সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় (পর্ব – ৪৪)

সোনা ধানের সিঁড়ি

৭৮
ছোটবেলায় যখন মায়ের হাত ধরে মামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরতাম তখন রাস্তা দিয়ে একবার হাঁটা শুরু করলে আর পিছনে ফিরে তাকাতাম না। কয়েকদিন থাকার ফলে ওখানকার বন্ধুরা শুধু নয়, গাছপালা পুকুর নদী সকলের জন্যেই প্রাণ কাঁদত। আবার কবে আসতে পারব জানি না। কতদিন ওদের সঙ্গে দেখা হবে না —– এটা ভাবলেই ওদের জন্যে প্রাণ কেঁদে উঠতো।
এইরকম একটা মানসিক গঠন নিয়ে পথ হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো শেষ যাত্রা দেখা আমার জন্যে নয়। এটা আমার মনের মধ্যে এমন গোড়া গেড়ে বসলো যে এমনিও যখন কোথাও থেকে ফিরি তখনও পিছন ফিরে তাকাই না। শেষ যাত্রায় দুটো মানুষের সঙ্গে আমি পথ হেঁটে ছিলাম। একজন আমার বাবা আর অন্যজন আমার মা। সে যে কি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তা আমার পক্ষে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ধনিয়াখালি থেকে ত্রিবেণী, মাত্র কয়েক ঘণ্টার রাস্তা আমার মনে হয়েছিল বছরের পর বছর যেন আমি পথ হাঁটছি। এই পথ যেন কিছুতেই শেষ হবার নয়। দুটো মানুষকে ঘিরে আমার জীবনের কত কত ঘটনা। আমি যেন একটা একটা করে ইতিহাসের পাতা উল্টে যাচ্ছি ।
তারপর থেকে কত প্রিয়জনকে হারালাম। বিজন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, পিনাকী ঠাকুর —– একজনকেও আমি শেষ দেখা দেখতে যাই নি। প্রকাশ কর্মকারের বেলায় আমায় একজন একটু বাঁকাচোরা কথা বলেছিল। আসলে সে শেষ যাত্রায় গিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিল প্রকাশ কর্মকার তার মনের গভীরে থাকা একজন মানুষ। আমি তার সঙ্গে কোনো তর্কে যাই নি। নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী চুপ করে বসে ছিলাম। কারণ প্রকাশদার সঙ্গে কত কত দুপুর কাটিয়েছি। কত গল্প। সে যেন আমার এক অন্য ভুবন। আমি তাঁর শেষ যাত্রার কথা মনে করতে চাই না। তিনি আমার মনের গভীরে অন্য ভুবনের গল্প নিয়ে আলো হয়ে থাকুন। যাই নি পিনাকীদার শেষ যাত্রাতেও। কোনো শোকসভাতেও আমি যেতে চাই না। দু একবার গিয়ে বুঝেছিলাম এ এক কষ্টের প্রহর পেরিয়ে যাওয়া। বুকের ভেতর এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা অনুভব করি। কথা বলতে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি আর চোখ দিয়ে জল পড়ে।
এই তো কয়েকদিন আগে কবি রেখা বন্দ্যোপাধ্যায় চলে গেলেন। আমাদের রেখাদি। আমাদের সকলকে তিনি ভালোবেসে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। অনেকবার তাঁর বাড়ি গেছি। অনেক গল্প করেছি। সবাই মিলে একসঙ্গে অনেক জায়গায় গেছি। সেসব অনেক গল্প। পৃথিবী জুড়ে অচলাবস্থা চলছিল তাই অনেকেই যেয়ে উঠতে পারেন নি। যদি স্বাভাবিক অবস্থাও থাকতো তাহলেও আমি যেতে পারতাম না। আমাকে ক্ষমা করবেন। অত শক্ত মনের মানুষ আমি নই।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।