কথায় বলে– সব ভালো, যার শেষ ভালো। পিকনিকের ঐ শেষটায় একটু সবার মনটা খিটখিটে করে তুলেছিল ঐ যা, বড়দের সাথে ছোটদের- ও। তবে সব কথাই যে সর্বৈব সত্যি কথা তা কিন্তু নয়, কিছু কথা কথার কথা। বাদবাকি সারাদিনের খুব ভালোলাগাটা সারাজীবন এই এখনও পর্যন্ত মনে আছে সেইজন্য। কত ভালো ভালো কথা মহাপুরুষরা বলে গিয়েছেন, বেদবাক্য সব, তা কি আমরা মানি? মানিনা। মানলে তো আমাদের সবার ভালই হত। এবার স্মৃতিকথার গল্পে ফিরে আসি, অবশেষে শীতের রাত সাড়ে-আটটায় বাড়িতে ঢুকলাম সবাই সেদিন।
সে- সময় শিলিগুড়ি শহরে অন্যান্য জায়গার মতনই বেজায় শীত পড়ত ডিসেম্বর- জানুয়ারি মাসে। কারণ এত লোকজন বহুতল দোকান বাজার কিছুই ছিলনা সেরকমভাবে শহরে। আমরা চুটিয়ে পাড়ার খোলা মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। দলবেঁধে আইস- বাইস ধাপ্পা খেলা চলত। জমাট বাঁধা ঠাণ্ডা, রাত নটাতে বিছানায় লেপের তলায়। এখন তো লেপ সেকেলে হয়ে গিয়েছে। রেজাই, ব্ল্যান্কেট, পশমের চাদর এইসব। আমার সেই পুরানো লেপ- তোষকের কথা খুব মনে পড়ে। আর পুরানো লেপ- তোষকের সাথে মায়ের মুখটিও কেমন যেন মনে পড়তে থাকে। শীতের শুরুতে মায়ের লেপ- তোষকের রোদে দেওয়া, ওয়ার পড়ানোর সেই ব্যাস্ততা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার দিদিমার তৈরী একটি নকশীকাঁথার কথাও খুব মনে পড়ে যা হাল্কা শীতে আমার গায়ে দিতে কী যে ভালো লাগতো! ধুনকারদের বাড়ির পাশে ফাঁকা মাঠে টুংটাং শব্দে সুর তুলে তুলা ফেটানো আরও কত কী স্মৃতিতে ভেসে ওঠে!
এখন যেমন শীতের শীর্ণকায়া মহানন্দা নদীর দিকে তাকানো যায়না। তখন কিন্তু জলের ধারা অল্প হলেও নদীর দিকে তাকানো যেত। অবশ্য শহরের সবেধন নীলমণি তখনকার একমাত্র মহানন্দা সেতু থেকে সকালে বিকেলে প্রাতঃকৃত্যের বিসদৃশ এক ছবি দেখা যেত। সেসব থাক, সুন্দরের আলোচনাই হোক, আমাদের পাড়া থেকে খুব কাছে ছিল মহানন্দা নদীর রামঘাট। ওপারে খেত- খামার বনকুলের ঝোপ, গ্রীষ্মকালে নদীর পাড়ে বালিমাটিতে ঢ্যাড়স- ভুট্টার চাষ হতো। পতিরাম জোতে বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমাটোর খেত দেখা যেত। সে সময় কিশোরদের সবসময় চোখের মধ্যে ধরে রাখবার প্রবণতা বাবা- মায়ের মধ্যে ছিলনা বা পরিবেশ ছিল উন্মুক্ত।
(দূষণ মুক্ত সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ শহর থেকে আর একটু দূরে ..।এপ্রিল ১৩ ,২০২১. ফটো সৌজন্য : পাপুন ভট্টাচার্য্য নেচার ফটোগ্রাফার শিলিগুড়ি)
কিশোরীদের অবস্থা একই রয়েছে। সেদিনও যা, এখনও তাই। তাদের একটা গন্ডী কাটাই থাকতো। তোমরাও সঙ্গে-সঙ্গে কিশোর- কিশোরী উভয়েই এখন কিন্তু ঐ গন্ডীতে বন্দী বা সময়ের কাছে বাঁধা। । মাঝে- মাঝে তাই ভাবি, যে সভ্যতা মানুষকে শত টেকনোলজি বিভিন্ন আবিষ্কারে এগিয়ে দেয়নি, তাকে কী উন্নত সভ্যতা বলা চলে? একটু কঠিন মনে হতে পারে তোমাদের কাছে বিষয়টা, তবে অল্প বয়স থেকে কিছু কঠিন ভাবনা না ভাবলেও চলে না।
আমরা পাড়ার একদঙ্গল সমবয়সী কিশোর একবার হাঁটু সমান জলের গভীরতার মহানন্দা পেরিয়ে রামঘাটের ওপারটায় গেলাম। শীতের বিকেলে তিনটে নাগাদ। খেতের আঁকা বাঁকা আলপথ ধরে দূরে ঐ যে উঁচু বাঁধ ওখান পর্যন্ত যাব। দেখব ঐ বাঁধের ওপারের নদীটিকে। আর একটা নদী লুকিয়ে আছে বাঁধটির পরেই শুনেছি। হাঁটছি আমরা সবাই। বাড়িতে জানে ছেলের দল খেলার মাঠে। সবাই গুলতানি করতে করতে চলেছি।
(ফটো সৌজন্য: গৌতম বাড়ই)
জলকাদামাখা একটি গর্তে দেখলাম কিছু কাঁকড়াকে, খুব ছোটো- ছোটো। শীতে গর্তের জল শুকিয়ে এসেছে। কেউ- কেউ হাত দিয়ে ধরতে গেল আর কেউবা না না করে উঠলো। ঐ ছোটোবেলায় যেমন হয়। একটা সতেজ অনাবিল আনন্দে হেঁটে যাচ্ছিলাম বন্ধুরা। একটা ছোটো তির- তির করে বয়ে যাওয়া খালের মতন পড়ল। চামড়ার চপ্পল ভিজিয়ে ওপারে গেলাম। বাঁশঝাড় আর একটা কলাগাছের ঝোপ। পাখিদের কিচির মিচির আর একদঙ্গল টিয়েপাখিকে ঐ ঝোপের ধারে দেখলাম। তিন চারটে সাদাবক খালের পাড়ে মৌনী হয়ে বসে। একটা পালোয়ান মতন লোক আমাদের দিকে হা করে চাইলেন, আর বললেন– অন্ধকার হয়ে আসছে বেশিদূর না যাওয়াই ভাল । উনি উবু হয়ে বসে গোরুর গাড়ির চাকা মাটিতে ফেলে কী সব ঠুকঠাক করছিলেন। আলো কমে আসছিল। বাঁধের ওপরে উঠতেই যেন এক অজানা বিশ্ব, কলম্বাসের মতন নতুন এক দেশ বা জায়গা আবিষ্কার করলাম। যতদূর চোখ যায় বিস্তীর্ণ ঘাসজঙ্গল বড় বড় পাথর আর দূরে এক স্বছতোয়া নদীর বয়ে চলা। আরও দূরে একটি বাঁধ নজরে এলো। বাঁধের ওপারে ছড়ানো ছেটানো বিল্ডিং। সবে তখন উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ আর হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। যে হাসপাতাল মূল শহর থেকে অনেকটা ঘুরে যেতে হত, এখন অবশ্য বড়সেতু হয়ে অনেক কাছে। কিছুটা নেমে খুব আনন্দে দৌঁড়ালাম আমরা। মাথায় গায়ে গতরে শীতের পোশাকের ওপর বালিরদানা। জানি এরপর বাড়িতে গিয়ে অনেক কিছু পাওনা আছে, তবে সেই বয়সটা তো এসব কিছু তোয়াক্কা করত না। আলো আরও কমে এল। বিকেল পাঁচটার পর সন্ধের অন্ধকার নেমে আসবে। আমরা বাড়ির দিকে ফিরলাম।
সেই পালোয়ানের বাড়ি ডিঙ্গিয়ে আমরা ঝোপঝাড় খেতের মধ্যে পড়েছি সবে। হালকা অন্ধকার। দেখি দুটো কুকুরের বাচ্চা আর তার মা দাঁড়িয়ে আছে ঝোপের কাছে, আমাদের হৈ চৈ শুনে থমকে গিয়েছে। কোথা থেকে একটা ইঁট বা পাথর জাতীয় কিছু ওদের দিকে ছুঁড়ল কেউ। দেখি সেই পালোয়ান লোকটি হৈ হৈ করছে– আরে খোকাবাবুরা ওগুলো সব শেয়াল আছে। আমরা দেখলাম বাঁশঝাড়ের ভেতর দৌঁড়ে শেয়াল তার ছানাপোনাদের নিয়ে ঢুকে গেল। এই প্রথমবার মাঠেঘাটে চর্মচক্ষুতে শেয়াল দেখলাম। কেন বাঁশ বাগানে শেয়ালরাজা বলা হয় তাও বুঝলাম। বাঁশবাগানে তাহলে শেয়ালদের বাড়ি? আমরা সন্ধের ঝাঁপসা অন্ধকারে ঠান্ডা জল স্রোতের মহানন্দা পেরোলাম। নদীর ওপারে শহরের আলোগুলো জ্বলে উঠেছে। পেছন ফিরে তাকালে মনে হচ্ছিল অনেক রাত হয়েছে আর নদী পেরিয়ে বড়রাস্তায় উঠতেই মনে হল সবে সন্ধে নেমেছে। এবারে ঘরে ফিরে বাবা-মায়ের মুখোমুখি হবার দূর্ভাবনা চেপে বসল। ম্যানেজ করবার কৌশল সবাই মিলে ভাবছিলাম, যাতে উত্তম- মধ্যম বকাঝকা যতটা কম খাওয়া যায় ।
পাড়ায় পৌঁছুতেই বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে, বড়দের জটলা ক্লাবের কাছে। খবর পেলাম বড়রা সবাই একজন সাইকেল চোর ধরা পড়েছে এই নিয়ে ব্যাস্ত। তাহলে আজকের এই এডভেঞ্চার থেকে রেহাই পেলাম বোধহয়। ঘরে ফিরে হাত-পা- মুখ ধুয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে পাহাড়ের দিকে তাকালাম। ঘন কুয়াশা পাহাড়ের গায়, তাই আলোর মিটিমিটি দেখতে পেলাম না। বেশ শীত এখন বাইরে। সাইকেলচোরের প্রতি কোন আকর্ষণ সেদিন আর ছিলনা , তারচেয়ে আমরা বন্ধুরা মিলে ঐ যে নদী দেখা আর ফেরবার সময় শেয়ালের দর্শনের কথা মনে পড়তে লাগলো। ঘন- ঘন হাই উঠছে। কখন কী ভাবে খেয়েদেয়ে লেপের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আজ আর মনে নেই। তবে বিকেলে যে নদীর ওপারে আর একটা নদী দেখে ফিরেছিলাম তা আজও স্পষ্ট। নদীটির নাম ছিল বালাসন।