• Uncategorized
  • 0

হৈচৈ ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী তে ঈশানী রায়চৌধুরী (পর্ব – ৭)

চললুম ইউরোপ

Zuid (South) স্টেশন থেকে ট্রেনে রওনা দিলাম ‘ দ‍্য হেগ ‘ শহরে । এখানে East হল Oost, West… West , South হল Zuid আর North হল Noord। নেদারল‍্যান্ডের রাজধানী আমস্টারডাম হলেও এই দেশের প্রশাসনিক আর রাজকীয় রাজধানী এই ডেন হাগ ( Den Haag) বা দ‍্য হেগ শহর। উত্তর সাগর বা North Sea র উপকূলের এই গুরুত্বপূর্ণ শহর আন্তর্জাতিক আইন ও আরবিট্রেশন ( সালিশি) এর নিজস্ব বাসভূমি বলে সারা বিশ্বে পরিচিত। স্টেটস জেনারেল নামে জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে এখানে । ‘ ইন্টারন‍্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস ‘ নামটা আমরা অনেকেই শুনেছি, সেটা এই Peace Palace এ। এটা প্রধান বিচারব‍্যবস্থা ইউনাইটেড নেশনস (UN) এর, স্থাপিত হয়েছিল জুন১৯৪৫ সালে ইউনাইটেড নেশনসের সনদ অনুসারে। কাজ শুরু করেছিল এপ্রিল ১৯৪৬ । এখানে ১৫ জন বিচারপতি যুক্ত থাকেন যাঁরা নির্বাচিত হন ৯ বছরের জন‍্যে । নির্বাচিত করেন ইউনাইটেড নেশনসের জেনারেল এ‍্যাসেমব্লি আর সিকিউরিটি কাউন্সিল ।
এই কোর্টের কাজ হল বিভিন্ন রাষ্ট্রের পেশ করা আইনগত জটিলতার সমাধান করা, আন্তর্জাতিক আইনঅনুসারে। ইউ. এন. যেসব বিতর্কিত বিষয়গুলো উত্থাপন করেন কোর্টের কাছে সেই সম্পর্কিত আইনি পরামর্শ দেওয়াও এই কোর্টের এক্তিয়ার। এখানে নথিভুক্ত প্রথম কেসটি ছিল ১৯৩৩ সালে ইউ. কে. আর আলবেনিয়ার মধ‍্যে। জাতিগত বৈষম‍্য , প্রশান্ত মহাসাগরে বিভিন্ন দেশের গতিবিধির আপোষ বা চুক্তি এমন অসংখ‍্য বিষয়ে কাজ হয় এখানে। ১৮৯৯ সালে হেগ শহরে প্রথম শান্তি সম্মেলন হয়েছিল। কোর্ট অব আরবিট্রেশন পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান যেখানে আন্তজার্তিক বিরোধের মীমাংসা হয়।

এমনকি ইন্টারন‍্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট ও এই শহরে। এটা প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। সাধারণত গণহত‍্যা, যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ইত‍্যাদির জন‍্য দোষীদের অভিযুক্ত করা হয়। তবে এই আদালতের গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৯৭ সালের ১৭ই জুলাই, যেদিন রোম নীতিমালা গৃহীত হয়। এই নীতিমালা হল আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের মূল ভিত্তি। এটা গৃহীত হওয়ার আগে ১২০ টা দেশের স্বীকৃতি দরকার ছিল তাই কার্যক্রম শুরু করতে আরও পাঁচ বছর লেগে যায় ।
কত আলোচনা, ট্রিটি.. বিশ্বের তাবড় সমস‍্যা এখানে সমাধান করার প্রক্রিয়া চলে শান্তি ও সাম‍্যের লক্ষ‍্যে। সারা পৃথিবীতে এর গুরুত্ব অসীম।
উইলিয়াম সেকেন্ড ১২৪৮ সালে এখানে একটা দুর্গ তৈরি করেছিলেন। এখানে ঐতিহাসিক
‘ বিনেনহফ’ (আভ‍্যন্তরীণ আঙ্গিনা ) থেকে হল‍্যান্ড প্রশাসন চলে। ১৩৫০ সালে এখানে উত্তর দিকে একটা কৃত্রিম হ্রদ খনন করা হয়েছিল। মধ‍্যযুগে হেগ শহর পরিচিত ছিল বিস্তীর্ণ বনভূমির জন‍্যে , কাউন্ট অফ হল‍্যান্ড এখানে নিয়মিত শিকার করতেন।
বন্ধুরা ভাবতে পারেন এত দ্রষ্টব‍্য থাকতে কোর্ট অব ল নিয়ে আলোচনার কি সত‍্যিই দরকার ছিল! বন্ধু, এই গ্রহের সবচেয়ে প্রচীন যে প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন‍্যে কাজ করে, আইনের শাসন রক্ষা করে তাকে আমাদের সম্মান করা উচিত বলে আমার মনে হয়েছে।
এখানে অন‍্যতম বিখ‍্যাত দ্রষ্টব‍্য মাদুরোদম । এখানে বিখ‍্যাত ডাচ ল‍্যান্ডমার্ক গুলোর রেপ্লিকা বা অনুলিপি করা আছে ।
আমরা গেলাম না কারণ আমরা মিনি ইউরোপ আগেই দেখে নিয়েছি। আছে Panorama Mesdag , শিল্পকলার জাদুঘর।
Peace Palace দেখে আমরা রওয়ানা দিলাম De Pier. বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া তত বাড়তে লাাগল যত আমরা সমুদ্রের কাছাকাছি গেলাম। হাওয়ার গতিবেগ আমাদের সি বিচে নামতে দিল না, যে দুএকজন আছেন দেখলাম কিছু না কিছু আঁকড়ে ধরে আছেন। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে আমরা খুব তাড়াতাড়ি De Pier এর ভেতর ঢুকে গেলাম। সে এক আশ্চর্য জায়গা পোশাক, কিউরিও, ফটোগ্রাফি, স্পা কি নেই সেখানে। যত সামনের দিকে এগোচ্ছি তত সমুদ্রের ভেতর ঢুকে যাচ্ছি। চারদিকে স্বচ্ছ দেওয়াল। রেস্টুরেন্ট, লোকাল ডেলিকেসি ইতস্তত সব দোকানের পাশ দিয়ে যাচ্ছি আর দেখছি নর্থসি আমাদের গ্রাস করে নিচ্ছে। অদ্ভুত শিহরণ হচ্ছে তিনদিকে জলবেষ্টিত হয়ে। জানলা দিয়ে দেখলাম দিনমণি ধীরে সমুদ্রের জলে মিলিয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ স্বচ্ছ দেওয়ালের গায়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে অনুভব করলাম। সমুদ্রযাত্রা কখনও করিনি তবে এখানে এসে মনে হল তার স্বাদ পেলাম ।
বাবাই বলল ‘ তোমরা এখানে আটকে যেও না, আরও সামনে চল ওখানে চমৎকার রেস্তোরাঁ আছে। তবে সাবধান এই ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে একটু খোলা জায়গা দিয়ে ওখানে যেতে হবে।’ আমি তো বিনা বাক‍্যব‍্যয়ে ছেলের হাত চেপে ধরলাম। এবার পেরোতে হবে সেই খোলা জায়গা। তুমুল হাওয়ার চাপে এগোনা যাচ্ছে না। দুপাশে উত্তাল সমুদ্রের জল। আমি তো নিরাপদ আশ্রয়ে। করুণ চোখে রায়চৌধুরী মশায়ের দিকে দেখলাম তিনি তো পুরুষমানুষ তাই সাহায্য চাইতে পারছেন না। ছেলেকে বললাম তাড়াতাড়ি আমায় ভেতরে দিয়ে বাবার হাতটা ধরো।
যাই হোক ভেতরে ঢুকে আবার চমক…অদ্ভুত ডিজাইনের আলো দিয়ে সাজানো টেবিল, সামনে একটা ডেকরেটেড প্লাটফর্ম।সেখানে আলোকসজ্জিত যিশুখ্রীষ্ট বিরাজ করছেন। কেমন শান্ত হয়ে গেল মন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের তিনজনের বৃত্ত সম্পূর্ণ। শান্তি প্রার্থনা করলাম পৃথিবীর।
কালো সমুদ্রের ওপর নীল আলোর নাগরদোলা। খুব রহস‍্যজনকভাবে ধীরে ধীরে ওঠানামা করছে।
সব যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। আমার স্বভাবমত তক্ষুণি ঠিক করে ফেললাম আবার আসতে হবে, আসতেই হবে এখানে।
এই সমুদ্র উপভোগের রোমাঞ্চ ভোলার নয়।

খাওয়াদাওয়ার পর ফেরার পথ ধরলাম। সেই ঝোড়ো রাস্তা তবে এবার স্থলভূমির দিকে মুখ করে এগোচ্ছি তাই বোধহয় অতটা ভয় করল না। Pier থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে ট্রামলাইনে এলাম। ১ নম্বর ট্রাম আমাদের নিয়ে এল সেন্ট্রাল স্টেশনে। অতঃপর আমস্টারডাম ।

চলবে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।