সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৫৫)

সোনা ধানের সিঁড়ি

৯০

শিক্ষকতার একেবারে শুরু থেকেই আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের দুটো কথা বলে এসেছি। প্রথমত, পড়াশোনার জন্যে পড়াশোনা নয়। মন দিয়ে পড়াশোনা কর এবং তার মধ্যে অবশ্যই যেন ভালোবাসা থাকে। দ্বিতীয়ত, বই খাতা পেনের প্রতি যত্নবান হও। এই দুটোই সরস্বতীকে ভক্তি শ্রদ্ধা দেখানোর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায়। নিজে যখন ছাত্র ছিলাম তখনও আজকের মতো এই নিয়মই মেনে চলতাম। কখনও নিজের মনকে বিশ্বাস করাতে পারি নি যে, সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তাঁকে মেনে না চললে যত ভালো ছেলেই হও আর যত মন দিয়েই পড়াশোনা কর তুমি লেখাপড়াতে পিছিয়ে পড়বে।

অথচ আমি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। বাবা নিজেই ছিলেন পুরোহিত। চোখের সামনে সমস্ত রকমের পুজো হতে দেখেছি। কিন্তু নিজে কখনও অংশগ্রহণ করি নি। কিন্তু তাই বলে আমার বিশ্বাস কখনও কারও ওপরে চাপিয়ে দিই নি। বরং পুজোকে উপলক্ষ করে সবাই যখন নতুন নতুন জামা কাপড়ে নিজেকে সাজিয়েছে আমার ভালোই লেগেছে।

ছোটবেলায় সরস্বতী পুজোর দিনে মায়ের সঙ্গে আমার ঝগড়া কেউ আটকাতে পারতো না। আমি পুষ্পাঞ্জলি দিতে চাইতাম না (এখানে বলে রাখা ভালো, আমার তরফ থেকে কোনো উপেক্ষা ছিল না। আসলে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার তাগিদ ভেতর থেকে কখনও অনুভব করতাম না। যেহেতু নাটক করা আমার চরিত্র বিরোধী তাই ভক্তির নাটক করে পুষ্পাঞ্জলি দিতে পারতাম না।) আর মা-ও ছাড়ত না। আমি আগে খেয়ে নিতাম আর তাতে মা খুব রেগে যেত। আমি যে খুব পেটুক ছিলাম বা খিদে সহ্য করতে পারতাম না তা কিন্তু নয়। কিন্তু কেন জানি না সরস্বতী পুজোর দিনে আমার খিদে যেন হাজার গুণ বেড়ে যেত।

বইয়ের প্রতি আমার চিরকালের যত্ন। কুড়ি বছর আগে কেনা বই আজও দেখলে মনে হবে সদ্য কিনেছি। কেউ জামা ছিঁড়ে দিক, টাকা নিয়ে না দিক কোনো সমস্যা নেই কিন্তু বই নিয়ে কেউ যদি না দেয় বা বই নিয়ে ফেরতের সময় যদি দেখি পাতা ছেঁড়া বা মোড়া তাহলে আর দেখতে হবে না। ভয়ঙ্কর রেগে যাব। আজ আমার ঘরে স্থানাভাবে অনেক বইকেই ঠিক ঠিক জায়গায় রাখতে পারি নি কিন্তু তাই বলে তারা কেউ অযত্নে নেই।

আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের বলি, বইয়ে পা লেগে যাওয়া বিরাট কোনো অপরাধ নয়। ইচ্ছা করে না লাগালেই হলো। বইয়ে পা লাগাতে নেই একটাই কারণে, পায়ে তো নোংরা থাকে এবং তা থেকে বই নোংরা হয়ে যেতে পারে। একবার একটা ক্লাসে বলেছিলাম, উঁচু কোনো জায়গায় তুমি নাগাল পাচ্ছো না, সেক্ষেত্রে বইয়ের ওপরে দাঁড়িয়ে তুমি অনায়াসে তার নাগাল পেতে পারো। কথাটা শুনে আমার বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রী মাথা নিচু করে ফেলেছিল। কানে আঙুল দিয়েছিল। যেন কথাটা শুনে তারা মহাপাপ করে ফেলেছে। আমি ওদের বললাম, বাবার কাঁধে উঠে কোনো জায়গায় নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করিস না ?  তখন কি বাবাকে লাথি মারা হয় ? এটাও ঠিক সেইরকম।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।