আজকের লেখায় ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

বাঁধ ভেঙে দাও ভাঙো অচলায়তন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মুক্তচিন্তা, উদারবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ আজ ঢেকে যাচ্ছে রাজনীতির রঙের তরজায়। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায়, শান্তিনিকেতন গড়ে তোলার যে ভাবনা প্রতিফলিত করেছিলেন তা এক বৃহত্তর পরিমন্ডলে ব্যপৃত। সেখানে দলীয় রাজনীতির বিষবাষ্প ঢুকে পড়া শুধু অনভিপ্রেতই নয়, ভয়ের ব্যাপার।
শান্তিনিকেতন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য, -“তিনি আমার প্রাণের আরাম আত্মার শান্তি মনের আনন্দ”।
আমাদের শান্তিনিকেতন আমাদের সব হতে আপন।
তার আকাশ-ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে,
মোরা বারে বারে দেখি তারে নিত্যই নূতন॥
শান্তিনিকেতন ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের একটা বিস্ময়। ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজস্ব উদ্যোগে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে চিন্তা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর করেছিলেন, তারই বাস্তব রূপ শান্তিনিকেতন। এই শহরটি শান্তিনিকেতন হয়ে ওঠার আগে কিন্তু অন্য নামে পরিচিত ছিল। কুখ্যাত ডাকাত ভুবন ডাকাতের নামে এই শহরটির নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা।
১৮৬২ সালে রায়পুরের পথে যেতে যেতে কবির পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর লাল মাটির এই অঞ্চল এবং ধান ক্ষেত দেখতে পান। দেখেই চোখ জুড়িয়ে যায় তাঁর। এই জায়গাই ঈশ্বরের উপযুক্ত আরাধনাস্থল ভেবে তিনি রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ২০ বিঘা জমি কিনে নেন। তার পর তিনি সেখানে আরও গাছ লাগানো ও বাড়ি তৈরির মনস্থ করেন। বাড়ি তৈরি হয়। সেই বাড়িটির নাম দেন শান্তিনিকেতন এবং সেখানে থাকতে শুরু করেন। ১৮৬৩ সালে তিনি সেখানে একটি আশ্রম তৈরি করেন এবং ব্রাহ্ম সমাজের সূত্রপাত ঘটান।
১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়। ১৯১৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। এরপর ১৯২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর, (১৩২৮ বঙ্গাব্দের ৮ পৌষ) রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বিশ্বভারতীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।
শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, এখানে ছাত্র ছাত্রীরা প্রকৃতির সংস্পর্শে নিজেদের আবিষ্কার করে। পাঠ ভবনের পর মৃণালিনী আনন্দ পাঠশালা, সন্তোষ পাঠশালা, শিক্ষা শাস্ত্র, উত্তর শিক্ষা সদন এগুলিকে বিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া দর্শন ভবন, সঙ্গীত ভবন, চীনা ভবন, কলা ভবন, শিল্প সদন, রবীন্দ্র ভবন, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। দীর্ঘ দিন ধরে দেশ ও বিদেশের জ্ঞান পিপাসু মানুষ এখানে আসেন এবং নিজেদের জ্ঞানের ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করেন। ইন্দিরা গান্ধী , অমর্ত্য সেন, নন্দলাল বসু, সত্যজিৎ রায় এছাড়া আরো অনেক নামি মানুষ এই বিশ্ব বিদ্যালয়ের সাথে জড়িত।
তবে শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভাবনায় প্রথম প্রথম বেশ হেসেছিলেন কবিগুরুর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী। শুনতে অবাক লাগলেও, এটাই সত্যি। রবীন্দ্রনাথের স্কুল তৈরির ভাবনা যে এভাবে হাস্যরসের খোরাক হবে, তা বোধহয় ভাবেননি গুরুদেব। খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলেন তিনি।
পরে মৃণালিনী দেবী বলেছিলেন যে মানুষ নিজে কখনও স্কুলের গণ্ডী পেরোননি, যার চার দেওয়ালে আবদ্ধ শিক্ষাকে ভুয়ো মনে হত, সেই রবীন্দ্রনাথ নিজে স্কুল খুলবেন। এই ভাবনাতেই হেসেছিলেন তিনি। স্ত্রীর এই আচরণে কিছুটা হতবাক রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে বলেছিলেন নিজের ভাবনাকে। কবিগুরু বলেছিলেন শান্তিনিকেতন আর পাঁচটা বিদ্যালয়ের মত হবে না। সেখানে ছায়া সুনিবিড়, শান্তির নীড়ে চলবে পঠনপাঠন। খোলা আকাশের নীচে শিক্ষার্থীরা পাঠ নেবে প্রকৃতির। আবার শান্তিনিকেতন স্কুলের শুরুতে এর ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবী নিজের সমস্ত অলংকার বিক্রি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ পুরীতে অবস্থিত তাঁর বাংলো বিক্রি করে দিয়েছিলেন। পিতার শান্তিনিকেতন ট্রাস্ট থেকে আসা বছরে আঠারশ টাকার উপরই তিনি প্রধানত নির্ভর করতেন। পরে তিনি তাঁর নোবেল পুরস্কারের সমুদয় অর্থ স্কুলে দান করেন।
আর পৌষ মেলা? যদিও এ মেলার শুরুর গল্প কিন্তু শান্তিনিকেতনে নয়। কলকাতার কাছেই গোরিটির বাগানে। ৭ পৌষ দিনটি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের জীবনে এক অতীব স্মরণীয় পুণ্যদিন, তাঁর দীক্ষার দিন। ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ পৌষ অর্থাৎ ২১ ডিসেম্বর ১৮৪৩ দেবেন্দ্রনাথ কুড়িজন অনুরাগী নিয়ে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। তাঁরই প্রয়াসে দুই বছরে প্রায় পাঁচশ জন ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন। আনন্দিত দেবেন্দ্রনাথ পলতার পরপারে তাঁর গোরিটির বাগানে ব্রাহ্ম বন্ধুদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেন। ৮/৯ টি বোটে করে সকলে ওই বাগানে যায়, প্রাত:কালে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মের জয়ধ্বনি আরম্ভ করে। এ ভাবেই শুরু হল পৌষমেলার। নিজের আত্মজীবনীতে লিখছেনও সে স্মৃতি। ‘‘পরস্পরের এমন সৌহার্দ্য দেখিলাম, তখন আমার মনে বড়ই আহ্লাদ হইল। আমি মনে করিলাম যে, নগরের বাহিরে প্রশস্ত ক্ষেত্রে ইঁহাদের প্রতি পৌষমাসে একটা মেলা হইলে ভাল হয়।’’ এই প্রথম মেলার সতের বছর পর ১৮৬২ সালের ফ্রেব্রুয়ারি- মার্চ নাগাদ শান্তিনিকেতন আশ্রমের সূচনা, ছাতিমতলায় পেলেন প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি। ১৮৬৩ সালের ১লা মার্চ জমি বন্দোবস্ত হল, আশ্রম প্রতিষ্ঠা হল। তখন দেবেন্দ্র নির্দেশ করলেন — ধর্মভাব উদ্দীপনের জন্য ট্রাষ্টীরা বছরে বছরে একটি মেলা বসাবার চেষ্টা ও উদ্যোগ করবেন। এ মেলায় প্রতিমা পূজো হবে না, কুৎসিত আমোদ-উল্লাস হবে না, মদ মাংস ছাড়া সব ধরনের জিনিস কেনা বেচা চলবে। আয়ের টাকায় আশ্রমের উন্নতির কাজ করা হবে। শান্তিনিকেতনে উপাসনা মন্দির হল ১৮৯৫ তে, পৌষ উৎসব চালু হল, তবে মেলা তার পরে। প্রথম পৌষ উৎসব ও মন্দির প্রতিষ্ঠার বর্ণনা পাওয়া যায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়। ৭ পৌষের সকালে সঙ্কীর্তন আরম্ভ হল। শ্রদ্ধাভক্তি সহকারে সবাই শান্তিনিকেতন বাড়ি থেকে মন্দিরের দিকে যেতে লাগল। বেহালা থেকে আগত ব্রাহ্মবন্ধুরা মৃদঙ্গ বাজিয়ে গাইতে লাগল — ‘প্রাণ ভরে গান কর, ভবে ত্রাণ পাবে আর নাহি ভয়’। এ গান লিখেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। মন্দিরের দরজায় এসে কীর্তন থামল।
মহর্ষি প্রয়াণের পর রবীন্দ্রনাথ এই ত্রিদিবসের রূপকার। শান্তিনিকেতনে পৌষমেলা প্রথম বসল ১৮৯৪ সালে, ৭ পৌষ, মন্দিরের পাশের মাঠে ও ছাতিমতলার ছায়ায়। উৎসবের সূচনা হয় বৈতালিক গানে। গাওয়া হয় —
আজি যত তারা তব আকাশে
সবে মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে ॥
নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া, মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে,
তব নিকুঞ্জের মঞ্জরী যত আমারি অঙ্গে বিকাশে ॥
মন্দিরের সোপানে দাঁড়িয়ে অনাথ আতুরদের বস্ত্র ভোজ্য উৎসর্গ। উপাসনায় তাঁর ভাষণ। ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থমালায় রবীন্দ্র ভাষণগুলি সংকলিত-
“শান্তিনিকেতনের সাম্বৎসরিক উৎসবের সফলতার মর্মস্থান যদি উদঘাটন করে দেখি, তবে দেখতে পাব, এর মধ্যে সেই বীজ অমর হয়ে আছে, যে বীজ থেকে এই আশ্রম-বনস্পতি জন্মলাভ করেছে, সে হচ্ছে সেই দীক্ষাগ্রহণের বীজ”। … মহর্ষির জীবনের একটি ৭ পৌষকে সেই প্রাণস্বরূপ অমৃতপুরুষ একদিন নি:শব্দে স্পর্শ করে গিয়েছেন, তার উপরে আর মৃত্যুর অধিকার রইল না।
শুধু ভাষণ বা বক্তৃতা নয়, চিঠিপত্রেও আছে এই পৌষপার্বণ সম্পর্কে কবির শ্রদ্ধা ও অনুরাগ।
‘আজ ৭ই পৌষ। … কাল রাত্রে ঘুম থেকে প্রায় মাঝে-মাঝে জেগে উঠে ব্যথা বোধ করছিলুম, স্বপ্ন দেখলুম, তোমাদের সকালকার উৎসব আরম্ভ হয়েছে। আমি যেন এখান থেকে সেখানে গিয়ে পৌঁছেছি, কিন্তু কেউ জানে না। তুমি তখন গান গাচ্ছ, –
জাগো সকলে (এবে) অমৃতের অধিকারী।
নয়ন খুলিয়া দেখ করুণানিধান, পাপতাপহারী
পুরব-অরুণ-জ্যোতি মহিমা প্রচারে,
বিহগ যশ গায় তাহারি।
আমি মন্দিরের উত্তর বারান্দা দিয়ে আস্তে আস্তে ছায়ার মতো যাচ্ছি তোমাদের পিছনে গিয়ে বসব, তোমরা কেউ কেউ টের পেয়ে আশ্চর্য হয়ে উঠেছ। এমনতরো সুস্পষ্ট স্বপ্ন আমি অনেকদিন দেখিনি, জেগে উঠে ঐ গানটা আমার মনে স্পষ্ট বাজতে লাগল। হায়রে, এদেশে কি তেমন সকাল হয় না?’’
মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
একেলা রয়েছ নীরব শয়ন-‘পরে–
প্রিয়তম হে, জাগো জাগো জাগো ॥
‘প্রিয় রাণু’কে লিখছেন তার স্কুলের প্রাইজের মজার খবরের জবাবে, ‘‘তোমাদের প্রাইজে কত লোক জমা হয়েছিল? পঞ্চাশ জন? কিন্তু আমাদের এখানে মেলায় অন্ততঃ দশ হাজার লোক তো হয়েইছিল।… এখানকার মাঠে যা চিৎকার হয়েছিল তাতে কত রকমেরই আওয়াজ মিলেছিল, তার কি সংখ্যা ছিল। ছোটো ছেলের কান্না, বড়োদের হাঁকডাক, ডুগডুগির বাদ্য, গোরুর গাড়ির ক্যাঁচকোঁচ, যাত্রার দলের চিৎকার, তুবড়িবাজির সোঁ সোঁ, পটকার ফুটফাট, পুলিশ-চৌকিদারের হৈ হৈ, হাসি, কান্না, গান, চেঁচামেচি, ঝগড়া ইত্যাদি ইত্যাদি।’’
আশ্রমের প্রথম যুগের ছাত্র সুধীরঞ্জন দাস লিখছেন — ‘সাতই পৌষের দিন তিনেক আগে থাকতেই লোক সমাগম শুরু হল। কতদূর গ্রাম থেকে গোরুর গাড়িতে পসরা বোঝাই করে কত দোকানী পসারী আসতে লাগল। কত রকমের হাঁড়ী কলসী – কোনোটা বা লাল, কোনোটা বা কালো। … সন্ধ্যার সময় মন্দিরে উপাসনা করলেন গুরুদেব। রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর ছোট ছোট দল বেঁধে এক একজন মাস্টার মশায়ের তত্ত্বাবধানে ছেলেরা বাজি দেখতে গেল। তখনকার দিনে বাজি পোড়ানো হত রতনকুঠির উত্তর পুব দিকে। অনেক রাতে প্রাক্ কুটিরে ফিরে এসে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়া গেল।
আরেক প্রাক্তনী, ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মা লিখছেন, ‘‘৭ই পৌষের ভোর চারটায় দিনেন্দ্রনাথের পরিচালনায় বৈতালিক গানের দল গান গেয়ে আশ্রম প্রদক্ষিণ করত। দিনুবাবুর দরাজ কণ্ঠস্বর কানে ভেসে আসত সকলের মিলিত কণ্ঠস্বরের ঊর্ধ্বে। আমরা কয়েকজন উৎসাহী ছাত্র বৈতালিকের আগেই শেষ রাত্রির অন্ধকারে কুয়ো থেকে জল তুলে স্নান করে নিতাম।’’
প্রমথনাথ বিশী-ও পুরোনো কালের ছাত্র। তাঁর লেখাতেও ৭ই পৌষের উৎসবের চমকপদ বিবরণ আছে। তিনি লেখেন — ‘‘সন্ধ্যার সময়ে মেলার ভিড় এত বাড়িয়া উঠিত যে, তাহা সংযত করার সাধ্য রায়পুরের রবিসিংহ ছাড়া আর কাহারো ছিল না। হাঁ, জনতা সংযত কবিবার মতো চেহারা বটে! রবিসিংহের ধুতি লাল, চাদর লাল, পাগড়ি লাল, চক্ষুদুটোও যেন লাল। পুলিশের তো শুধু পাগড়ি লাল। এই শক্তি-পুরুষ বেত হাতে সপাসপ জনতাকে আঘাত করিয়া চলিয়াছেন, জনতা শশব্যস্ত হইয়া আত্মনিয়ন্ত্রণ করিতেছে।… রবিসিংহ আধুনিক ডিরেক্টরদের অখ্যাত পূর্বপুরুষ।’’
শুধুই স্মৃতির মেলা, তিন দিনের স্মৃতির সংসার! সেই যে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “মেলাই আমাদের দেশে বাহিরকে ঘরের মধ্যে আহ্বান করবে’’
তবে, এ সবই আজ ইতিহাস হতে চলেছে। দশকের পর দশক ধরে শান্তিনিকেতন, বিশ্বভারতী যে মানবতার, সৌভ্রাতৃত্বের আদর্শ তুলে ধরেছে, যার আকর্ষণে ছুটে আসেন দেশ-দেশান্তরের মানুষ, তা স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদদের হাতে নষ্ট হতে বসেছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে এক অরাজকতার পরিবেশ। অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগে সরগরম বিশ্বভারতী। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ বেঁচে থাকলে কি বলতেন তা অনুমান করাই যায়।
ঘটনার সূত্রপাত ১৭ই আগস্ট ২০২০। বিশ্বভারতী চত্বরে পৌষ মেলার প্রাঙ্গণে একটি প্রাচীর তৈরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে শান্তিনিকেতন। কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, নির্মীয়মান প্রাচীর ভেঙে ফেলে একদল বহিরাগত। এই দলকে নাকি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এক প্রতিবাদী পক্ষ। প্রতিবাদী পক্ষের দাবি, মুক্তচিন্তার যে স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন, তা ধূলিস্যাৎ করতেই এই প্রাচীর তৈরি। রবীন্দ্র ঐতিহ্যের পরিপন্থী এই প্রাচীর বিশ্বভারতীর লজ্জা। এ বিষয়ে অপর পক্ষ বলেন, “এখানে রাজনীতির কিছুই নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া, শিক্ষকরা কেউই কোন সীমানা প্রাচীর চান না। তাই সবাই এর প্রতিবাদ করেছেন। এটা খুবই স্বতঃস্ফূর্ত একটি প্রতিবাদ।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২১ সালে বিশ্বভারতী স্থাপন করেছিলেন। প্রথাগত পড়াশোনা তাঁর জেলের মতো মনে হতো, তাই সবাই যাতে প্রকৃতির মাঝে, খোলা আকাশের নীচে পড়াশোনা করতে পারে, সেজন্যেই বানিয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বভারতী বাংলার একমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। যার আচার্য স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী।
উল্লেখ্য, ১২৫ বছরের প্রথা ভেঙে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পৌষমেলা এবছর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু, এই সিদ্ধান্তের কারণ শুধুমাত্র যে কোভিড পরিস্থিতি, তা নয়। এতো বড় অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে না কি অপারগ বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে বন্ধ করা হয়েছিল বসন্ত উৎসবও। একের পর এক এরকম সিদ্ধান্তকে কর্তৃপক্ষের স্বৈরাচারীতা হিসেবেই দেখছেন পড়ুয়া এবং এলাকাবাসীরা। সীমান্ত প্রাচীর তারই অন্যতম প্রমাণ।
বিশ্ব কবির আশ্রম রাজনীতির কাদামাখা কুস্তির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বিশ্বভারতীতে পাঁচিল কাণ্ডে এমনটাই মত বিদ্বজ্জনদের। বুদ্ধিজীবীরা খোলা আবেদনে অনুযোগ করেছেন, বহুদিনের ঐতিহ্য-বাহিত স্মৃতি, শান্তিনিকেতনের সুষমা ও বিশ্বভারতীর শিক্ষা … সবই সমূলে নষ্ট হতে বসেছে। এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন সকলেই।
তবে পথ দেখাবেন কবিই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘অচলায়তন’ নাটকে দেওয়াল ভাঙার কথাই লিখেছিলেন। যে দেওয়ালের জন্য গুরু প্রবেশ করতে পারেন না, সেই দেওয়াল ভেঙেই ফেলা উচিত। আজ রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্য সঙ্কটের মুখে। তাই কোমর বাঁধছেন রবীন্দ্র-অনুরাগীরা। অচলায়তনের বাঁধ ভাঙতেই হবে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।