“বীরেনবাবুর জন্য কয়েক লাইন” – ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

কবিতা মাথায় এলে হাতের কাছে যা পেতেন— সিগারেটের প্যাকেট বা বাসের টিকিট— লিখে রাখতেন তাতেই। তিনি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
দেশভাগ, ১৯৫৯-এর খাদ্য আন্দোলন, ’৬১-র নাট্য নিয়ন্ত্রণ বিল-বিরোধী আন্দোলন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, ’৬৬-র খাদ্য আন্দোলন, ’৬৭-র মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আইন অমান্য, জেল, জরুরি অবস্থা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, নকশালবাড়ি তাঁর কবিতায় ফিরে ফিরে আসে দুর্দিন –
দুর্দিনে আমরা নিশ্চয় যে-যার ঘরে ব’সে থাকবো না
শুভ ও অশুভের লড়াইয়ে তখনও আমাদের কাজ থেকেই যাবে!
কেউ কেউ আমাদের ছেড়ে চ’লে যাবেন, ভিন্ন আদর্শের কথা ব’লে ;
অথবা নীরবে — যাঁর যেমন রুচি ও অভ্যাস!
কবিতাটি লিখেছিলেন (৩০ ডিসেম্বর, ১৯৮৪)। অর্থাৎ ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৬, এক অস্থির সময় তখন। আমরা বলতে পারি অস্থির সময়ের পদাবলী।
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়….
দিন বদলায় না!
যদিও একেবারে গোড়ায় প্রচ্ছন্ন ভাবে হলেও তাঁর কবিতায় জীবনানন্দের প্রভাব ছিল, অন্তত ‘পূর্বাশা’য় প্রকাশিত কবিতাগুলির মধ্যে সে রকমটাই তো লক্ষ করা যায়। যেন তিনি জীবনানন্দের মাঠ থেকেই জেগে উঠলেন, ঘুম থেকে উঠে বসে বলতে থাকলেন, ‘এমন ঘুমের মতো নেশা’ কিংবা ‘এমন মৃত্যুর মতো মিতা’…এ সব ছেড়ে আর কোনো জীবন যে তিনি চান না। তখন তাঁর প্রায় সমস্ত কবিতার ভুবন ভরে ছিল জীবনানন্দের নদী-মাঠ-ঘাস-ফুল-পাতা, শালিখ-চড়ুই, শীত, চাঁদ, হাওয়া। তাঁর কবিতায় তখন ‘শরবতের মতো সেই স্তন’…তিনি লিখছিলেন ‘ক্লান্তি ক্লান্তি’র মতো কবিতা।
কবি বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় সেই আবহ থেকে ফের একদিন জেগে উঠে দেখলেন – ‘দুপুরে বাঘ পাড়া কাঁপায়’, ‘পাথরে পাথরে নাচে আগুন’, ‘বছরের পর বছর বিনা বিচারে বন্দিদের নিয়ে চলে প্রহসন’, ‘খেয়া পারাপার করে ডাকিনীরা’, ‘কোথাও মানুষ উঁচু হতে হতে হঠাৎ ভয়ঙ্কর বেঁটে হয়ে যায়’…কিন্তু আচমকা একদিন তো নয়, ঘুরে দাঁড়ানো, মৃত্যুর দিক থেকে ফিরে আসা, ক্ষুধার্ত জীবনের দিকে তাকানো, লাঞ্ছনায় আর্তনাদ করে ওঠা, যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠা, প্রতিবাদে গর্জে ওঠা – কোনোটাই হঠাৎ একদিন নয়। হতেই পারে তাঁর কবিতা আর হেমন্তের পথে হেঁটে আলো-আঁধারের ছায়াময় ধানের খেতে এসে দাঁড়াল না। তাঁর কবিতায় এল স্পষ্ট উচ্চারণ, রুক্ষ হয়ে উঠল ভাষা, শব্দবন্ধ যেন রূঢ় সময়ের সঙ্গে পাঞ্জা কষল, সময়কে অশ্বারোহী করতে হাতে নিল নির্মম-নিষ্ঠুর চাবুক।
এসব লেখা পড়তে পড়তে আমাদের কালের এক বিশিষ্ট কবি কখন যে শতবর্ষে পা দিয়েছেন তা বুঝতেই পারিনি। যাঁরা ভালোলাগার মানুষ বোধহয় তাঁদের বয়স বাড়ার কথা খেয়াল থাকে না। এই শতবর্ষ উদযাপনে অনেক অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায়, সমধর্মী কবিদের সঙ্গে তাঁর তুলনা করা যায়। কবি ও কবিত্বের কোন ধরন বীরেন্দ্রর প্রিয় ছিল, কাদের, কোন কবিতা তিনি বর্জনে আগ্রহী—এসবই হয়ে উঠতে পারে একটি লেখার বিষয়।
কবিতার সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। এটুকু বলা চলে কবিতা মাত্রেই পদ্য, যদিও সব পদ্যই কবিতা নয়। পদ্যে থাকে একটা যান্ত্রিকতা কিন্তু কবিতা সেই যান্ত্রিকতা উর্ত্তীর্ণ হয়ে অগ্রসর হয় এক implicit value judgement-এর দিকে। ভাষাবাহিত কল্পনা কবিতার ক্ষেত্রে তৈরি করতে চেষ্টা করে একটা মূর্ত বিমূর্ত পরিমণ্ডল—যা কালে কালোত্তরে ক্রমান্বয়ে আবিষ্কৃত হতে থাকে।
বীরেন্দ্র এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন— ‘যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমি টেররিস্ট পার্টির হুকুমে ওঠবোস করেছি। যখন আরেকটু বড় হয়েছি তখন আমি চেষ্টা করেছি একজন ক্ষুদে কমিউনিস্ট হতে।’ (নান্দীমুখ ১৯৮০) এবং ‘মার্ক্সবাদে আমার অঙ্গীকার কোনোদিনই সুভাষ বা সুকান্তর সঙ্গে সমান্তরাল রেখা ধরে চলেনি।’ তাঁর প্রথম কবিতার বই—গ্রহচ্যুত (১৩৫০), ‘কথার মৃত্যু’, ‘নিরাশা’, ‘রুদ্ধগৃহ’, ‘আশা’, ‘পুনর্জন্ম’—এই পাঁচটি শিরোনামে বিভক্ত মোট ৩৫টি কবিতার প্রায় সবগুলিতেই প্রেমের সহজ সরল উচ্ছ্বাস ধরা পড়েছে। বারংবার ঘুরে ফিরে এসেছে প্রিয় নারীকে কাছে পাওয়ার আকুলতা এবং না পাওয়ার বিরহ ব্যকুলতা। নায়িকা প্রায়শ প্রণয়ভঙ্গকারী বিবাহিতা। তাই পুনর্মিলনের সম্ভাবনা নেই। নাগরিক জীবনের জটিলতা নেই, ব্যঙ্গ বিদ্রূপ নেই। নামকরণগুলি লক্ষণীয়—‘তোমার বিয়ের আগে’, ‘তোমার সিঁথিতে চিহ্ন’, ‘তুমি তো চলেই গেলে’, ‘তোমার সিঁথির সিঁদুর’ ইত্যাদি। কিশোর জীবনে প্রেম, প্রেমের কথা থেকে গেছে অব্যক্ত। জীবনানন্দ দাশের প্রভাব অস্বীকার করেন নি। বলেছেন ‘চল্লিশের প্রগতি সাহিত্য প্রথম থেকেই আমার কাছে খণ্ডিত এবং যান্ত্রিক বলে মনে হয়েছে।’
সতীর্থ সরোজলাল বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন—চল্লিশে বীরেন্দ্র ব্যক্তিমনস্কতার কবি। তার দশ বছর পর দেখা দিল ‘একক সংগ্রামী মানবতা।’ (উলুখড়ের কবিতা, ১৯৫৪) তার পর ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠল ‘নির্বিশেষ মানবতাবাদ।’ এবং ‘মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবিদের সম্পর্কে মোহমুক্তি’। সরোজলালের মতে বীরেন্দ্রে আছে—‘বেদনাময় মানবতায় উত্তরণ’ এবং সত্তরে ‘ফ্যাসিবাদবিরোধিতা’। এ পর্যায়ে স্পষ্টতর হয় ‘শ্রেণীচেতনা’। (চল্লিশের তিন কবি) প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তিনি উদাহরণ দিয়ে গেছেন। একটি পাঁচ লাইনের কবিতা; শুরুতে বলছেন—
‘মুখে যদি রক্ত ওঠে
সেকথা এখন বলা পাপ …’
পরিস্থিতির বিরূপতা, যাতে সত্য ঘোষণার বিপদ আছে।
রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেন—
‘দুঃস্বপ্নেও এমন সর্বনাশ / স্বাধীন জন্মভূমিকে নিয়ে ভাবনি তুমি কবি / মানবতার স্বপ্নে তাই অটল ছিলে।
প্রতিবাদী ও প্রত্যাঘাতী কবি বলেন—
সে অন্নে যে বিষ দেয় কিংবা তাকে কাড়ে
ধ্বংস করো, ধ্বংস করো ধ্বংস করো তারে
ক্ষুব্ধ কবি বলেন—
সামনে থেকে হটো, বেইমান, কুকুরগুলো সামনে থেকে হটাও
তুমি কাদের ভয় দেখাও?
জনৈক নিহত কবির উদ্দেশে তাঁর শ্রদ্ধার্পণ—
যারা এই শতাব্দীর রক্ত আর ক্লেদ নিয়ে খেলা করে
সেইসব কালের জল্লাদ
তোমাকে পশুর মত বধ ক’রে আহ্লাদিত?’ (নিহত কবির উদ্দেশে)
এ কবিতাতেই তিনি ‘পোশাকী কবিতা’র সমালোচনা করছেন। একদিকে কালের জল্লাদদের সমালোচনা, অন্য দিকে পোশাকী কবিতার প্রতি ঘৃণা। এ সময়েই লেখা একটি কবিতায় তিনি বলেন— ‘একেই বলে গণতন্ত্র; এরই জন্য কবিতার সর্দার সাহিত্যের মোড়লেরা কেঁদে ভাসান’
এ গণতন্ত্র ভাত, মিছিল সবেতেই শাসকরা গুলি চালিয়ে ‘গণতন্ত্র’ রক্ষা করে। চারদিকে যখন ক্রমান্বয় নরমেধ যজ্ঞ তখন—‘কবিরা কবিতা লেখে, দেশপ্রেম, ক্রমে গাঢ়তর হয় গর্ভের ভিতর রক্তপাত’ আর ‘মহান নেতারা বাজারে ফেরি করে মার্কস লেনিন স্ট্যালিন গান্ধী এক এক পয়সায়।’ আক্রান্ত-শাসক, দেশপ্রেমী সৌখিন কবি, দেশনেতাদের বাজারি প্রেম। কবি জানেন— ‘বাংলার নেতা, কবি, সাংবাদিক, রাত গভীর হলে/ গোপনে নিজের সন্তানের ছিন্ন শির ভেট দেয়’ দিল্লীতে। ১৯৭২-এ লেখা হয় এক বিস্ফোরক কবিতা—যার প্রথম অংশে বিপজ্জনক পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্কতা, বোদলেয়র আচ্ছন্নতা (বুদ্ধদেব ও বাংলা কবিকুল), নাজিম হিকমত এবং নেরুদা অনুবাদপ্রিয়তা (সুভাষ ও অনুগামীরা) দেশ ভেসে যায় হাজার শিশুর রক্তে— ‘যা লেখ যা ইচ্ছে লেখ কিন্তু খবরদার, দিওনা সাপের লেজে পা’।
একটি গদ্য লেখায় (কবিতার নিজস্ব পৃথিবী) বীরেন্দ্র বলেছিলেন—তিনি শুদ্ধ কবিতার প্রতি আর আস্থাশীল নন। ‘কবিতার খাতিরে কবিতা লেখার দিন ফুরিয়েছে; আজকের দিনে কবির আনুগত্য কবিতার চেয়ে ঢের বেশি নীরস বাস্তব পৃথিবীর প্রতি।’
গত কয়েক দশকে দেশ ও বিদেশের কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে কবিতার কোনো নির্দিষ্ট আঙ্গিক হয় না। তা পদ্য বা গদ্যকে ছুঁয়ে যেতে পারে, তা প্রত্যক্ষ থেকে অপ্রত্যক্ষে, বাচ্যার্থ থেকে ব্যঙ্গার্থে, লক্ষার্থে ছোটাছুটি করতে পারে। কখনো কবিতা সোচ্চার, কখনো তা নীরব, নীরবতাই মাঝে মাঝে ভয়ঙ্করভাবে সোচ্চার। গোত্রান্তরিত বীরেন্দ্রর কবিতার কবিত্ব নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শতবার্ষিকীতে আর একবার স্মরণ করা যাক বীরেন্দ্রর কবিত্ব বিকাশের কথা আর বাংলা কবিতার প্রথাবদ্ধ সীমাবদ্ধতা ও যান্ত্রিকতাকে। কবিতার কোন দিক বর্জনীয়, কবিতার কোন দিক অর্জনীয়—এই দুই মতের পরিচয় বীরেন্দ্রর কবিতা ও গদ্য পড়লে বুঝতে পারি
ছিলেন তিনি
আছেন তিনি দূরে
কখন তিনি থাকবেন বুক জুড়ে?
ঋণ: বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় – নির্বাচিত কবিতা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।