কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে এস মিঞা ওমরান (পর্ব – ৩)

মাছ

অগ্রহায়ণ মাসের শুরু।
ইংরেজি নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়। প্রকৃতিতে তখন আস্তে আস্তে শীতের প্রারম্ভিক। কিন্তু বাতাসে কনকনে ঠান্ডা অনুভব হয়। শেষ রাতের দিকে একেবারে হাড় পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়।
এবার মনে হয় হাড় কাঁপানো শীত পড়বে। গ্রামের সবাই বলাবলি করতেছে। তারই পূর্বাভাস নাকি প্রকৃতি দিচ্ছে। গতবছর ইটের ভাটায় যাওয়ার সময় কয়েক জন বয়স্ক লোককে দেখে যাই।পরে ইটের ভাটায় হইতে ফিরে আর কাউকে দেখিনি।
খবর নিয়ে জানলাম তারা সবাই প্রচন্ড শীত পড়ায় মারা গিয়েছে। আসলে প্রকৃতির লীলাখেলা এখন বুঝা যায় না।বিগত কয়েক বছর হইতে পরিবেশ বিরূপ আচরণ করছে। শীতের সময় ভীষণ ঠান্ডা। গরমের সময় প্রচুর গরম পড়ে। দিন দিন পরিবেশ যেন প্রাণীকুলের জন্য এক মহাত্রাস হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কি আর করব আমাদের সবার ত প্রকৃতিকে ঘিরে জীবন। জন্ম এখানে মৃত্যুও এখানে। কথাগুলো বলছিল গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর আজগর আলী তার বৌকে।
দে বৌ।
একখানা পান দে।
প্রক ৃতি নিয়ে ভাবলে চলবে না।আমরা গরীব মানুষ। আমাদের কর্ম ছাড়া ভাত জুটবে না
কিন্তু সে সহসা পান নিয়ে এলো না।
আজগর আলী পুনরায় তাড়া দেয়।কই গেলে আমেনার মা। জলদি করো। আমি আবার পুবের ক্ষেতে যেতে হবে। জমিন খানা দেখে আসি।আর বোধ হয় সুযোগ পাব না।এদিকে মাঝি খুব তাড়া করতেছে ইটের ভাটায় লোক নেওয়া শুরু হয়েগিয়েছে।আগামী সপ্তাহের মধ্যে মনে হয় যাওয়া পড়বে। এদিকে জমিতে ধানও পাকা শুরু হয়েছে। মনে করছিলাম আমিসহ থেকে জমির ধান কেটে নিয়ে আসব। নতুন ধানের নতুন খেয়ে যাব।কিন্তু তা আর হবে না। এবার ভালো ধান হয়েছে। প্রতি গন্ডায় মণ হবে। বুঝছিস বৌ।জমিতে পাকা ধান আর গৃহে সুন্দরী বৌ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শোভা।
আচ্ছা যাক।
আমেনাকে দিয়ে মোরগটি জবাই করে ভালোভাবে রান্না করে নেয়। দুই জন লোককে দুপুরের জন্য দাওয়াত দিয়েছি। গ্রামের মধ্যে এখন তারা দুইজন সবচেয়ে বয়স্ক। আমেনা কই?দেখি না যে।
আছে কোথাও। তার স্ত্রী বলে।
মনে হয় পাশের বাড়িতে গেছে।
যাই ঘুরে আসি।আবার দুপুর হইতেছে।এ কথা বলে আজগর আলী আর অপেক্ষা করলো না।দ্রুত বাড়ির বার হয়ে যায়।
কাকা ভাত দিই তার উত্তরের অপেক্ষা না করে আবার জিজ্ঞেস করে। চাচী আপনার কি লাগবে?দুজনেই মুখের ভিতর ভাত পুরে দিয়ে মাথা নেড়ে না করলেন। কিছু লাগবে না।তারপর ভাত চিবাতে চিবাতে তাকে জিজ্ঞেস করল। কেন আজকের এ আয়োজন?
তখন আজগর আলী বলে আমি ইটের ভাটায় চলে যাবত।আবার কবে কার সাথে কার দেখা হয় না হয়। তাই অনেক দিন ধরে ভাবতেছি আপনাদের দুইজনকে নিয়ে একবেলা খেয়ে যাব।
মনে করছিলাম আর ইটের ভাটায় যাব না।কারণ এ কাজ অনেক কষ্টের। আর সহ্য হয় না।তাছাড়া মাঝিরা অমানবিক জুলুম করে।কি অসুখ, কি বিসুখ তাদের শুধু একটা কথা কাজ করে যেতে হবে।
কিন্তু তা আর হল না।
বন্যার বিষাক্ত ছোবলে ঘরের অনেক ক্ষতি হয়।তাই ঘর মেরামত করার জন্য আবার ইটের ভাটায় বিক্রি হতে হয়। এখন কিছু কাজ বাকি আছে। এবারের বন্যা ব্যাপক ক্ষতি করে যায়। অনেকের ঘর বাড়ি পানির নিচে ডুবে যায়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেড়ীবাঁধের দক্ষিণ অঞ্চলের মানুষগুলো। ঐই অঞ্চল ছিল নিচুস্তর। এদিকে বৃষ্টির পানি অন্য দিকে সাগরের পানিও চাপ দিতে থাকে। ফেনি মুহুরি নদীর বাঁধ ছিড়ে যায়। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা আসছিলো বেড়ীবাঁধ কাঁটার জন্য। আমরা শোনা মাত্র তাদেরকে বাধা দি।এক পর্যায়ে তাদের সাথে আমাদের বিরোধ হয়ে যায়। সংঘর্ষে অনেক ছেলে বুড়ো আহত হয়।পরে গেদু মেম্বারের মধ্যস্হতায় বিরোধ নিষ্পত্তি হয়।কিন্তু রাতে যখন গ্রামবাসি ঘুমিয়ে পড়ে তখন তারা গভীর রাতে এসে ভেড়ির বাঁধ কেটে দে।জোয়ারের পানি ঢুকে গ্রামের সব ঘর বাড়ি পানির নিচে তলিয়ে যায়। কোনোভাবে রাতটা পার হয়।সকালবেলা যে যেদিকে পেরেছে অবস্থা নিয়েছে। এলাকার মাছ চাষি সফিউল পুকুরের মাছ ধরে রাখার জন্য কতকিছু করল। কিন্তু কিছুতে কিছু বধ ধরল না।
যেদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পানি আর পানি। পানির নিচে ডুবে থাকা ধান গাছগুলো মাথা তুলে দাঁড়াতে চায়। বানের স্রোত আবার মাথা গুলোকে নুয়ে দে।কৃষক তার কপাল চাপড়া আর আপসোস করে এবার মহাজনের অনেক ঋন দেনা হয়ে যাবো। তেমনি একজন আবুল কৃষক। সে সুদের উপর টাকা নিয়ে জমি বর্গাচাষ করে। জমিতে ফসল হলে তা বিক্রি করে তার দেনা শোধ দিবে। সর্বনাশী বন্যা তার কৃষাণ মনের লালিত স্বপ্নকে সলিল সমাধি দিয়ে যায়।
আমার সকল আশা-আকাঙ্ক্ষা নসাৎ হয়ে গেল। যখন বলতেছিলো তখন তার দু’চোখে যেন সহস্র শ্রাবণের জল টলটল করতে ছিল।
দশ দিক হইতে দশ জন বৃষ্টি আর বানের পানি পায়ের নিচে পতিত করে মিলিত হয় কাসেমের দোকানে। তার দোকান ভেড়ি বাঁধের উপরে। তাই বানের জল তাকে ছুঁইতে পারে না সেখানে উপস্থিত সবাই এক কন্ঠে মিলিত হয়েছিল বন্যার পরে ঐ গ্রামের লোকজনের সাথে এটা নিয়ে একটা বিহিত করতে হবে। এভাবে রাতের অন্ধকারে কেন ভেড়ির বাঁধ কাঁটল।
কই।
কিছু হল না।আরেকটা বর্ষা ঘনায়েছে। আজগর আলী বলে।
চলবে….
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।