শিকড়ের সন্ধানেতে আজ “বর্ধমানের কঙ্কলেশ্বরী কালী” – লিখেছেন দেবেশ মজুমদার

বর্ধমানের বিখ্যাত কাঞ্চন উৎসবের মাঠ। শান্ত মনোরম পরিবেশে বিস্তৃত মাঠের পাশে বয়স্কদের সময় কাটানোর জন্য অবসারিকা পার্ক। বাঁধানোপুকুরের চারপাশে নানান গাছের জটলা। শান বাঁধানোঘাটে রঙিন মাছেদের আনাগোনা। পুকুরের মাছেদের মুড়ি খাওয়ানোর জন্য ভিড়ও হয় এন্তার। প্রধানত যে জন্য দুরদুরান্ত থেকে মানুষ এখানে উপস্থিত হন তা হল কঙ্কালেশ্বরী কালীমন্দির। বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগরে অবস্থিত একটি বিখ্যাত এবং প্রাচীন কালী মন্দির। কাঞ্চন নগর বিখ্যাত ছুরি-কাঁচির জন্য। এছাড়াও ঐতিহাসিক মতে, প্রাচীন গৌড় বঙ্গে, কাঞ্চন নগর ছিল গৌড় অধিপতি শশাঙ্কর প্রধান কার্যালয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একটি আশ্রম স্থাপন করেছিলেন সাধনমার্গের মানুষ কালীচৈতন্য ভারতী। এই আশ্রম প্রাঙ্গনেই স্থাপিত ছিল একটি নবরত্ন মন্দির। এর নির্মাণ কাল ১৪৮৬-১৫৫৩ সালের মধ্যে। ১৯১৩ মতান্তরে ১৯১৬ সালে এই মন্দিরেই প্রতিষ্ঠা করে হয় কঙ্কালেশ্বরী কালীকে। মূর্তিটি কিভাবে পাওয়া যায় এই নিয়ে দুটি ভিন্ন মত রয়েছে। শোনা যায়, ১৯১৩ বা ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে (মতপার্থক্য আছে) দামোদর নদের বন্যা বর্ধমান শহরের এই অঞ্চলকে পুরো ভাসিয়ে দিয়েছিল। বন্যার জল নামার পর দামোদরের গর্ভ থেকে উদ্ধার হয়েছিল কষ্ঠিপাথরের এই দেবীমূর্তি। কমলানন্দ পরিব্রাজক নামে এক সাধক স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই দেবীমূর্তিটি সংগ্রহ করে কাঞ্চননগরের এই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন বলে জানা যায়। এছাড়াও দেবী কঙ্কালেশ্বরী কালীর আবির্ভাব প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনা কথিত আছে।ঘটনাটা এরকম…
অনেকের মতে ১৯১৩ সালে (১৩২০ বঙ্গাব্দ) এক ভায়াবহ বন্যা হয় দামোদরে। এত ভয়ংঙ্কর এই বন্যা হয় যে জনসাধারণের কাছে একটা বিভীষিকার রূপ নেয় এবং এই বন্যা বিশ সালের বন্যা নামে খ্যাত। এই বন্যায় মূর্তিটি ভেসে এসে মুসলমান অধ্যুষিত চৌধুরী দহে বর্তমান নাম কালীদহে এসে উল্টোভাবে পরে ছিল। তারপর রজকেরা ঐ পাথরের উপর কাপড় কাচার জন্য ব্যবহার করে। এইভাবে ঐ মূর্তির উপর কাপড় কাচা চলতে থাকে। বাংলা সনে ১৩২৩ সালে আষাঢ় মাসে ভূমিকম্পে তালবোনার পাশে ঐ দহতে ফাটল ধ্বসে পরে ঐ পাথর উল্টে গিয়ে দেবীর মূর্ত্তি বার হয়। তখন মুসলমান পাড়া, তেলি পাড়া, মালিপাড়া, তালবোনার বাসিন্দাগণ এই সংবাদ বর্ধমান মহারাজার গোচরে আনেন। বর্ধমান মহারাজা সপরিষদ ঐ স্থানে উপস্থিত হন এবং দেবী মূর্তিটিকে আষাঢ় মাসের উল্টো রথের দিন ঐ মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন। খুব সম্ভব ঐ মন্দিরটি বিষ্ণু মন্দির ছিল। তারপর মহারাজ ঐ অঞ্চলে কিছু জমি, বাগান প্রভৃতি স্থানীয় বাসিন্দাদের দিয়ে তাঁদেরই মায়ের সেবাইত করে দেন। এইভাবে দেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

কঙ্কালেশ্বরী মূর্তিটির বয়স আজ পর্যন্ত নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। তিন ফুট চওড়া ও পাঁচ ফুট লম্বা একটি বড় কালো রঙের ব্যাসাল্ট পাথরের ওপরে খোদিত মূর্তিটি আজও গবেষণার দাবী রাখে। ঐতিহাসিকদের মতে, এই ধরণের মূর্তি, আর্য্য পূর্ব যুগে নির্মিত হত। মূর্তিটিতে মানুষের কঙ্কাল, স্নায়ুতন্ত্র ইত্যাদি পরিষ্কার ভাবে খোদিত। পুরাতত্ত্ববিদদের মতে, এই মূর্তি বৌদ্ধ বা পাল যুগের। দু হাজার বছরেরও বেশি প্রাচীন। মানব দেহের প্রতিটি শিরা উপশিরা খোদাই করা রয়েছে দেবীমূর্তিতে। দেবীর পদতলে মহাকাল শিব। দেবীর আটটি হাত। ডানদিকে চারটি হাতে তরোয়ার, ডুমরু, শুলদণ্ড ও পানপাত্র। বাঁদিকে চারটি হাতে মধ্যে তিনটি হাতে আছে যথাক্রমে অস্ত্র, ঘন্টা ও মুণ্ড। এবং অন্য একটি হাতের কড়ি আঙ্গুলটি তিনি দাঁতে কামড়ে রেখেছেন। দেবীর মাথার ওপরে একটি হাতি, গলায় নরমুণ্ডের বিশাল মালা, দেবীর পায়ের দুদিকে দুটি ছোট ছোট মূর্তি। ডানদিকে একটি বিবস্ত নারীমূর্তি। বাঁদিকে একটি পুরুষমূর্তি। যার কাঁধে আছে একটি মরদেহ। অসামান্য এই মূর্তিটি ঠিক যেন একটা কঙ্কাল। বর্ধমানের আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ সুধীর চন্দ্র দাঁ তার বর্ধমান শহরের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে লিখেছেন- “ মূর্তিটি প্রাগার্যযুগের অনার্য দেবীসম্ভুত যক্ষিণী মূর্তি। এখানেই বহু যুগ হতে পূজিতা হতেন। অনার্য বোড়ো, ডোম, কিরাত ও শবর প্রমুখ জাতি গোষ্ঠী তাদের মৃত দেহ কবরস্থ না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে জড়ো করে রাখত। সেই মৃতদেহের কংকালের পাশেই এই মূর্তি তন্ত্র সাধনায় মদ্য, মাংস সহযোগে পুজা পেতেন”। পরবর্তীকালে বিন্দাবন দাস এই চিত্র তুলে ধরেছেন-

“বাশুলি পূজায় কেহ নানা উপচারে।
মদ্য মাংস দিয়া কেহ যক্ষ পুজ করে”।
এই অস্থিময় স্থানকে বলা হত অস্থিগ্রাম বা অস্থিক গ্রাম এবং মূর্তিও তাই কঙ্কালেশ্বরী। এই অস্থিমগ্রামেই খ্রীঃপূঃ ছয়শত বৎসরে এসেছিলেন চব্বিশতম জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর বর্ধমান। যে স্থানটি অস্থিক গ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা হল বাঁকা নদীর তীরবর্তী মহন্তস্থল থেকে উত্তরে বল্লুকাতীরে বাহির সর্বমঙ্গলা এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল বা গ্রাম। মূর্তিটি কালো মাইকাসিল্ট পাথরের উপর কুঁদে তৈরি করা অষ্টভুজা চামুণ্ডা মূর্তি। মূর্তির বৈশিষ্ট্য হল- দেহের কঙ্কাল, ধমনি, শিরা, উপশিরা, স্নায়ু অসামান্য দক্ষতার খোদাই করা। শিল্পীর শরীর বিজ্ঞানে প্রগাঢ় জ্ঞান বিস্মিত করে।বর্ধমানের বিশিষ্ট্য চিকিৎসক ডঃ তন্ময় দত্ত রায়ের কথায়- “নারীদেহের যে অগণিত শিরা উপশিরা তাকে বাঁচিয়ে রাখে এবং ভয়ঙ্কর উত্তেজনাকালে তাকে শৌর্যশালিনী করে তোলে, এই মূর্তিতে তাই প্রত্যক্ষ হয়েছে। মানবদেহ সম্পর্কে গভীর ও সতর্ক পর্যবেক্ষণ না থাকলে এমন মূর্তি নির্মাণ করা যায় না”।কাল পাথরের ওপর খোদিত এই অসামান্য মূর্তিটি এদেশের একটি শ্রেষ্ঠ ভাস্কর্য শিল্প।মন্দির দক্ষিণমুখী এবং তারই সামনে নাট মন্দির। মন্দিরের পশ্চিমে একটি বেলগাছ এবং তার তলায় একটি কাল পথরের শিবলিঙ্গ। এটি একটি নবরন্ত মন্দির এবং এই নবরত্ন মন্দিরেই দেবী অধিষ্ঠতা আছেন। মন্দিরের উপরে একটি ছোট পাথরে খোদিত আছে “শ্রীশ্রী সর্ব্ববিদ্যা মন্দির” উত্তম আশ্রম।সংস্কারের ফলে মন্দিরের প্রাচীন রূপ এখন অনেকটাই পরিবর্তিত।তবুও এখনও মন্দিরের টেরাকোটার কারুকাজও দেখার মতো। মন্দিরগাত্রে পরতে পরতে রয়েছে পোড়ামটির মূর্তি। মন্দিরের নির্ম্মাণকাল দশম থেকে একাদশ শতাব্দীর। দেবীর নিত্যপুজো হয়। প্রতি অমাবস্যায় আগে ছাগ বলি হতো তবে এখন শুধুই পুজো হয়। বার্যিক কালীপুজোয় ধুমধাম করে পুজো হয়। দূর দূরান্ত থেকে প্রচুর মানুষ আসেন দেবীর দর্শন লাভের জন্য।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।