ক্যাফে স্পেশাল (টিচার্স ডে) সংখ্যায় ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

শিক্ষক দিবস ও বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা

“রাজপথে দেখা হলে কেহ যদি গুরু ব’লে, হাত তুলে করে নমস্কার,
বলি তবে হাসিমুখে, ‘বেঁচে বর্তে থাকো সুখে’, স্পর্শ করি কেশগুলি তার।
ভাবিতে ভাবিতে যাই – কী নাম ? মনে তো নাই, ছাত্র ছিল কত দিন আগে;
স্মৃতিসূত্র ধরি টানি, কৈশোরের মুখখানি, দেখি মনে জাগে কি না জাগে”।…
কবি কালিদাস রায় এর ‘ছাত্রধারা’ কবিতা যেন সব শিক্ষকেরই অন্তরের কথা। স্কুল-কলেজ জীবনে যতদূর চোখ যায় মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে শিক্ষকের ভালবাসার গল্প থেকে শুরু করে হাতের পাতায় বেতের বাড়ি আর কানমলার গল্প। বার বার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি। তাই শিক্ষকদিবস নিয়ে লিখতে বসে ধুলো ঝাড়পোঁচ করে পেছনে ফিরে তাকানো। কখনও পুরনো স্মৃতিকাতরতা উথলে উঠে। ফেলে আসা স্কুলজীবনের জন্য মন কেমন। আবারও এই লেখার হাত ধরেই ফিরে দেখা। স্কুলের শিক্ষকদের নতুন করে দেখা। ডাউন মেমরি লেন ধরে হাঁটতে হাঁটতে একাকী দেখা হয় তাদের সঙ্গে। হারিয়ে যাই। আনন্দ-বেদনার মনকেমন কষ্টটা টের পাই। কিশোরবেলায় ছায়া ও বিষাদের ঘ্রাণ মাখা মনকেমনের বারান্দায় খানিক হেলান দিয়ে বসি। মন খারাপের বাতাস বইলেই চোখ ছলছল। পুরতনী গান যেন সুর ভাঙে মনে। কিছুই যেন বিম্বিত হয় না এ চোখে।
জাপানের একটা প্রচলিত প্রবাদ হল— ‘‘Better than a thousand days of dilligent study is one day with a great teacher’’. আর হ্যাঁ, তিনিই সেই ডঃ সর্বপল্লিরাধাকৃষ্ণণ।
জীবনের লড়াই যখন শুরু করেন তখন হাতের কাছে পেয়ে যান গীতাঞ্জলির ইংরাজি অনুবাদ ‘Song Offerings’। এক এক পড়ে ফেললেন সব ক’টা কবিতা। গভীর ভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন রবীন্দ্রনাথের প্রতি । “বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়”, … এই কবিতাটি তাঁর মনে গেঁথে যায়। তিনি বুঝতে পারেন দুঃখের মধ্য দিয়ে যে জয়লাভ তা জীবনের চরম সার্থকতা নিয়ে আসে – আনমনে আবৃত্তি করে উঠলেন,
It is not my prayer that you save me from all perils
I pray that I should not fear when faced with odds
এই উপলব্ধির সঙ্গে উপনিষদের দর্শনতত্ত্বের মিল খুঁজে পেয়েছিলেন রাধাকৃষ্ণন। উপনিষদের শ্লোকটি হল-
অসতো মা সদ্গময়/ তমসো মা জ্যোতির্গময় / মৃত্যোর্মামৃতং গময়। / আবিরাবীর্ম এধি। / রুদ্র যত্তে দক্ষিণং মুখং / তেন মাং পাহি নিত্যম্।
অসত্য হইতে আমাকে সত্যে লইয়া যাও, অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও। হে স্বপ্রকাশ, আমার নিকটে প্রকাশিত হও। রুদ্র, তোমার যে প্রসন্ন মুখ, তাহার দ্বারা আমাকে সর্বদাই রক্ষা করো।
প্রথম জীবনে তিনি মাইসোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা করেন (১৯১৮)। এসময় তিনি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় লিখতেন। সে সময়েই তিনি লেখেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘The Philosophy of Rabindranath Tagore’। সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন ডুবে থাকতেন রবীন্দ্রনাথে। কলকাতায় কবির ৭০তম জন্মদিন উপলক্ষে বক্তৃতায় রাধাকৃষ্ণন বলেছিলেন, “মহৎ সাহিত্যের এটাই প্রসাদগুণ, যে তার দ্যুতি রাজা বা সাম্রাজ্যের তুলনায় অনেক বেশি দিন টিঁকে থাকে”।
এই মহান দার্শনিক ও শিক্ষকের জন্মদিনকে স্মরণ করে ৫ সেপ্টেম্বর আমরা ‘শিক্ষকদিবস’ হিসাবে পালন করি। দেশের অগণিত শিক্ষকদের আদর্শগত মহান কর্মকাণ্ডের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাঁদের পেশাগত অবদানকে স্মরণে-বরণে শ্রদ্ধায় পালন করার জন্য সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই মহান শিক্ষক দিবস পালন করার রীতি রয়েছে। নির্দিষ্ট দিনটি বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালন করা হয়ে থাকে। যেমন বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ৫ অক্টোবর, ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। UNICEF থেকেও, ৫ অক্টোবর দিনটিই ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবসের’ স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের সর্বমোট ১৯টি দেশে অক্টোবর মাসের ৫ তারিখ ‘টিচার্স ডে’ পালিত হয়। দেশগুলি হল—কানাডা, জার্মানি, বুলগেরিয়া, আর্জেবাইজান, ইস্তোনিয়া, লিথোনিয়া, ম্যাকেডোনিয়া, মলদ্বীপ, নেদারল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, কুয়েত, কাতার, রাশিয়া, রোমানিয়া, সার্বিয়া, ইংল্যান্ড, মাউরেটিয়াস, মলদোভা। আবার বিশ্বের অন্য ১১টি দেশে ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনটিতে বিশ্ব শিক্ষক দিবস চালু। দেশগুলি হল মরক্কো, আলজেরিয়া, টিউনেশিয়া, লিবিয়া, ইজিপ্ট, জর্ডন, সৌদিআরব, ইয়েমেন, বাহরেইন, ইউ এ ই, ওমান। ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর থেকে ইউনেস্কো দ্বারা ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ দিনটি সূচিত হয়। এটি সারা দেশ-বিদেশে ‘শিক্ষক’ পেশাজীবীদের জন্য সেরা সম্মান। পরবর্তী প্রজন্মও যাতে কার্যকরী ও যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে এই দিনটি পালন করে সেটাও উদ্দেশ্যা। এডুকেশন ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, জাতীয় স্তরে সমগ্র বিশ্বেই একটি বিশেষ দিনকে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি—যেটি সমাজ-সংস্কার-শিক্ষায় শিক্ষকদের উপযুক্ত মাণ্যতা দান করার যোগ্য দিন।
আমাদের দেশে ভারতের ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণ এর জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর বিশেষ মর্যাদার সঙ্গে ‘শিক্ষক দিবস’ হিসাবে পালিত হয়। ‘ভারতরত্ন’ উপাধি বিভূষিত প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ। মহান দার্শনিক, আদর্শবান বিচারক ছিলেন ডঃ রাধাকৃষ্ণণ। শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি। তিনি ছিলেন বাগ্মী, অধ্যাপক, রাজনীতিবিদ এবং অদ্বৈত বেদান্ত বাদ রচয়িতা দার্শনিক।
পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘‘He has served his nation in many capacities. but above all he is a great teacher from whom all of us have learnt much and will continue to learn.’’ অর্থাৎ নেহেরুজীর মতে, রাধাকৃষ্ণন ছিলেন ‘আধুনিক বিশ্বদর্শনের প্রতিভূ। তিনি বিভিন্নভাবে দেশের সেবা করেছেন। কিন্তু সর্বোপরি তিনি একজন মহৎ শিক্ষক। তাঁর কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখেছি এবং আজও শিখতে থাকবো।’
অত্যন্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে নিরন্তর দারিদ্রের সাথে সংগ্রাম করেও তিনি দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রপতি পদ অলংকৃত করেছিলেন। দুঃখ-দারিদ্রকে জয় করে তিনি অতি সহজেই বলতে পেরেছেন- ‘Often suffering is not punishment but discipline’. তিনি বলেছেন ,-‘মানুষের জীবন চলমান কর্মের এক ধারাবাহিক প্রকৃতি-এক মুহূর্ত নষ্ট করা চলবেনা।’ রাষ্ট্রপতির সুমহান ঐতিহ্য পালন করতে গিয়ে অনেক সময় তাঁকে বিবেকের দংশনে দংশিত হতে হয়েছিল, তবুও তিনি কখনও সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হননি। তিনি কখনও নিজের আত্মগরিমা প্রকাশ করেননি, তিনি ছিলেন সহজ সরল ও অমায়িক।
তিনি বলেছেন – “A good Teacher is a candle, it consumes itself to light the way for others.” তাঁর মতে -একজন মানুষের সফলতা, চরিত্র ও ভাল ব্যক্তিত্ব গড়ার পিছনে শিক্ষকের অবদান রয়েছে।একজন শিক্ষককে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তিনি শুধুমাত্র পুঁথিগত হবেন তা নয়, তিনি জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রের শিক্ষক হতে পারেন।তিনি বলবান,গুনবান ও চরিত্রবান করে তুলতে ছাত্রকে সাহায্য করবেন। সমাজগড়ার কারিগর হিসাবে শিক্ষকের গুরুত্ব অনেকখানি। তাঁর মতে, – “Every one acknowledges how a teacher shapes the life of students and we should be ever grateful to them”.
বর্তমান তামিলনাড়ু এবং তৎকালীন মাদ্রাজ প্রদেশের তিরুতান্নিতে এক গরিব ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৮৮-এর ৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন রাধাকৃষ্ণন। ছেলে পূজারি হোক, এমনটাই চাইতেন তাঁর বাবা। বাবা কখনোই চাননি ছেলে ইংরেজি পড়ুক। কিন্তু রাধাকৃষ্ণনের জেদে পরাজিত হন তাঁর বাবা। তিরুপতির একটি স্কুলে তাঁকে ভর্তি করা হয়।
মেধাবী ছাত্র হওয়ার ফলে, স্কুল জীবনে অসংখ্য স্কলারশিপ পেয়েছেন রাধাকৃষ্ণন। প্রথমে ভেলোরের ভুরহি কলেজে ভর্তি হলেও, পরে মাদ্রাজ ক্রিশ্চান কলেজে ভর্তি হন তিনি। তাঁর বিষয় ছিল দর্শন। কিন্তু দর্শন তাঁর প্রথম পছন্দের বিষয় ছিল না। বই কেনার টাকা ছিল না রাধাকৃষ্ণনের। কিন্তু সেই সময়েই একই কলেজ থেকে দর্শন নিয়ে স্নাতক হন তাঁর এক দাদা। দাদার বইয়ের জন্যই দর্শনকেই বেছে নেন তিনি।
বয়স যখন ২০, বেদান্ত দর্শন ওপর তাঁর গবেষণা প্রকাশিত হয়।
১৯০৮-এ মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাশ করেন রাধাকৃষ্ণন। এর পড়ে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজ দিয়ে তাঁর অধ্যাপনা জীবন শুরু করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়েও তাঁর অধ্যাপনার স্বাদ পায়। অন্ধ্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের ভূমিকাও পালন করেছেন তিনি।
মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবার দুবছর পরে, অর্থাৎ ১৯২০ সালে, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দর্শনাধ্যাপকের পদের জন্য উপযুক্ত লোকের সন্ধান করছিলেন। ঐ পদ অলংকৃত করেছিলেন ডঃ ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। ড: শীল মহীশূর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলারের পদ পেলে তার শূন্যপদে স্যার আশুতোষের উদ্যোগে রাধাকৃষ্ণণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান দর্শনাধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন।
ছাত্রছাত্রীদের কাছে অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন রাধাকৃষ্ণন। মহীশুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার উদ্দেশে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিচ্ছেন অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণন, তখন তাঁর পড়ুয়ারা, ফুলসজ্জিত গাড়ির ব্যবস্থা করে, তাঁকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিল।
বয়স যখন ১৬, দূর সম্পর্কের আত্মীয় শিবাকামুকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯৫৬য় তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়।
১৯৫২-য় উপরাষ্ট্রপতি হন রাধাকৃষ্ণন। কিন্তু তার আগে, অর্থাৎ ১৯৪৬-এ ইউনেস্কোর দূত হয়েছিলেন তিনি। এর পর সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের দূতও ছিলেন তিনি।
১৯৬২-তে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন রাধাকৃষ্ণন। সে বছরই প্রথম বার ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্মদিন শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়েছিল। নোবেলজয়ী ব্রিটিশ দার্শনিক, বারট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, “ডঃ রাধাকৃষ্ণন ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়া মানে দর্শন বিষয়টার কাছে একটা আলাদা সম্মানের। আমিও নিজের দার্শনিক, তাই আমিও গর্বিত।” নানাক্ষেত্রে প্রতিভা ও কর্মদক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেলেও রাধাকৃষ্ণণ ‘দার্শনিক’ হিসাবেই বিশেষভাবে সর্বত্র পরিচিত। দার্শনিক হিসাবেই তিনি দেশবিদেশের সশ্রদ্ধ অভিনন্দনও পেয়েছেন। স্যার ফ্রানসিস ইয়ংহাজব্যান্ড তার একটি গ্রন্থে লিখেছেন : “রবীন্দ্রনাথ যেমন নবীন ভারতের কবি তেমনি রাধাকৃষ্ণণও নবীন ভারতের দার্শনিক।”
রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর পড়ুয়াদের দাবি ছিল তাঁর জন্মদিনটা যেন বিশেষ ভাবে উদযাপন করা হয়। রাধাকৃষ্ণন বলেছিলেন, “জন্মদিন উদযাপন না করে সেই দিনটা যদি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়, তা হলে আমি কৃতজ্ঞ থাকবে।” সেই থেকে ৫ সেপ্টেম্বর ভারতের শিক্ষক দিবস।
১৯৫৭-য় রাষ্ট্রপতি হিসেবে ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের কার্যকাল শেষ হওয়ার পর, রাধাকৃষ্ণনকেই রাষ্ট্রপতি করতে চেয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কিন্তু মৌলানা আজাদের তীব্র বিরোধিতায় সেটা হয়নি। ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ আরও পাঁচ বছর থাকেন। ১৯৬২-তে নেহরুর সক্রিয়তায় রাষ্ট্রপতি হন রাধাকৃষ্ণন।
তাঁর রাষ্ট্রপতির মেয়াদকালে দু’টো যুদ্ধে যেতে হয় ভারতকে। প্রথম ছিল ১৯৬২-এর চিন যুদ্ধ। রাষ্ট্রপতির আসনে বসার কয়েক মাসের মধ্যেই সেই যুদ্ধ। এর তিন বছর পরে ছিল পাকিস্তান যুদ্ধ।
১৯৬৫-এর ২৫ জুন, জাতির উদ্দেশে ভাষণের সময়ে, রাধাকৃষ্ণন বলেন, “পাকিস্তান ভারতকে হয় খুব দুর্বল ভেবেছে, নয়তো খুব ভীত ভেবেছে। ভারত সাধারণত অস্ত্র হাতে তোলে না, কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে পাকিস্তানকে একটা শিক্ষা দেওয়া দরকার। পাকিস্তান যেটা ভেবেছিল, তার বিপরীতটাই হল।”
১৯৬৪ সালে নেহরুর মৃত্যু হয়, এর ঠিক দু’বছর পরেই তাশকেন্তে আকস্মিক মৃত্যু হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর।
ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী কে নটবর সিংহ বলেছিলেন, রাধাকৃষ্ণনের মুখে নিজের বিরোধিতা মেনে নিতে পারেননি ইন্দিরা গান্ধী। তাই ১৯৬৭-তে দ্বিতীয় বার রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ হারান রাধাকৃষ্ণন। নটবরের কথায়, “এটা রাধাকৃষ্ণনের কাছে বিশাল আঘাত ছিল।”
ডঃ রাধাকৃষ্ণনের জীবনের মর্মবাণী ছিল – “দেবমন্দির হচ্ছে নিত্য পবিত্র মন্দির,আর সেই মন্দিরে তুমি নিজেই, যেমন মৃগের দেহের মধ্যেই কস্তুরি বিরাজ করে।আমরা একাগ্রচিত্তে মনের মালিন্য দূর করবো।” তাঁর মতে, জন্ম হোক যেখানে সেখানে,কর্মের মাধ্যমেই আমরা বিশ্বমানব হতে পারি। তিনি বলেছেন-“একান্ত নীরবতার মধ্যে বন্দীর বন্ধন মুক্তির জন্য করুন ক্রন্দনের মতো এবং অন্তরকে পাওয়ার জন্য কাতর ক্রন্দনধ্বনির মতো আমাদের কানে ভেসে আসে ব্যাথিত আত্মার সবিলাপ কণ্ঠস্বর।”
তাঁর শিক্ষাদশ’নও আমাদের ভালভাবে উপলব্ধি করা প্রয়োজন।তিনি বলেছেন – “A good Teacher is a candle, it consumes itself to light the way for others.” তাঁর মতে -একজন মানুষের সফলতা, চরিত্র ও ভাল ব্যক্তিত্ব গড়ার পিছনে শিক্ষকের অবদান রয়েছে।একজন শিক্ষককে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তিনি শুধুমাত্র পুঁথিগত হবেন তা নয়,তিনি জীবনের যে কোনো ক্ষেত্রের শিক্ষক হতে পারেন। তিনি বলবান,গুনবান ও চরিত্রবান করে তুলতে ছাত্রকে সাহায্য করবেন।সমাজগড়ার কারিগর হিসাবে শিক্ষকের গুরুত্ব অনেকখানি। তাঁর মতে, -“Every one acknowledges how a teacher shapes the life of students and we should be ever greatful to them”
এই সত্যসন্ধানী জ্ঞানতপস্বী দীর্ঘ ৮৭ বছর কর্মময় জীবন কাটিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৭ই এপ্রিল অমরলোকে যাত্রা করেন।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা:
তবে আজ কিন্তু তাঁকে স্মরণ করার দিন এসেছে। করোনা আবহে সভ্যতা যেমন সঙ্কটের মুখোমুখি তেমনি শিক্ষাও। এখন অনেকগুলি শক্ত কোমরের রাধাকৃষ্ণণ দরকার। করোনা মহামারীর এ সময়টা নিশ্চয়ই কেটে যাবে একদিন। আমাদের বন্ধ থাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবার প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী মুখর হয়ে উঠবে প্রতিটি ক্যাম্পাস। কিন্তু সময়টা আরও দীর্ঘস্থায়ী হলে আগামীর শিক্ষা ব্যবস্থা কেমন হবে? করোনার কারণে তৈরি হওয়া অনলাইন আর অফলাইনের শিক্ষার এই বৈষম্য আমরা কি সমাধান করতে পারবো? সমাধান করতে গেলে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষায় উদ্ভাবনীয় ব্যক্তিদের ভূমিকা অথবা শিক্ষায় যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের ভূমিকাই বা কী হবে? তা নিয়ে ‘কোভিড-১৯ এবং এর পরবর্তী শিক্ষা পুনঃপরিকল্পনা’ শিরোনামে চলছে আলোচনা এসেছে পরিবর্তন।
১৮৮৫ সালের পর অর্থাৎ ৩৪ বছর পর বদলে গেল প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা। কেন্দ্রের নয়া নীতিতে শিক্ষার অধিকারের আওতায় আনা হয়েছে ৩ থেকে ১৮ বছরের শিক্ষার্থীদের। ব্যাপক বদল আনা হয়েছে পরীক্ষা ব্যবস্থায়। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের নাম বদলে গিয়েছে। তার বদলে ফিরেছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক।
আগে শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামো ছিল ১০+২ ভিত্তিতে। সেই কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে New Nation Education Policy -তে তা করা হয়েছে ৫ + ৩ + ৩ + ৪। অর্থাৎ, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে আরও তিন বছর যোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম তিন বছর প্রাক প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা। প্রি-প্রাইমারি স্তরের জন্য সারা দেশে একটি অ্যাকটিভিটি ও লার্নিং বেসড শিক্ষানীতি তৈরি হবে বলে জানানো হয়েছে। তার জন্য জাতীয় শিক্ষা মিশন গঠিত হবে। বোর্ড পরীক্ষার গুরুত্ব কমানোর কথা বলা হয়েছে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতিতে।
স্কুল শিক্ষায় বড় পরিবর্তন আসছে বর্তমানের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠদানের পদ্ধতিতে। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় দশম শ্রেণি পাশ করার পর বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য এই তিন বিভাগে ভাগ হয়ে যায় পড়াশোনার বিষয়। কিন্তু নতুন শিক্ষা নীতিতে এই বিভাগগুলিই উঠে যাবে।
উচ্চশিক্ষাতে যে বড়সড় রদবদলের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম মাল্টিপল এন্ট্রি অ্যান্ড এক্সিট সিস্টেম চালু করা। অর্থাৎ, শিক্ষাবর্ষের মাঝে কোনও পড়ুয়া কোনও কারণে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিলে পরে আবার সেখান থেকেই শুরু করতে পারবেন। একইভাবে স্নাতকোত্তর ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। সেখানে কেউ গবেষণা করতে চাইলে ৪ বছরের ডিগ্রি কোর্স করতে পারেন। আবার ৩ বছর স্নাতক স্তরে এবং এক বছর স্নাতকোত্তর পড়ার পরে সরাসরি পিএইচডি করতে পারবেন।
আর এম ফিল (M.phil) করার প্রয়োজন নেই। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রেও স্কুলের মতো মাল্টি ডিসিপ্লিনারি এডুকেশন চালু হচ্ছে। তাতে ‘মেজর ও মাইনর’ ব্যবস্থা থাকবে। যেমন, মূল বিষয়ের সহযোগী বিষয়গুলির পাশাপাশি সঙ্গীত, চিত্রকলার মতো বিষয়ও রাখতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। আবার আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের ধাঁচে গঠন করা হচ্ছে ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন। গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় অনুদানের জন্য এই ফাউন্ডেশন কাজ করবে। কিন্তু আমেরিকার সঙ্গে ভারতের এই সংস্থার পার্থক্য হল বিজ্ঞানের সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানও এই ফাউন্ডেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
দেশে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে যে একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে, সেগুলিকে এক ছাতার তলায় আনতে একটি নতুন কমিশন বা পর্ষদ গঠন করার কথা বলা হয়েছে নয়া শিক্ষানীতিতে। এছাড়া কলেজগুলিকে আরও স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কলেজের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে এই স্বায়ত্ত্বশাসন দেওয়া হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি (IT) ব্যবহারে জোর দেওয়া হয়েছে। নতুন এই education policy -তে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সেরা অন্তত ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়কে শাখা খোলার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্র। অন্যান্য স্বায়ত্ত্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রেও বিশেষ সুযোগ পাওয়া যাবে। উচ্চশিক্ষার উন্নতিতে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে ইউজিসি, এআইসিটিই এবং ন্যাশনাল কনসার্ন ফর টিচার এডুকেশন। নয়া নীতিতে একটি মাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকবে। তার নাম উচ্চ শিক্ষা কাউন্সিল (HECI)।
তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের উচিত তাঁর প্রদর্শিত পথে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাদান করা। আজ শিক্ষক দিবসে শিক্ষক সমাজকে তাই আবার নতুন করে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে তাঁর উপদেশ মতো কঠোর পরিশ্রম করার মানসিকতা নিয়ে প্রকৃত মানুষ গড়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। তবেই তাঁর জন্মদিনে আমাদের সকলের শিক্ষাগুরুর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন সার্থক হবে-যদি শিক্ষকের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে সেই ভালবাসার আকুলতা
“আর সবি গেছি ভুলি, ভুলিনি এ মুখগুলি,
একবার মুদিলে নয়ন
আঁখিপাতা ভারী-ভারী, ম্লান মুখ সারি সারি
আকুল করিয়া তোলে মন”।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।