|| সাহিত্য HUT -এর বড়দিন সংখ্যা || প্রবন্ধে ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

রবিঠাকুরের ঋতুরাজ শিশুদের প্রিয় চাচাজী
শান্তিনিকেতনের শ্যামলীতে রবীন্দ্রনাথ জওহরলাল নেহরুর ‘আত্মজীবনী’ গ্রন্থ পড়া শেষ করে বসলেন নেহরুকে চিঠি লিখতে। ১৯৩৬ সালের ৩১ মে, ‘প্রিয় জওহরলাল’কে লিখলেন, “এই মাত্র আমি তোমার মহাগ্রন্থ পড়া শেষ করেছি। তোমার এই কীর্তির দ্বারা আমি গভীরভাবে প্রভাবিত ও গৌরবান্বিত। গ্রন্থের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের মধ্য দিয়ে মনুষ্যজাতির এমন এক নিগূঢ় ধারা প্রবাহিত যা সত্যের জটিলতা অতিক্রম করে সেই ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাবার যিনি তাঁর কীর্তির চেয়ে মহৎ এবং পরিবেষ্টনের চেয়ে সত্য। – তোমার একান্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
অন্যদিকে জওহরলাল নেহেরু লিখছেন “যখনই এখানে আসি, আমার সাহস বাড়ে আমি পুনরুজ্জীবিত হই। যেন আমার কানে আসে গুরুদেবের কন্ঠস্বর। তাঁর বাণী প্রতিধ্বনিত হয় আমার মনে। আমি তাতে উৎসাহিত হই এবং এখান থেকে ফিরে যাই। আশা করি যেমন আমি এসেছিলাম তার চেয়ে একটু উন্নত হয়ে ফিরছি” ।
রবীন্দ্রনাথের ঋতুরাজ জওহরলাল নেহরু। যাঁর জন্ম ১৮৮৯ সালের ১৪ই নভেম্বর। এই ১৪ই নভেম্বর আবার শিশু দিবস। পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে প্রতিবছর বেশ আনন্দের সঙ্গেই পালিত হয় এই দিনটি। শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা ছিল তাঁর। তাঁর এই ভালোবাসাই তাঁকে পরিচিতি দিয়েছে সবার প্রিয় চাচাজী হিসেবে। তিনি বলেছিলেন আজকের একটি শিশুই তৈরি করবে আগামীকালের ভারতবর্ষ। দেশের ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে শিশুদের মধ্যে। আজ যেভাবে আমরা তাদের বড় করে তুলব, সেভাবেই বড় হয়ে দেশ গঠন করবে তারা।
জওহরলাল আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন যে তাঁর পিতার ও কবি রবীন্দ্রনাথের জন্মের বছর, মাস ও দিন একই। তাই তাঁর সঙ্গে কবির সম্পর্ক যে পুত্র ও পিতার মত ছিল একথা একাধিক অর্থেই বলা যায়। জওহরলালের সঙ্গে বিশের দশকে যখন রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে তখন তিনি নোবেল বিজয়ী এক আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব এবং দেশের মধ্যে শান্তিনিকেতন প্রতিষ্টার মধ্য দিয়ে আশ্রমের প্রাচীন-ঐশ্বর্য্যের সঙ্গে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক মেল-বন্ধন ঘটিয়েছেন – যা’ জওহরলালকে এমন মুগ্ধ করেছিল যে তাঁর একমাত্র মেয়ে ইন্দিরাকে সেখানে রাখতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল অফুরন্ত। রবীন্দ্রনাথের প্রভাবকে তিনি তুলনা করেছেন ‘পর্বত চূড়ায় ঊষার আলোক’-এর সঙ্গে যার ছড়িয়ে-পড়া প্রভা দেশবাসীর মনের জগতকে উদ্ভাসিত করতে সাহায্য করেছিল । যৌবনে-পাওয়া এই দুই গুরুর সম্বন্ধে স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে পরিণত বয়সের জওহরলাল লিখছেন –
“I belong to a generation which grew up under his influence. Perhaps we did not fully realize at the time because of the powerful impact of Gandhi’s thunderbolt. I speak more for the non-Bengali speaking people in India, and more especially students and the younger intellectuals who did not have the advantage of reading Tagore in the original Bengali. In Bengal his influence was no doubt deeper and more pervasive because his songs reached the masses of the people”.
জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৯১৯ এর এপ্রিলে । এই ঘটনার জন্য দায়ী বিদেশী শাসককে ধিক্কার জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাইটহুডের খেতাব ফিরিয়ে দেন বড়লাট সাহেবকে লেখা একটি অসাধারণ চিঠির মাধ্যমে।
Your Excellency,
The enormity of the measures taken by the Government in the Punjab for quelling some local disturbances has, with a rude shock, revealed to our minds the helplessness of our position as British subjects in India. The disproportionate severity of the punishments inflicted upon the unfortunate people and the methods of carrying them out, we are convinced, are without parallel in the history of civilised governments, barring some conspicuous exceptions, recent and remote….
…. The time has come when badges of honour make our shame glaring in the incongruous context of humiliation, and I for my part wish to stand, shorn of all special distinctions, by the side of those of my countrymen, who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fit for human beings…..
Yours faithfully,
Rabindranath Tagore
কবির সংগে জওহরলালের তখনও ব্যক্তিগত পরিচয় হয়নি , কিন্তু কবির এই পত্রটি তাঁকে অভিভূত করে । তিনি দেশের রাজনীতিতে কবির প্রভাব এই ভাবে দেখেছিলেন – “রবীন্দ্রনাথ রাজনীতি জগতের মানুষ ছিলেন না, কিন্তু হৃদয়ের গভীর অনুভূতিশীলতা তাঁকে কবিতা বা সংগীতের ভাবের জগৎ থেকে বারে বারে সরিয়ে এনেছে। যখনই কোনও পরিস্থিতি তাঁর অসহনীয় মনে হয়েছে, তখনই তিনি বিদেশী শাসক বা তাঁর নিজ দেশবাসীর ঊদ্দেশ্যে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার ভূমিকা নিয়ে সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন … জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর নাইট উপাধি ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা দেশের রাজনীতির জগতকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল”।
অনেক বছর পরে জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লিখছেন – “পরবর্তী কালে কবির প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়ে । তাঁর চিন্তা ও তাঁর জীবন দর্শনের সঙ্গে আমি যথেষ্ট একাত্মতা বোধ করতে শুরু করি”।
তাঁর জীবনে “দুই গুরুর” প্রভাব সম্বন্ধে তিনি আবারও লিখলেন – “আমি চিন্তাকরে অবাক হই যে কিভাবে কবির বিশাল সৃষ্টি এবং তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাকে এবং আমাদের সময়কে প্রভাবিত করেছিল । কর্ম জীবনে গান্ধীজির সঙ্গেই আমার ঘনিষ্ঠতা, কিন্তু তাও আমি বলব আমার মন রবীন্দ্রনাথের সুরেই বিশেষ ভাবে সাড়া দেয়” ।
শান্তিনিকেতনের প্রতি ও তাঁর অনুভূতিশীল মন আকৃষ্ট হয় এবং তিনি কর্মব্যস্ত জীবনে যখনই সময় করতে পেরেছেন কবির সঙ্গে দেখা করতে শান্তিনিকেতনে গেছেন । রিক্ত, নিস্ফলা পারিপার্শিকের মধ্যে শান্তিনিকেতনকে তিনি একটি মরূদ্যান বলে বর্ণনা করেছেন (an oasis in the midst of much barrenness) ।
১৯৩৪ সালের ১৬ই জানুয়ারী কলকাতা থেকে জওহরলাল কবিকে তার পাঠালেন এই মর্মে যে তিনি ও তাঁর পত্নী শান্তিনিকেতনে আসতে চান কবিকে শ্রদ্ধা জানাতে। ১৯ তারিখে ট্রেনে এসে পৌছলেন নেহরু-দম্পতি। কবি তাঁদের অভ্যর্থনা করলেন সাদরে, নিজের কন্ঠে বেদ মন্ত্রোচ্চরণের মাধ্যমে । বিলেতে শিক্ষিত জওহরলালের সংস্কৃত জ্ঞান ছিল হয়ত স্বল্প, কিন্তু কৌতূহল ছিল অদম্য । তিনি ঐ সংস্কৃত মন্ত্রগুলির ইংরেজি অনুবাদ কবির একান্ত সচিব অনিল চন্দের কাছে চেয়ে পাঠান । বিদায় নেবার সময় তাঁর মন্তব্য লিখে গেলেন – “জীবনের যাত্রা পথের একটি আনন্দময় দিনের স্মৃতিতে ” (in memory of a delightful day in life’s journey) । নেহরু-পত্নী কমলাও সই করলেন মন্তব্যটির নীচে। ইন্দিরাকে শান্তিনিকেতনে পড়ানোর ব্যাপারে নেহরু-দম্পতি কবির সঙ্গে কথা বলেন । যে চিন্তা থেকে তিনি ইন্দিরাকে শান্তিনিকেতনে পাঠাতে চেয়েছিলেন সে সম্বন্ধে তিনি বিস্তারিত লিখেছেন যার সার-সংক্ষেপ হল –
শান্তিনিকেতনের আবহাওয়া থেকে, এবং বিশেষত, গুরুদেবের উপস্থিতিতে ও তাঁর সাহচর্যে, ইন্দিরা কিছু আহরণ করতে পারবে (she would imbibe something of the atmosphere of the place and, more particularly, profit by the presence of and contact with Gurudev) ।
কমলা নেহরুর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় তাঁকে এলাহাবাদের বাসস্থান থেকে ভাওয়ালীতে একটি স্বাস্থ্য নিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। জওহরলাল নিজে তখন জেলে। রবীন্দ্রনাথ নিজের উদ্যোগে উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপালকে টেলিগ্রাম করে জওহরলালকে মুক্তি দেওয়ার অনুরোধ জানান যাতে তিনি তাঁর রুগ্ন স্ত্রীর পাশে থেকে তাঁর সেবা করতে পারেন। জওহরলাল আলমোড়া জেল থেকে নিয়মিত তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে যাওয়ার অনুমতি পান। পরে কমলাকে চিকিৎসার জন্য ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয় । কিন্তু যে কালব্যাধিতে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন সেই যক্ষ্মারোগে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে সুইজারল্যান্ডে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে ।
কমলার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একবারই সাক্ষাৎ হয়েছিল, কিন্তু সেই তরুণী-কন্যার-মাতা, স্বামী সঙ্গ বঞ্চিত যুবতীটির মনের বেদনা তিনি নিশ্চয় বুঝতে পেরে থাকবেন । তাই তাঁর অকাল মৃত্যু কবিকে বিশেষ পীড়া দিয়েছিল । ১৯৩৬ সালের বসন্ত-পূর্ণিমার দিনটিকে (৮ই মার্চ, ২৩শে ফাল্গুন) শান্তিনিকেতন কমলার স্মরণসভা হিসেবে পালন করে । আবেগ-মাখানো দীর্ঘ একটি ভাষণে কবি কমলা এবং জওহরলাল দুজনকেই স্নেহভরে স্মরণ করলেন –
“আজ কমলা নেহরুর মৃত্যুদিনের কথা বিশেষভাবে স্মরণ করবার জন্য আমরা আশ্রমবাসীরা মন্দিরে সমবেত। একদিন তাঁর স্বামী যখন কারাগারে, যখন তাঁর দেহের উপরে মরণান্তিক রোগের ছায়া ঘনায়িত, সেই সময় তিনি তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে আমাদের আশ্রমে এসেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য এই যে, সেই দুঃসময়ে তাঁর কন্যাকে আশ্রমে গ্রহণ ক’রে কিছুদিনের জন্যে তাঁদের নিরুদ্‌বিগ্ন করতে পেরেছিলেম। সেই দিনের কথা আজ মনে পড়ছে– সেই তাঁর প্রশান্ত গম্ভীর অবিচলিত ধৈর্যের মূর্তি ভেসে উঠছে চোখে সামনে।
কমলা নেহরু যাঁর সহধর্মিণী, সেই জওহরলাল আজ সমস্ত ভারতের তরুণ হৃদয়ের রাজাসনে প্রতিষ্ঠিত হবার অধিকারী। অপরিসীম তাঁর ধৈর্য, বীরত্ব তাঁর বিরাট– কিন্তু সকলের চেয়ে বড়ো তাঁর সুদৃঢ় সত্যনিষ্ঠা। পলিটিক্সের সাধনায় আত্মপ্রবঞ্চনা ও পরপ্রবঞ্চনার পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে তিনি নিজেকে কখনো হারিয়ে ফেলেন নি।
আজ হোলির দিন আজ সমস্ত ভারতে বসন্তোৎসব। চারি দিকে শুষ্কপত্র ঝ’রে পড়ছে, তার মধ্যে নবকিশলয়ের অভিনন্দন। আজ জরা-বিজয়ী নূতন প্রাণের অভ্যর্থনা জলে স্থলে আকাশে। এই উৎসবের সঙ্গে আমাদের দেশের নব-জীবনের উৎসবকে মিলিয়ে দেখতে চাই। আজ অনুভব করব যুগসন্ধির নির্মম শীতের দিন শেষ হল, এল নবযুগের সর্বব্যাপী আশ্বাস। আজ এই নবযুগের ঋতুরাজ জওহরলাল”।
এই ভাষণটির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে আবারও অভিভূত জওহরলাল এলাহাবাদ থেকে ১লা এপ্রিল একটি চিঠি লিখে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানালেন সবিনয়ে –
“কমলা সম্পর্কে আপনি আপনার অতুলনীয় উদারতায় যে কথাগুলি বলেন, তা আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে । আপনার আশীর্বাদ পেয়ে আমি কত শক্তি লাভ করি । শক্তি পাই এই কথা ভেবে যে আপনি আমাদের মত পথভ্রান্ত দের সঠিক পথে চালিত করার জন্যই আমাদের মধ্যে রয়েছেন”।
সেপ্টেম্বর মাসে (১৯৩৭) কবি অসুস্থ হয়ে কলকাতায় প্রশান্তচন্দ্র মহালনাবিশের বরাহনগরের বাড়িতে চিকিৎসার জন্য উঠলে জওহরলাল তাঁকে দেখতে যান। সে সময়ে ‘বন্দেমাতরম্’–কে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে কংগ্রেস গ্রহণ করবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। কংগ্রেসের মুসলমান সদস্যদের একাংশের মতে এতে পৌত্তলিকতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছিল। জওহরলাল সুভাষচন্দ্রের পরামর্শ অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার সময়ে ‘বন্দেমাতরম্’ বিতর্ক নিয়েও আলোচনা করেছিলেন এবং তাঁর মতামত প্রার্থনা করেন। ‘বন্দেমাতরম্’ সম্পর্কে তাঁর মূল কথা হল এর প্রথম দুটি স্তবকে নিছক দেশ মাতৃকার বন্দনার কথা বলা হয়েছে যার সঙ্গে পৌত্তলিকতার কোনও সম্পর্ক নেই। ‘আমি মনে করি না এটা কোনও গোষ্টি বা সম্প্রদায়কে অপমান করবে’। (‘Which I See nothing to offend any sector community’)। জওহরলাল রবীন্দ্রনাথের মতামতকে স্বীকার করে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকে ‘বন্দেমাতরম্’-এর প্রথম দুটি স্তবককে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়ার ব্যবস্থা নিলেন।
১৯৩৯ সালের ৩১ জানুয়ারি রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে জওহরলাল শান্তিনিকেতনে এলেন নবনির্মিত হিন্দি ভবনের দ্বার উদ্ঘাটন করতে। কবির আদরণীয় অতিথি হিসাবে তিনদিন (৩১ জানুয়ারি – ২ ফেব্রুয়ারি) আশ্রমে ছিলেন। ‘উত্তরায়ণ’-এ উঠেছিলেন। শেষদিন সুভাষচন্দ্র এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। জওহরলাল ও সুভাষচন্দ্র উভয়েই ২ ফেব্রুয়ারি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করেন। জওহরলালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষ দেখা হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর প্রায় দু-বছর আগে (১৯ আগষ্ট, ১৯৩৯) কলকাতার বাড়িতে। চিন যাওয়ার পথে তিনি কলকাতায় এসেছিলেন কবির সঙ্গে দেখা করতে। এ বিষয়ে তিনি ‘ডায়েরি অব ট্রাভেল’-এ লিখেছিলেন,
“শুনলাম কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতায় আছেন। গুরুদেবের সঙ্গে দেখা করার আনন্দ কখনও হারানো যায় না। আমি হোটেল থেকে তাঁর বাড়িতে যাই এবং অল্প সময় হলেও তার মধ্যে তিনি আমাকে মহান এশিয় সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেন, এবং প্রাচ্য দেশগুলির সাথে যোগাযোগের প্রয়োজনীতার কথাও বলেন” ।
১৯৪১ সালের ৭ আগষ্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮) রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ ঘটল ১২-১০ মিনিটে। রবীন্দ্রনাথ যখন মারা যান, তখন জওহরলাল কারাবন্দি। ১৯৪১ সালের ১৭ই আগষ্ট জেলখানা থেকে তিনি এক হৃদয়স্পর্শী চিঠি লেখেন কৃষ্ণকৃপালনিকে তাঁর শোক জ্ঞাপন করে। চিঠির অংশবিশেষ উদ্ধৃত হল:
“মনে হয় কতদিন! মানুষ একদিন না একদিন মারা যাবেই এবং গুরুদেবও বেশিদিন বাঁচতেন না। তবু তাঁর মৃত্যু আমায় প্রচন্ড আঘাত দিয়েছে – যখনই ভাবি আমি তাঁর সুন্দর মুখ দেখতে পাব না, শুনতে পাব না তাঁর সুভদ্র কন্ঠস্বর – চিন্তা করলেই আমি প্রচণ্ড বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। যেদিন থেকে আমি জেলে এসেছি সেদিন থেকে এই চিন্তা আমার পিছু নিয়েছে। আমি কত যে তাঁকে দেখতে চেয়েছিলাম। এই নয় যে তাঁকে আমার বিশেষ কিছু বলার ছিল এবং এটা নিশ্চিত আমি তাঁকে কোনওভাবে ব্যস্ত করতে চাইনি। আগে থেকে একটা আশঙ্কা জাগছিল আমি বোধহয় আর তাঁকে দেখতে পাব না আর এই আশঙ্কার জন্যই আমি তাঁকে দেখার জন্য আকুল হয়েছিলাম। যাই হোক, যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন দুঃখের বদলে আমরা অভিনন্দন জানাতে পারি এই ভেবে যে আমাদের সুযোগ এসেছিল এমন এক মহান এবং চমকপদ ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসার। এটাই বোধহয় ঠিক যে সময়ে মারা গেলেন, সে সময়ও তিনি কাব্য, কবিতা ও গান রচনায় মগ্ন ছিলেন – কি অসাধারণ সৃষ্টিশীল ছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন, এরকম অবস্থা দেখতে আমি মোটেই রাজি ছিলাম না। (‘I would have hated to see him fade away gradually’) যা হওয়া উচিত তা হয়েছে। তিনি পূর্ণ গৌরবের সঙ্গে মারা গেছেন”। (‘He died, as he should in the fullness of his glory’)।
আর জওহরলাল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ অসাধারণ মূল্যায়ণ করেছিলেন মাত্র দু-লাইনে মংপু থেকে অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক চিঠিতে। ‘কংগ্রেস’ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি জওহরলালের বিষয়ে বলেছেন,
“আমি সর্বান্তঃকরণে শ্রদ্ধা করি জওহরলালকে, যেখানে ধন বা অন্ধধর্ম বা রাষ্ট্রপ্রভাব ব্যক্তিগত সংকীর্ণ সীমায় শক্তির ঔদ্ধত্য পুঞ্জীভূত করে তোলে সেখানে তার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান”।
ঋণ: রবীন্দ্রজীবনী – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবিজীবনী – প্রশান্তকুমার পাল। রবীন্দ্র প্রসঙ্গ – পশ্চিমবঙ্গ সরকার। ভারতের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা – ১৯৯৬। Rabindranath Tagore – Krishna Kripalini।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।