প্রবন্ধে ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

অসুর ও দেবতা – বৈমাত্রেয় ভ্রাতা

পৌরাণিক উপাখ্যান পড়ে আজ আমরা সকলেই জানি – দেবী দুর্গা খলনায়ক অপরাজেয় দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ মহিষাসুরকে যুদ্ধে পরাজিত করেছেন। তারপরেই তিনি মহিষাসুরমর্দ্দিনি নামে খ্যাত হলেন সারা বিশ্বের ইতিহাসে। কিন্তু এই দোর্দ্দন্ডপ্রতাপ মহিষাসুর কে ছিলেন? কিভাবেই বা তার জন্ম?
আমাদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মধ্যে ইতিহাসের গোঁড়ার কথা লুকিয়ে আছে। ঋগ্বেদ বলছে, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, রুদ্র সব বৈদিক দেবতাই নাকি অসুর। মায় সূর্যদেবও ‘সোনালি হাতের দয়ালু অসুর।’ ঋগ্বেদই জানিয়ে দিল, অসুর কোনও ঈশ্বরবিরোধী শয়তান নয়। শক্তিমান এক পুরুষ। এই ‘অসুর’ শব্দের সঙ্গে বিশেষজ্ঞরা পারসিক দেবতা আহুর’-এর মিল লক্ষ করেছেন।
বেদের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ‘অসুর’ শব্দের অর্থও সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়। ঋকবেদের শেষ খণ্ড এবং অথর্ববেদে দেবতা বিরোধী দৈত্য ও দানবদেরই অসুর বলে অভিহিত করা হয়েছে। অসুর জাতির জন্মের নানা কাহিনী নানা পুরাণে পাওয়া যায়। বিষ্ণুপুরাণ মতে ব্রহ্মার জঙ্ঘা থেকে অসুরদের সৃষ্টি হয়। ঐতেরয় ব্রাহ্মণ ও শতপথ ব্রাহ্মণ অনুযায়ী ব্রহ্মার ‘অসু’ বা নিশ্বাস একবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এবং তার থেকেই অসুরদের জন্ম হয়। রবীন্দ্রনাথের অসুরদের সম্বন্ধে কোনও দুর্বলতা ছিল কি না জানি না, তবে এই প্রসঙ্গে তাঁর তাসের দেশ নৃত্যনাট্য পিতামহ ব্রহ্মার হাঁচি থেকে সহজ স্বাভাবিক মানুষের উৎপত্তির কথা মনে পড়ে। মনুর মতে ব্রহ্মার মানসপুত্র প্রজাপতিদের থেকেই অসুরদের জন্ম হয়। মনুর ব্যাখ্যা অনুসারে দেবতা, দৈত্য ও দানবরা জন্ম সূত্রে বৈমাত্রেয় ভাই কারন প্রজাপতি মরীচির কশ্যপের ঔরসে এবং প্রজাপতি দক্ষের তিন কন্যা অদিতি, দিতি ও দনুর গর্ভে এই তিনজাতির জন্ম হয়। অসুর নামের অন্য একটি বাখ্যা অনুসারে সমুদ্রমন্থনের সময় বরুণের কন্যা বারুণী বা সুরাকে প্রত্যাখান করবার জন্যে দৈত্য ও দানবদের নাম হয় অসুর।
আবার এক উপাখ্যান থেকেই জানা যায় মহিষাসুর ছিলেন রাজার পুত্র, পুরাণ অনুসারে রম্ভাসুরের পুত্র। যিনি ঘোরতর কঠিন তপস্যা করে ব্রহ্মার বলে বলীয়ান। তার পিতা রম্ভ ছিলেন দনুর পুত্র! কিন্তু কেন তিনি তপস্যা করেছিলেন? পুরাণ বলছে, দনু হলেন দক্ষের এক কন্যা, ঋষি কাশ্যপের স্ত্রী। তিনি চল্লিশটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, তাদের বলা হয়, দানব বা দৈত্য। এরকমই তাঁর দুই পুত্র হলেন, রম্ভ ও করম্ভ। আর দনু ছিলেন খুব উচ্চাকাঙক্ষী। যখন তাঁর বড় ছেলে রম্ভ অসুরলোকের অধিপতি, তখন দনু পরামর্শ দেন স্বর্গ জয় করার জন্যে! কীভাবে তা হবে তার উপায়ও বাতলে দেন মাতা দনু। রম্ভকে বললেন, নদীর ধারে গিয়ে অগ্নিদেবের প্রার্থনা করতে। আর এক ছেলে করম্ভকে বললেন, বরুণদেবের প্রার্থনা করতে। মায়ের কথা শুনে রম্ভ আর করম্ভ গেলেন নদীর পাড়ে। রম্ভ নদীতীরে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে তপ করতে লাগলেন। আর করম্ভ বুকসমান জলে নেমে বরুণের স্তুতি করতে লাগলেন। দিন যায়, মাস যায়। দেবরাজ ইন্দ্র দেখলেন, এভাবে তপস্যা চললে তো ঘোর বিপদ! একটি কুমিরের রূপ ধরে তিনি কামড়ে ধরলেন করম্ভের পা। টেনে নিয়ে গেলেন জলের তলায়। সেখানে দু’জনে লড়াই হয়। মারা যান করম্ভ।
করম্ভের অকালমৃত্যুতে বিষাদগ্রস্ত রম্ভ হঠাৎ বসে গেলেন ঘোরতর তপস্যায়। দেবাদিদেব শিব তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর দেন যে রম্ভের ইচ্ছানুসারে আগামী তিন প্রজন্ম ধরে তিনি তাঁর পুত্র হিসাবে জন্ম নেবেন। তবে সুকৌশলে মহাদেব আরও যোগ করে বললেন – “যার প্রতি চিত্ত সমর্পণপূর্বক তুমি তোমার এই নশ্বর দেহটি অর্পণ করবে তাঁর গর্ভেই জন্ম নেবে সেই পরাক্রমশালী কাঙ্ক্ষিত পুত্র”। এভাবে বরলাভে মহানন্দে রম্ভ একদিন ঘুরতে ঘুরতে এসে পৌঁছান যক্ষ পদ্মনিধির কাছে। সেখানে বিহাররত নানাবিধ পশু যেমন, গজ, অশ্ব, অজ প্রভৃতির পাশাপাশি বছর তিনেকের ফুটফুটে ঋতুমতী নাবালিকা মহিষও ছিল। কামাতুর রম্ভ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সেই মহিষীনীর সাথে তৎক্ষণাৎ রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হন। জন্ম হয় এক বিচিত্র বর্ণশঙ্কর ভয়ংকর মহাবলী পুত্রের – মহিষাসুরের।
এরপর শুরু হোলো মহিষাসুরের অমিতবিক্রম প্রদর্শন এবং দেবতাদের স্বর্গরাজ্য দখলের দুরভিসন্ধি। মদমত্ত অহংকারী মহিষাসুর ক্ষমতালিপ্সায় অন্ধ হয়ে হঠাৎ একদিন মারাত্মক ভুল করে বসলেন। ঋষি কাত্যায়নের এক তেজস্বী শিষ্য ছিলেন, নাম রৌদ্রাশ্ব। তিনি যখন গভীর বনে একাগ্র চিত্তে তপস্যায় মগ্ন তখন মায়াবলে মহিষাসুর ছলনাময়ী নারীরূপে তাঁর ধ্যানভঙ্গ করতে উদ্যত হন। ঋষি তাঁর ছলনা জানতে পেরে মহিষাসুরকে অভিশাপ দেন – যে স্ত্রী- রূপ ধারন করে তুমি আমায় বিভ্রান্ত করলে সেই স্ত্রী – জাতির হাতেই তোমার মর্দন বা হনন হতে হবে। তিন মন্বন্তর নিষ্কণ্টক অসুর রাজ্যের ভোগী রাজাধিরাজ মহিষাসুরও এমন আশ্চর্য ভবিষ্যতবাণী শুনে ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু নিয়তি অলঙ্ঘনীয়। সৃষ্টি হোলো মহিষাসুর বধের জন্য বিশেষভাবে দৈবপ্রভাবদ্বারা প্রস্তুত এক অবধ্যা চন্ডীরূপিণী ভয়ংকরী দশভুজা নারী মূর্তির – মহিষাসুরমর্দিনীর। মহিষাসুর অবশেষে বধ হলেন। কিন্তু ষোড়শভূজা ভদ্রকালীর আশীর্বাদে তাঁর স্থান হোলো মহামায়ার পদতলে, পুজোও পেলেন তাঁর সাথে একাসনে। কেননা পূর্বে দেবাদিদেব শিবের দেওয়া বরের তিনজন্মের প্রথম সৃষ্টিতে উগ্রচণ্ডা মূর্তিতে মহিষাসুর তাঁর হাতে নিহত হয়েছিলেন, দ্বিতীয় সৃষ্টিতে ভদ্রকালী মূর্তিতে আর এখন শেষ জন্মে নিহত হলেন অসুর মূর্তিতে। প্রথম দুটিতে পদতলে গ্রহণ করেননি, কিন্তু এই শেষবারে মহিষাসুরের সব পাপ আসুরিক শক্তিকে পরাভূত করে তাঁকে ক্ষমা করে পদতলে স্থান দিয়ে গ্রহণ করলেন মহামায়া।
আসলে ঘটনার ক্রমগুলি থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় শিবই মহিষাসুর, মহিষাসুরই শিব। তন্ত্রযোগিনী শাস্ত্রে, কালিকাপুরাণে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই বলা হয় – “মহিষ ত্বং মহাবীর শিবরূপঃ সদাশিব” কিংবা “ওঁ মহিষাসুরায় নমঃ’ বলিয়া পাদ্যাদিদ্বারা পুজান্তে প্রণাম করিবে । “ওঁ মহিষ ত্বং মহাবীর ইন্দ্রাদিদেবমর্দক।
কিন্তু যদি ভারতীয় নৃতত্ত্বের একটু চর্চা করি, তাহলে অসুরেরাও দেবতা। প্রমাণ: রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণ। সেখানে দেবতা ও অসুর দু’পক্ষই প্রজাপতির পুত্র, বৈমাত্রেয় ভাই। ইন্দ্রের শ্বশুর পুলোমা নামক এক অসুর। ভক্ত প্রহ্লাদও হিরণ্যকশিপু নামে এক অসুরের পুত্র। কশ্যপ ঋষির ছেলে ময় দানব হয়েও দেবতাদের অলকাপুরী নির্মাণ করে। ইন্দ্রপ্রস্থে যুধিষ্ঠিরের প্রাসাদও বানায়। ময় দানবের স্ত্রী এক অপ্সরা, নাম হেমা। দেবাসুরের সংগ্রাম তাই শুধুই যুযুধান দুই সম্প্রদায়ের গোষ্ঠীসংঘর্ষের কাহিনি নয়। তারা সকলেই আত্মীয়, তাদের মধ্যে বিয়ে-থা’ও হতো একসময়!
অসুরদের সঙ্গে ইসলামের বা খ্রিস্টানদের শয়তানের কোনো মিল নেই, অসুর কোনও ঈশ্বরবিরোধী শয়তান নয়, তারাও ব্রহ্ম বিষ্ণু শিবের আরাধনা করে, তারা আসলে শক্তিমান পুরুষ যারা চায় স্বর্গ মর্তে দেবতাদের সরিয়ে শাসন ক্ষমতা দখল করতে, তাই দেব অসুরকে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীও বলা যায়!
খ্রিস্টের জন্মের আড়াই থেকে তিন হাজার বছর আগে ইরাকের কাছে আসিরীয় সভ্যতা ছিল, সেখানেও ছিলেন এই আহুর মজদা। আসিরীয় রাজা আসুরবানিপালের এক শিলালিপিতে কিউনিফর্ম লিপিতে রয়েছে ‘আসুর মজদা’র উল্লেখ। পার্সি ধর্মের ‘জেন্দ আবেস্তা’র একমাত্র ঈশ্বর: আহুর মজদা। ম্যাক্সমুলার থেকে মনিয়ের উইলিয়াম্স, অনেকেই ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখিয়েছিলেন, আহুর এবং বৈদিক সংস্কৃতির অসুর অনেকটা এক। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬০০ বছর আগে আসুরবানিপাল আসিরিয়ার রাজা হয়েছিলেন। শিলাপটে তাঁর সিংহ শিকারের কিছু ছবিও রয়েছে। মহিষ রাজার খোঁজে এ ভাবেই পশ্চিম এশিয়ার প্রত্নতত্ত্বে সিংহশিকারী এক নৃপতিকে পাওয়া গেল। ভাষাতত্ত্বের খেলায় প্রাচীন আসিরিয়া, অসুর এবং আহুর একদেহে হল লীন।
মহিষাসুরকে আর্য ভারত একভাবে মনে রেখেছে, কিন্তু অনার্য ভারতও তাকে মনে রেখেছে, মনে রেখেছে সম্মানের সঙ্গে! ব্যাঙ্গালোরের অদূরে মহীশূর শহরের চামুণ্ডী পাহাড়ে রয়েছে মহিষাসুরের বিরাট মূর্তি, মহিষাসুর আর তাঁর দুই সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডকে এই পাহাড়েই বধ করেছিলেন দুর্গা। মহিষাসুর থেকেই কালে কালে অপভ্রংশে মহীশূর নাম। চামুণ্ডি মন্দিরের প্রবেশচত্বরেই বিশাল মূর্তি। গোঁফ ও গালপাট্টাসহ রাজার মতো দাঁড়িয়ে, এক হাতে খড়্গ, আর এক হাতে সাপ। মহিষাসুর মানেই সিংহের আক্রমণে ত্রস্ত, দেবীর ত্রিশূলে বিদ্ধ কোনও মহিষরূপী দানব নয়।
মহিষাসুরের পূজা:
একটু লক্ষ্য করে দেখবেন, দশমীর দিনে পাড়ার পূজা প্যান্ডেলে মহিলারা যখন মা দুর্গা ও তাঁর সন্তানদের বরণ করে ভক্তিভরে প্রণাম করেন তখন মহিষাসুরকেও একটু প্রণাম ঠুকে দেন। আমি ছোটবেলায় এই দৃশ্য দেখে মা কে একবার প্রশ্ন করেছিলাম, “মা, অসুরও কি তবে ঠাকুর?”। মা তখন একটু বিব্রত হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, “না, অসুর ঠিক ঠাকুর নন, তবে ঠাকুরের সাথে আছেন, তাই ঠাকুরেরই মতন”।
বড় হয়ে জেনেছিলাম পুজোর সময় পুরুতমশাই দুর্গাপ্রতিমার যেভাবে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন, একে একে গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক এবং মহিষাসুরেরও সেইভাবে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। দেবদেবীদের সাথে তাদের বাহনদের, অর্থাৎ সিংহ, ইঁদুর, প্যাঁচা, হাঁস, ময়ূর, মায় দেবীর নাগপাশেরও প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয় শারদীয়া এই পুজোর আরম্ভে। দুর্গাপুজোর পদ্ধতির যে বিধান আমাদের শাস্ত্রকাররা লিখে রেখে গিয়েছেন বিভিন্ন পুরাণে ও পুথিতে, তার মধ্যে মহাদেবীর সঙ্গে গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্ত্তিক, নবপত্রিকা, দেবীর সখী জয়া – বিজয়া, মহিষাসুর এবং সিংহ ইত্যাদিরও ধ্যান এবং পুজোর ব্যবস্থার কথা বলা আছে। দেবতাদের কৃপা পেতে হলে যে তাদের বাহনদেরও সন্তুষ্ট করা দরকার, সেই কথাটা এই ঘোর কলিযুগে বসে বুঝতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু মহিষাসুরকে পুজো করার ব্যাপারটা আমাকে আবার নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছিল। পরাজিত শত্রু পক্ষের অপমান আর অনাদর দেখেই তো আমরা অভ্যস্ত। আরও চিন্তায় পড়ে গেলাম যখন আবিষ্কার করলাম কালিকাপুরাণ মতে মহিষাসুর শিবাংশে জাত এবং দেবীভগবতে বা দেবীপুরাণে শিবরূপেই অসুরের ধ্যান করা হয় –
“মহিষত্বং মহাবীর বিশ্বরূপ সদাশিব ।
অতত্ত্বং পূজয়িষ্যামি ক্ষমস্ব মহিষাসুর ॥”
মহিষাসুর বধের কাহিনী সব পুরাণেই প্রায় একরকম। তবে মহিষাসুর বধের পূর্বে বার বার মদ্যপান করতে বাধ্য হয়েছিলেন দেবী। মার্কণ্ডেয় পুরাণ আমাদের জানায়, মহিষাসুরকে বধের পূর্বে দুর্গা কুবেরের উপহার দেওয়া সদাপূর্ণ পানপাত্র থেকে বার বার মদ্যপান করেছিলেন! সেই মদের প্রভাবে তাঁর চোখদুটি রক্তবর্ণ ধারণ করে সত্বর! মদের প্রভাবে অট্টহাস্য করেন দেবী, মহিষাসুরকে বলেন- “রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধু পান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন কর! আমি তোকে বধ করলে ইন্দ্রাদি দেবগণ শীঘ্রই এই স্থানে আনন্দধ্বনি করবেন! সত্যি বলতে কী, এই তথ্যটি বেশ বিস্ময়কর! কেন না, মহিষাসুরের পূর্বে দেবী তাঁর অনেক সেনাকে বধ করেছিলেন, কিন্তু কখনই তাঁর মদ্যপানের প্রয়োজন পড়েনি! তা হলে মহিষাসুর বধের ক্ষেত্রেই বিশেষ করে এর প্রয়োজন হল কেন?
নাগোজি ভট্টের মতো পুরাতনী দার্শনিক তাঁর শ্রীশ্রীচণ্ডী-র ভাষ্যে এর একটি কারণ দর্শিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি ফিরে গিয়েছেন কালিকা পুরাণে, যেখানে মহিষাসুর শিবাংশে জাত বলে বর্ণিত হয়েছে। ভট্ট বলেছেন, মহিষের শিবাবতারত্বের জন্যই দেবী সর্ব প্রকার দয়া তাঁকে বধের পূর্বে নিজের মন থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন; সেই জন্যই বার বার মদ্যপান করে লুপ্ত করে দিয়েছিলেন নিজের কোমল চেতনা!
যদিও শ্রীশ্রীচণ্ডী-র গুপ্তবতী টীকা এই মত সমর্থন না করে নিজেদের মতো অন্য যুক্তি তুলে ধরেছে। জানিয়েছে, মহিষাসুর বধের পূর্বে চণ্ডিকা দেবী তূরীয়া হয়েও সংহারমূর্তি ধরেছিলেন; কিন্তু পরে তাঁর মধ্যে রজোগুণের আধিক্য হয়! সেই রজোগুণের বশেই তিনি অষ্টাদশভুজা মহালক্ষ্মী মূর্তি ধারণ করেন, মদ্যপানের দ্বারাই এই মহালক্ষ্মী মূর্তি সূচিত হয়!
এরপরে স্বাভাবিক ভাবে মনে আরও একটি প্রশ্ন আসে মহিষমর্দিনীর সঙ্গে একাসনে পরাজিত মহিষাসুর কেন পূজিত হন? দেবীপুরাণ অনুসারে মহিষাসুর তপস্যায় দেবী দুর্গাকে সন্তুষ্ট করে যজ্ঞভাগ প্রার্থনা করেন। দেবী যজ্ঞভাগের পরিবর্তে তাকে সাযুজ্য দেন যে চিরকাল দেবীর সঙ্গে তার পদতলে মহিষাসুরের পুজো হবে। কবি লেখেন, –
“রাত্রিকালে মহিষাসুর দেখে স্বপ্নমাঝে–
ভদ্রকালী মূর্তি ধরি চন্ডী বিরাজে।
পরাক্রমী মহিষাসুর চরণে তাঁহার
রাখিছেন ভক্তিভরে অর্ঘ্য উপহার।
যুদ্ধকালে মহিষাসুর সংগ্রামের শেষে
আপনারে সমর্পিয়া দেবী পাদদেশে,
ভক্তি গদগদস্বরে কহিল বচন,
“কৃপা কর জগন্মাতা, লভিনু শরণ ।
তবে হস্তে প্রাণ দিব ক্ষোভ নাহি তাতে
দেহ বর, হই যেন বিদিত জগতে ।”
“তথাস্তু ” কহিয়া দেবী দিল অতঃপর
পরাজিত দানবেরে মৃত্যুহীন বর —
“মোর পদলগ্ন হয়ে জগৎসংসারে
পূজিত হইবে নিত্য বৎসরে বৎসরে ।”
পুরাণে বর্ণিত আছে মহিষাসুর জন্মগ্রহণ করেন তিনবার। ত্রিবিধ রূপ ধারণ করে তাঁকে তিনবারই বিনাশ করেন এই দেবী। মহিষাসুরকে বধ করার জন্য প্রথমে অষ্টাদশভুজা উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয়বার ভদ্রকালী এবং তৃতীয়বার বধ করলেন দশভুজা দেবী দুর্গা রূপে। দুর্গাই হলেন পরমা প্রকৃতি। শিবপত্নী দেবী বিশ্বের আদি কারণ।
রাত্রিকালে স্বপ্নে ভদ্রকালী মূর্তি দেখলেন মহিষাসুর। শুরু করলেন তাঁর আরাধনা। আরাধনায় প্রীত ও প্রসন্ন দেবী এলেন। নিবেদিত হৃদয়মন মহিষাসুর জানালেন, ‘আপনার হাতে মৃত্যুর জন্য কোনও দুঃখ বা ক্ষোভ নেই এতটুকুও। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমিও যাতে সকলের পূজিত হই তারই ব্যবস্থা করুন দেবী। এছাড়া আর কিছুই চাই না আমি।’ দেবী ভদ্রকালী তখন আশীর্বাদ করে বললেন, ‘উগ্রচণ্ডা, ভদ্রকালী আর দুর্গা, এই তিন মূর্তিতে আমার পদলগ্ন হয়ে তুমি সব সময়েই পূজ্য হবে দেবতা, মানুষ ও রাক্ষসদের।’
সত্যযুগে রাজা সুরথ ও সমাধি নামক বৈশ্য তিন বছর বসন্তকালে গৌণ চান্দ্র চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে প্রথম পূজার্চনা করেছিলেন দুর্গামূর্তি প্রস্তুত করে। ত্রেতাযুগে লঙ্কেশ্বর রাবণ দেবী দুর্গার পুজো করতেন চৈত্র মাসে বসন্তকালে। সেই জন্যে এই পুজো বাসন্তীপুজো নামে সুখ্যাত। রাবণ বধের জন্যেও দেবীর পুজো করেছিলেন শ্রীরামচন্দ্র অকালে বোধন করে। এসব কথা দেবীভাগবত, মার্কণ্ডেয় চণ্ডী ও কালিকা পুরাণের। ‘কুরুক্ষেত্রে ভদ্রকালী ব্রজে কাত্যায়নী পরা’, দেবী ভদ্রকালী এইভাবে উল্লিখিত হয়েছেন আদ্যাস্তোত্রে। দ্বাপরের কথা। মহাভারতীয় যুগ। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে নিয়ে কুরুক্ষেত্রে (হরিয়ানা রাজ্য) প্রথমে স্থানেশ্বর মহাদেব হয়ে পরে আসেন দেবী ভদ্রকালীর কাছে। পুজো ও যজ্ঞ করেন। দেবীর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়লাভের।
অথচ দেবী দুর্গার মুখ দেখেন না ‘মহিষাসুরের বংশধররা’:
শারদ উৎসবে বিশ্বব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে পূজিত হন দেবী দুর্গা। কিন্তু বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর দেশ ভারতেই এমন কিছু মানুষ আছে, দেবী দুর্গার মুখ দেখা যাদের কাছে পাপ! তাই দুর্গা পূজার কয়েক দিন প্রাণপণে তাঁরা চেষ্টা করেন যাতে দেবীর মূর্তি দেখতে না হয়। কারণ তাঁরা নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর বলে মনে করেন।
ঝাড়খন্ড এবং উত্তরাখন্ডের সীমান্তের আলিপুরদুয়ারা জেলার মাঝেরডাবরি এলাকার একটি গ্রাম অসুরা কিংবা ‘অসুর গ্রাম’। ‘তফশিলী উপজাতি’র অন্তর্গত আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রায় আট হাজার মানুষের বাস এখানে। পরম্পরা অনুযায়ী নিজেদের মহিষাসুরের বংশধর দাবি করেন তাঁরা। এই সম্প্রদায়ের পদবীও ‘অসুর’। বহুকাল ধরে বংশপরম্পরায় আদিবাসী এই জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, তাঁরা মহিষাসুরের বংশধর।
পঞ্চমী থেকেই অন্ধকার নামে আলিপুরদুয়ারের মাঝেরডাবরি চা-বাগানে। সেখানে শরৎ এলেই তাদের হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চলতা কেমন যেন মিইয়ে যায়। কাশফুলের দোলায় মনখারাপের দিন শুরু হয় তাদের। ঢাকের বোলে আগমনীর সুর উঠলেই কানে হাত চাপা দেয় তারা, “আমাদের পূর্বপুরুষকে হত্যা করেছে গো! দুর্গাপুজো আমরা মানি না।” কেউ কেউ আবার একটু আধুনিক। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবের মরসুমে দুর্গাপুজোর নামে কুৎসা রটালে যদি বাবুরা রাগ করেন, তাই একটু সামলে নিয়ে তারা বলে, “পুজোর চারদিন আমরা ঘরে বসে শোকপালন করি। এটাই প্রাচীন রীতি। বাপ-দাদারাও করতেন। আমরা যে অসুর গো!”
ওদিকে পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামে দশমীতে উমার বিসর্জনের পরেই ধামসা, মাদল, সারিন্দা, করতাল, আড় বাঁশি বেজে ওঠে। মহিষাসুর স্মরণ উৎসব ‘দাঁশাই’ পরবে মাতে আউশগ্রামের শুখাগাঙা এলাকার সাঁওতাল নারী-পুরুষরা। এরাও অসুর জনজাতি। দুর্গাপুজো এখানেও ব্রাত্য। বিজয়াতে একই ছবি দেখা যায় পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে। খেড়ওয়াল জনজাতি সেখানে নিজেদের অসুর বলে ভেবে আসছে শতাব্দী ধরে। নারী উমা নয়, তাদের কাছে দুর্গা হলেন পুরুষ। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এই জাতির লোকেরা তাদের আদর্শ মহিষাসুরকেই ‘হুদুড় দুর্গা’ বলে ডাকে।
শুধু মহিষাসুর বধ নয়, পুজোর পরে ঝাড়খণ্ডের বিষণপুরের অসুররা দশেরায় রাবন বধও মেনে নিতে পারেন না। রামলীলা উৎসবে গিয়ে রাবণের মূর্তি জ্বালানোর বিরোধিতা করেছিলেন তারা। মহিষাসুর এবং রাবণই তাঁদের আত্মার আত্মীয়। আরাধ্য দেবতা। দুর্গাপুজোকে তারা কার্যত ‘গণ-বয়কট’ করেছে।
এছাড়া খোদ কলকাতার বুকে গড়িয়া এলাকায় দুর্গোৎসবের সময় মহিষাসুর স্মরণে গত কয়েক বছর ধরে অনুষ্ঠান করছেন স্থানীয়দের একাংশ। লক্ষ্মীপুজোর দু’দিন আগে, গড়িয়া এলাকার একটি প্রেক্ষাগৃহ সংলগ্ন মাঠে হয় সেই অনুষ্ঠান। স্থানীয় সদস্যদের দাবি, মহিষাসুর কোনও অশুভ শক্তির প্রতীক নন। তিনি শহিদ। আর্য সভ্যতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন হুদুড়দুর্গা নামে ওই অনার্য বীর। অসুর সম্প্রদায়ের ওই রাজার প্রকৃত নাম নাম ছিল মহীয়স অসুর। সংস্থার সদস্যরা বলেন, ‘‘প্রাচীন ভারতের খেরওয়াল কাহিনিতে আমরা একজন মহিয়স অসুর বা মহিষাসুর হুদুড় দুর্গার কথা পাই। ওই অসুর রাজাকে দেবতাদের সমর্থনেপুষ্ট এক নারী হত্যা করেন। হুদুড় দুর্গাকে হত্যা করায় তাঁর নাম হয় দুর্গা। তাই এই দুর্গাপুজো অনার্য সভ্যতার পক্ষে শোকের দিন।
সূত্র: ইন্টারনেট।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।