি রক্ষা পেয়েছিল কারণ এটি কাঞ্চননগরের পূর্বদিকে মূল পথের ওপর অবস্থিত ছিল। দামোদরের বন্যায় ধাক্কা অনেক কম লেগেছিল বলেই হয়ত তোরণটি অক্ষত থাকে।
দীর্ঘদিন ভগ্নাবস্থায় পড়ে থাকার পর ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সহায়তায় বর্ধমান পৌরসভা বারোদুয়ারির সংস্কার করে। সংস্কারের পর মুছে গেছে টেরাকোটার কাজগুলি। ৩৫০ বছরেরও বেশি পুরানো সংস্কারকৃত বারোদুয়ারি আজও উড়িয়ে চলেছে মহারাজ কীর্তিচাঁদের বিজয় নিশান।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।