সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে ইন্দ্রাণী ঘোষ (পর্ব – ৫)

আরশি কথা

ভোরের আলো বাগান থেকে আরশির ভিতরে এসে পড়ে. নরম, লালচে, সোনালী আলো. চোখে আলো পড়তে আস্তে আস্তে চোখ খোলে ঝোরা, স্বচ্ছতোয়ার হাতের পরশখানি মুঠির ভিতর লেগে আছে তখনো. উঠে বসে সে. ঝোরা কি আয়নার ভিতরে ঢুকে গিয়েছিল? মাথায়, মুখে শুকনো পাতার গন্ধ. হাতের তালুতে শিশিরের গন্ধ. ঝোরা কি স্বপ্ন দেখছিল? না কি আয়নার ভিতরের পথ ধরে এক অচীন দেশে পৌছে গিয়েছিল? কি যে রূপকথার দরজা খুলে যায় একা থাকলেই. আড়মোড়া ভেঙে উঠে চোখে, মুখে জলের ঝাপটা দেয় ঝোরা. মুঠোফোনে ঘন্টি বাজে, কানে ধরে ঝোরা, মায়ের ফোন. ‘হ্যা বল’.’ কোথায় থাকিস’? মায়ের তিরিক্ষি মেজাজ. ‘উঠতে দেরি হয়েছে, রাতে লিখছিলাম’ , ‘এই এক ছঁাইপাশ লেখা হয়েছে, কি হবে কি লিখে, সংসার ধর্মে মন নেই, তোমার শাশুড়ি মা ফোন করেছিলেন, একবার দয়া করে ফোন করে নিও, সারাক্ষণ উড়নচন্ডীর মত ঘুরে বেড়ান.’ ‘নেব, তুমি দুদিন ভাইবোনেদের সাথে বেড়াতে গেছ, বেড়িয়ে নাও, কর্ত্যব্যের ঘন্টি বাজানোর কাজটা ছাড়.’ মা ফোনটা কেটে দেয়. তড়িঘড়ি শাশুড়িকে ফোন করে ঝোরা. ‘আমার ছেলে আর নাতনী বাইরে, এই অবসরে দিব্যি আছ, ফোন ধরার প্রয়োজন মনে কর না, তাও তো শাশুড়ীর ঘর করতে হল না কোনদিন.’ ‘ আপনার ছেলে আর নাতনীকে মেসেজ করে রাখছি, আপনাকে ফোন করবে নিশ্চয়ই, আমার সাথে কাল কথা হয়েছে, দুজনেই ব্যাস্ত, ভাল আছে’ ‘বুড়ো মা কে কি কারুর মনে পড়ে না?’ চুপ করে থাকে ঝোরা সে জানে শাশুড়ি মানুষটা মন্দ নন. ‘বাজার, রান্নাবান্না হয়েছে? নাকি উপোশ যাচ্ছে?’ ‘না না নিরু দি আছে তো, কিছুই বাদ নেই’.’ বেরোবি না?’ ‘হঁ্যা এই যাব’, ছুটির দরখাস্ত করে এসেছিল ঝোরা, কালকেই কনফার্মেশন এসেছে. বেমালুম চেপে গেল কথাটা, একা আছে জানলেই এই দুই মা অকারন চিন্তা করবেন. তার চেয়ে যে যার দুনিয়ায় যেমন আছে থাকুক. আরো দু এক কথা বলে ফোন রাখে ঝোরা.
‘কি রাঁধব বৌদি.’ নিরু দি ঝোরার বহুদিনের সঙ্গিনী, ‘যা ইচ্ছে চাপাও না’, ‘দুদিন আসব না, একটু বেশি করে রেঁধে রেখে যাই, ভাতটুকু ফুটিয়ে নিও, স্যালাড কেটে রেখে গেলাম’, ‘কোথায় যাবে গো নিরু দি?’ ‘মেয়েটা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলে পুজো দিতে যাব ভেবেছিলাম, যাওয়া হয় নি, কলেজে ভর্তি হল, এবার পুজোটা না দিলেই নয়’. ‘হুম যাও’, নিরবিচ্ছিন্ন মহার্ঘ একাকীত্ব ঝোরার তবে. অপিসেও অতি উৎসাহী তরুণী জিজ্ঞাসা করেছে ‘ ঝোরা দি ছুটি নিচ্ছেন যে,? কোথাও চললেন না কি?’. উত্তর দেয় নি ঝোরা, একটু হেসে শুধু ঘাড় হেলিয়েছে. ফ্রী ল্যান্স বিজ্ঞাপনের কপি লেখার কাজ করে ঝোরা, তবে ছুটি নিতে গেলে দরখাস্ত করতে হয়, রোজই কপি লেখার কাজ থাকে.
বাথরুম স্নান করতে গিয়ে একটা মগে বেশ খানিকটা সাবানগুলে বুদবুদ বানায় ঝোরা, হাতে সাবান জল নিয়ে তাতে বুদবুদের ফেনা ওড়াতে থাকে ঝোরা, পিছনের রাস্তাটা ধারে প্রচুর ল্যান্টানা গাছ, কয়েকটা বাতাবি গাছ রয়েছে. বাতাবি গাছটার মাথায় দুটো দুর্গা টুনটুনি হুটোপাটি লাগিয়েছে. হঠাৎ দরজায় ধাক্কা. ‘বৌদি স্নান হল না, চা জুড়িয়ে গেল যে’. ‘এই যাই’, তড়িঘড়ি স্নান সেরে বেড়িয়ে আসে ঝোরা. ‘কখন চা করেছি, তোমার দেরি দেখে ডাকলাম, একা থাকবে এই দুটো দিন আসব না সাবধানে থেকো, তুমি তো নিজের খেয়াল রাখ না’. হেসে ফেলে ঝোরা ‘সাবধানে যাও নিরু দি চিন্তা কর না, ভালো করে পুজো দিয়ে এস , আমি ঠিক থাকব, আর হ্যাঁ দুই মাকে বল না তুমি দুদিন আসবে না, তোমার সাথে তো ফোনে কথা হয়, ওরা চিন্তা করবেন’. কাজ সেরে বাগানের পথ ধরে চলে যায় নিরু দি, ঝোরার বাগানের ঝুপসি আমগাছটার নিচে রাখা মাটির পাত্রে জল খেতে এসে হুটোপুটি লাগিয়েছে কতগুলো সাদা চোখো টুনটুনি আর একটা কুবো পাখী.

(চলবে)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।