গল্পবাজে দেবব্রত মাইতি

পরিযায়ী

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়ি ফেরা অশোকের, হাতে থাকা রোজের টাকাটা নিতান্তই ছোট সামলাতে এই বড় সংসার। অশোকের সারা হাত সাদা হয়েছে ধুলো মেখে, এক চিলতে কাপড় কাচা সাবানের বুদবুদ নেমেছে ম্যানহোলে ময়লা পরিষ্কারে। বিছানায় এসে বসতেই খিদে নামক আগুনে ঘি পড়ে, মাকে খুঁজতে গিয়ে রান্নাঘরের দিকেই নজরে আসে মাটিতে পড়ে থাকা দেহটা। সেইদিন একসাথে পুড়তে দেখেছিল অশোক দুটি ভিন্ন অস্তিত্ব, এক তার মাকে দ্বিতীয় জন হাড়ির নীচের আগুনে পুড়তে থাকা ভাত। বাবাকে ছোটবেলায় বিদায় জানিয়েছিল অশোক, ছোট ভাইটা তখন সবে সদ্যোজাত, চোখজোড়া তখনও ভালোভাবে দেখেনি জগৎ। আজ সেই ছোট্ট শিশুটাও বুঝতে শিখেছে চিতাতেই সব শেষ।
লোকমুখে শোনা, বিশাল বড় শহর মুম্বাই যেখানে ডানা মেলে উড়তে থাকে টাকা, শুধু মুঠোয় ভরার অপেক্ষা। কিন্তু সুবিশাল শহরে সুযোগ আসেনা সহজে, প্রতিটা সেকেন্ডে চলে লড়াই অস্তিত্ব রক্ষার। অশোকের প্রতিটা লড়াইয়ের সাক্ষী থাকা নিমাই সুযোগ করে দিয়েছিল কাজের বড় শহরে, সব কিছু ছেড়ে যেতে হবে পশ্চিমের বড় শহরটাতে। একটা বড় পরিযায়ী দল বাসা ছেড়ে উড়ে যাবে বড় শহরে দীপাবলির রাতে, নাম লিখিয়েছিল অশোক পরিযায়ী ভীড়ে। ঘরকুনো ছেলেটা কখনও চেয়ে দেখেনি চৌহদ্দির বাইরে, কেমন এই অজানা পৃথিবী নেই কোনো বাস্তব অভিজ্ঞতা। তবুও যেতে রাজি অশোক, নিজে ব্যর্থ হলেও ভাইটাকে পৌছে দিতে হবে আলোপথে।
দীপাবলির রাতে যখন সারা বিশ্ব জ্বেলেছে আলো, পৃথিবীর এক কোণের এক অখ্যাত গ্রামের এক অখ্যাত বাড়িতে নেমে এসেছে আঁধার কালো মেঘ, সবকিছু পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে হবে আলোকসন্ধানে পরিযায়ী হয়ে। কয়েকশো কিমি পার করে নতুন ভুবনে নতুন ভাবে শুরু করতে হবে জীবনচিত্র। শেষ একটিবার ফিরে তাকাল অশোক ফেলে আসা পথে, কোনোকিছু ফেলে গেল কি না শেষ আর একটিবারের মতো মিলিয়ে নিল চোখজোড়া। গোয়ালের গরু স্থান পেয়েছে শিলা জেঠিমার কাছে, ভাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে পিসির কাছে, গোলা ভরা ধান চাল হয়ে পাড়ি দিচ্ছে অশোকের সাথে জোগাতে কিছু দিনের খোরাক। না আর কিছু করার নেই অশোকের বাড়িতে তালা দেওয়া ছাড়া, দ্রুত পা বাড়াতে হবে পশ্চিমপাড়ে বড় রাস্তার ধারে যেখানে অপেক্ষায় আছে তারই মতো পরিযায়ী পাখিরা, যারা প্রস্তুত বাসা ছেড়ে উড়ে যেতে। দরজার আর তালার সম্পর্কটা এবারে দীর্ঘ, কবে পাবে দুজনে মুক্তির স্বাদ, অজানা। চোখে জল এলেও সামলে নিয়ে এগিয়ে গেল অশোক, দুরে সরিয়ে কিছু পিছুটান এভাবেই উড়ে যেতে হয় পরিযায়ীদের।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।