• Uncategorized
  • 0

হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণকাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ২)

চললুম ইউরোপ

ছেলের বাড়ি ঢুকে জানলাম ও আমাদের জন‍্যে চিকেন স্ট‍্যু আর ব্রেড রেডি করে রেখেছে। আমি অবাক হয়ে চারদিক দেখছি.. এতো রূপকথার বাড়ি, এত সুন্দর ছবির মত! জেটল‍্যাগ কাটতে সময় লাগল… একটু বেলায় উঠে কাঁচের ফ্লাশডোরের পর্দা সরিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল।মেঘলা কম আলোর আকাশ, চারপাশের বাড়িগুলোর কোনটা থেকে চুরুটের মত ধোঁয়া উঠছে। বাবাই বলল আগুন লেগেছে ভেবোনা হিটসিস্টেম চলছে আর পাশের এই বাড়িটাতে বাচ্ছা মেয়েদের ব‍্যালে শেখানো হয়। চা টা খেয়ে ভাল করে নিজেকে প‍্যাকিং করে বাইরে বেরোলাম… পরপর দুটো বাড়ি পরে রাস্তা আর তার পাশে ঝকঝকে জলের ক‍্যানেল। তাতে ভেসে আছে বোট। রাস্তার গায়ে ছোট পার্কের মত জায়গায় বসার জায়গা…. পায়ের কাছে জমে আছে অজস্র লাল হলুদ পাতার স্তুপ। ক‍্যানেলের ওপর প্রচুর সিগাল।চুপ করে একটু বসে দেখলাম ছোট সিঁড়ি নেমে গেছে জলে আর ছোট ছোট ঢেউয়ের দোলায় ধাক্কা খাচ্ছে বোটটা।

এ আমি কোথায় এলাম!স্বপ্নের মত লাগছে।ছোটবেলায় পড়া ইংরেজি কবিতাগুলো মনে পড়ছে… দূরে তাকিয়ে দেখি পরপর কানেক্টিং ব্রীজ হাত ধরে আছে এপার ওপারের। কি আছে ওপারে! জল থেকে উঠে আসা কনকনে হাওয়ায় দাপটে উঠে দাঁড়িয়ে দেখলাম অনেক বাচ্ছা আসছে কেউ গাড়িতে কেউ সাইকেলে রাস্তার ঠিক ওপারেই স্কুল। এবার আমার টনক নড়লো এইরে বাড়িটা কোনদিকে! ব্রেকফাস্ট বানাতে হবে ওরা নিশ্চয়ই বসে আছে আমার জন‍্যে। অগত‍্যা ফোন ছেলে হাসতে হাসতে বলল, এ‍্যডভেঞ্চার কমপ্লিট। শোন রাস্তা পেরিয়ে দেখবে তিনটে রাস্তা যাচ্ছে উল্টোদিকে, যে রাস্তায় আগামেমননস্ট্রাট লেখা আছে..থার্ড বাড়িটা কেমন!
এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার পায়ের তলার মাটিটা ইউরোপ! হালকা রোদ উঠছে, ঝকঝকে নীল আকাশ!
তড়িঘড়ি বাড়ি ফিরতেই ছেলের অনুরোধ তোমরা নিজেদের Acclamatize কর নাহলে বেড়াতে গেলে কষ্ট পাবে। তাড়াতাড়ি পাস্তা বানিয়ে ফেললাম মাশরুম,চীজ ইত‍্যাদি দিয়ে… চুপিচুপি বলি একটু ক্রীমও দিয়েছি…. বাড়িতে তো খালি বিধিনিষেধ! আজ শনিবার,তাই বাবাইকে বললাম চল তোমার সঙ্গে শহরটা ঘুরে আসি। তো সঙ্গে নাকি ছাতা নিতে হবে precipitation এর ফোরকাস্ট আছে। বৃষ্টি হবে বললেই হয়, এ আবার কেমন নাম! চল দুগ্গা দুগ্গা। আমাদের জন‍্যে Transport card করে রেখেছে… Bank A/c রেডি,তার ডেবিট কার্ড দিল… মানে ফুলপ্রুফ ব‍্যবস্থা। স্টপেজের নাম অলিম্পিয়াপ্লেন।শহরে নাকি কোথাও পেট্রোল পাম্প নেই,রাস্তায় নো ট্র‍্যাফিক পুলিশ, নো ধুলো ধোঁয়া। ফুটপাথেই আছে গাড়ি ইলেকট্রিক চার্জ দেওয়ার ব‍্যবস্থা। কার্ড দিয়ে চার্জ করিয়ে নিচ্ছে লোক।

রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখি আশ্চর্য গাড়ি আমাদের দেখে থেমে যাচ্ছে… পার হবার সময় পথচারীরা মিষ্টি হেসে ধন‍্যবাদ দিচ্ছে! বাঃ এই সৌজন‍্যবোধ ও তো সভ‍্যতা। স্ট‍্যান্ডে চমৎকার ইলেক্ট্রনিক বোর্ড আছে তাতে কত নং ট্রাম, কত নং বাস কটায় আসছে সব লাইভ ইনফর্মেশন যাচ্ছে।
আমাদের ১৬নং ট্রাম… উঠেই আগে কার্ড টাচ করিয়ে নিতে হয়,আবার নামার সময় টাচ করিয়ে নিলেই সঠিক ভাড়া কেটে নেবে। সিট খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ স্ট‍্যাচু হয়ে গেলাম প্রায় নেকড়ের সাইজের এ‍্যালসিসিয়ান বসে আছে প্রভুর কাছে…. মিস্টার তাড়াতাড়ি এসে আমার আর তার মাঝখানে দাঁড়াল।বাবাই হেসে ফেলেছে, মা এরা ওয়েলট্রেনড কোন ভয় নেই। বাপব‍্যাটা দুজনেই কুকুর ভালবাসে আর আমি….। সে যাই হোক আড়চোখে দেখছি এখানকার মানুষজন… সব কন্দর্পকান্তি, আর দিব্বি সরল হাসিখুশি… নিজেদের মধ‍্যে ডাচ ভাষায় গল্প করছে হাসছে। আমার খুব ভাল লাগল, তবে আমাদের মত যারা বিদেশী তাদের নিয়ে এদের কোন কৌতুহল নেই দেখলাম…. আসলে পর্যটনের স্বর্গরাজ‍্য এই শহর সারা
বছর প্রচুর ভিনদেশির আনাগোনা, তাই বোধহয় ওদের গা সওয়া হয়ে গেছে। ট্রামের ভেতরে ১৫ ডিগ্রী করা আছে তাই মাফলার টুপি সব খুলে ফেলতে হল। হঠাৎ দেখি মাঝের গেট দিয়ে এক দম্পতি পেরাম্বুলেটর নিয়ে উঠল, সেভাবেই ব‍্যবস্থা করা আছে যাতে হুইলচেয়ার পর্যন্ত উঠে আসছে। একটা স্টপে এসে দেখলাম অনেক লোক গেটের কাছে এগিয়ে গেল। বাবাই বলল এটা এখানকার মার্কেটপ্লেস ড‍্যাম স্কোয়ার। আমরা তার পরের স্টপ সেন্ট্রালে নামব। নামতেই টের পেলাম এটা ইউরোপ আর এখন মিড অফ নভেম্বর।তবে আমার ছেলেটা দেখছি সাহেব হয়ে গেছে… মাথা খোলা, জ‍্যাকেটের চেন খোলা। আমরা সেন্ট‍্রাল স্টেশনে ঢুকলাম। স্টেশনের ভেতর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর,অনেক কাফে,কিয়স্ক চমৎকার wc যেখানে কার্ড ছোঁয়ালে আবার slip বেরোচ্ছে কোনটা 50 সেন্ট,কোনটা 25 সেন্ট খাবার দোকানে সেগুলো দিলে সেই পয়সাটা বাদ দেয়। বাঃ দিব্বি মজা তো!

চা টা খেয়ে বেরিয়েই একটা খাঁড়ি,ফ্রি লঞ্চ সার্ভিস আছে। আমরা খোলের মধ‍্যে বসলাম। ওমা দুজন যুবকযুবতী একেবারে খোলাখুলি প্রেম প্রেম খেলছে। ঠোঁটে মনে হচ্ছে feviquick দিয়েছে…. জ্বালাতন সঙ্গে ছেলে আছে আমি যে কি করি!
হাঁফ ছেড়ে নামলাম…. বৃষ্টি পড়ছে সঙ্গে কনকনে হাওয়া। হঠাৎ দেখি একটা প্রায় দশতলা উঁচু বাড়ির ছাদে দোলনায় দুলছে লোক। ছাদের শেষ প্রান্ত থেকে শূণ‍্যে অনেকটা উঠে যাচ্ছে আবার উল্টোদিকে। এই ওয়েদারে লোকে এখন দোলনা চড়ছে! অবশ‍্য সবাই তো আর আমার মত ছেলের বাড়িতে আসেনি। ওদের একদিন বা দুদিনে যতটা সম্ভব দেখে নিতে হবে তো।যাই হোক খাঁড়ির ধার দিয়ে চমৎকার রাস্তা মোহনার দিকে গেছে, পাশে ঢেউখেলানো সবুজ ভ‍্যালির ওপর হাউজিং…. ছবির মত সবকিছু। রেস্তোরা তো আছেই, আছে একটা বিশাল লাইব্রেরি। জলের ওপর থেকে বরফের ছুরি ছুটে আসছে, দমকা বাতাস। তাড়াতাড়ি লঞ্চে করে আবার এপারে। স্টেশন ফুঁড়ে এলাম টার্মিনাস চত্বরে। বেশ সরগরম.. আজ ছুটির দিন তাই অনেক লোক… এমনকি পেরাম্বুলেটরে চড়ে বাচ্ছারাও। ওয়াটারপ্রুফ ছাদে ঢাকা ভেতরে নরম আর গরম বিছানার ফুলের মত শিশুরা, কেউ ঘুমোচ্ছে কেউ বা খেলনা হাতে চারদিক তাকাচ্ছে। চেরিফলের মত ঠোঁট, নীলার মত চোখ, রক্তাভ টুকটুকে গাল…. আমি আর চোখ ফেরাতে পারছি না।… ব‍্যস হোঁচট খেয়ে পড়লাম ট্রামলাইনে… ছেলে দৌড়ে হাত ধরে তুলল, ওর বাবার ভ্রু কুঁচকে প্রায় জিজ্ঞাসার চিহ্ন!
অতঃপর ক্রুজের লাইন… এই ওয়াটার বডিতেই অনেক শতাব্দীপ্রাচীন শহরের ইতিহাস দেখতে নিয়ে যায় ট‍্যুরিস্ট ক্রুজ। কিন্তু একি এপাশে টায়ার সিস্টেমের গ‍্যারাজে হাজার হাজার সাইকেল। বাবাই বলল মা এখানে অসংখ্য সাইকেল চলে এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রীও সাইকেলে চড়ে অফিসে যান। মনটা খারাপ হয়ে গেল এরা কত ভালবাসে নিজের দেশকে। আর আমরা! আমাদের মত গরীব দেশে আয়ের অনেকটাই চলে যায়

অসংখ্য নেতা নেত্রীর সুরক্ষা আর বিলাসব‍্যসনে। দারিদ্র্যসীমার কত নম্বরে যেন ভারতবর্ষ ! হাঁটতে হাঁটতে ড‍্যাম স্কোয়ারের কাছাকাছি চলে এলাম, উল্টোদিকে স্টক এক্সচেঞ্জ আর একটু এগোলেই ওয়াক্স মিউজিয়াম। আজকের মত আমাদের ঘোরাঘুরি শেষ করে একটা কাফেতে বসে কফি স‍্যান্ডউইচ খেয়ে ফিরতি পথে রওয়ানা দিলাম আমরা। আবার অলিম্পিয়াপ্লেইন…. এখানে কাছাকাছি বহুবছর আগে অলিম্পিক হয়েছিল তখন থেকে জায়গাটা ডেভেলপ করা হয়েছে…. উল্টো ফুটপাথে এসে বাবাই বলল এটা চিনে রাখ আলবার্ট হাইন,এখানকার সবচেয়ে বড় ডিপার্টমেন্টাল চেইন। তোমাদেরও এখানেই আসতে হবে বাজার করতে। বেশ বাপু এখন বাড়ি চল দেখি ঠান্ডায় আর পারা যাচ্ছেনা। শহরের এ দিকটা অভিজাত এলাকা, তুলনায় ফাঁকা আর ঠান্ডাও বেশি। চা খেয়ে ওর বাবা ডিক্লেয়ার করলেন ‘ তোমরা ইচ্ছা করলে বেড়াতে যেও,আমি বাড়িতেই থাকবো। ‘ হঠাৎ জোর বৃষ্টি। ডাইনিং স্পেসের ওপরের ছাদটা স্বচ্ছ…. ওয়ালনাট গাছটা বাতাসে খুব দুলছে আর বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।