• Uncategorized
  • 0

সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে জয়িতা ভট্টাচার্য (পর্ব – ৬)

অন্তর্ধান – ১০

আজ কোয়ার্টার এর ঘরগুলো অনাবশ্যক গোছায় দেবলীনা।ফুলদানিতে ফুল।বিছানায় অন্য চাদর। কোনো কারন নেই অথবা আছে। রান্নাঘর থেকে ইলিশের গন্ধ আসছে।
আজ রজত আসবে!সে তো আসেই।কাজে কর্মে। তবু এটা অন্যরকম আসা। দুপুরে খাবে। পুলিশ যন্ত্র নয়।তাদেরও স্বাভাবিক জীবন ,অবসর থাকে হয়ত তেমনই ডাকসাইটে পুলিস অফিসার কখনো সনাতন নারী।
রজত কিছু কাজ সেরে আসবে দেরিতে।
কোয়ার্টারের পেছনে সব্জি বাগান। দুটি পেয়ারা গাছ।আজ মন- মহুয়ায় মেতেছে একটি দেশজ মেয়ে।হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাগানে।নরম ঘাসে অনাবৃত পায়ের পাতা।পায়ে নুপুর। এক অন্য নারী যেন।রজত মুগ্ধ হয়ে সঙ্গী হয়েছে তার।
গান শোনাও,
এক গোছা কাচের চুড়ি রিনরিনিয়ে ওঠে হাসিতে।
-দাঁড়াও
কোমরে একটু উঁচু করে গাছ কোমর বাঁধে,লাল পাড় শাড়ি টা।একটা মোটা ঝকঝকে রুপোর নূপূর খুলে নেয় পা থেকে।রজতের হাতে ধরিয়ে দেয়।
এলোচুল চূড়ো করে বাঁধে।রজত অন্ধ হয়ে যায় , মেরুন ব্লাউজ অনাবৃত বাহু, চকচকে মসৃণ,বাহুসন্ধিতে স্বেদ…
দেবলীনা আজ অন্য এক দেবলীনা হয়ে,
নূপূরটা বিশেষ ছন্দে বাজায়
অদ্ভুত সুরেলা কন্ঠে গান শুরু হয়
“তোকে রে জনমবেন দন দো
তোকে রে জনমদেন দন দো
হি হি রি দন দ
পি পি রি দন দ
উখারা রে জনমলেন দন দ
হি হি রি দন দ…”
নূপুরের ছন্দে আন্দোলিত কোমর,
নাভি ,রজতের হাত ধরে টেনে নেয় নাচের ছন্দে।
দেবলীনা হাসছে, রোদ্দুর ফালি ফালি হয়ে গাছের ফাঁকে পাতার ফাঁক গলে আলোকিত করছে দেবলীনার ছিপছিপে পালিশ করা দেহ।
কফি খেতে খেতে রজত জিজ্ঞেস করে কী গান গাইলে মানেটা বলে দাও।
যদিও সে শালপাতার বিড়ি খায় কখনো এখন একটা গোল্ড ফ্লিক নেভিকাট,হালকা ধোঁয়া বাতাসে উড়িয়ে দেবলীনা বুঝিয়ে দেয়,
আমাদের ভাষায় “সিরিং” মানে গান
এটা দন সিরিং অর্থাৎ বিয়ের গান,
গানটার মানে হলো এই রূপকথার দেশ আমার জন্মভূমি, আমাদের সেই রূপকথার দেশে প্রথম বিয়ে হয়েছে।
হি হি রি মানে রূপকথা
বুঝলে রজতবাবু!
দুপুরের খাওয়াটা যুতসই হলো যদিও দুজনেই মেপে খায়।
“ইলিশ পাতুরিটা অসাধারণ হয়েছে, ভাপাও “রজত খেতে ভালোবাসে।
টকদই এর রায়তা দিয়ে খাওয়া শেষ।
সূর্য হেলছে।বাগানে দীর্ঘ ছায়ায় কাঠবিড়াল আর ঘুঘুপাখির দৌড়ঝাঁপ।
ওরা পাশাপাশি।এসি চলছে।আবছা আলোয় অবদমনের আর আমন্ত্রণের খেলা চলছে সিলিংএ আলো ছায়ার নাচনে।
হাতে হাত।
রজত তুমি নিজের কথা তো কখনো বলোনি।
আমার কোনো কথা নেই তেমন লীনা।
অনাথ আশ্রমের ফাদারের কাছ থেকে নিয়ে আসেন আমার মা বাবা।বাবা মিলিটারিতে ডাক্তার ছিলেন।মা অঙ্কের টিচার। থাকতাম কলকাতার নন্দকুমার স্ট্রিটে তা জানো তো।
পনেরো বছরে মা মারা গেলেন।বাবার কাছে শুনেছি মায়ের প্রথম সন্তান মারা যায় তিন বছর বয়সে।বাবা মারা যান দুবছর আগে।আমার রেজাল্ট বেরিয়েছিল তার আগের দিন।
বাবার স্ট্রোক। মা আমাকে ওই তিন বছর বয়সটাতেই দত্তক নেন।
হাতটা নাভি ছোঁয়।উন্মুক্ত পেটে হাতটা ঘুরছে।
রজত ক্রমে পুরুষ হয়ে ওঠার এক অদম্য ইচ্ছে দমন করছে।
তোমার ভাই তো এবডাক্টেড হয়েছিল। মুক্তিপণ দিতে গিয়ে ঝোপের ধারে তার লাশ পাওয়া যায়। বেশ কয়েক বছর তোমার এই মা মানসিক রোগী ছিলেন।
রজত স্তব্ধ। নিমেষে এক কঠিন বাস্তবে মাটিতে আছড়ে পড়ে।
–“অবাক হয়োনা না রজত ,আমার সঙ্গে কে কে কাজ করবে তাদের সম্পর্কে জানাটা জরুরি ছিলো,
হোমওয়ার্ক ”
দুটি হাত ধরে আছে রজতের মুখ,রজতের চোখ আর্দ্র।
একটা নরম ঠোঁট ছোঁয়। ক্রমশ গাঢ় হয় চুম্বন।
বাইরে আওয়াজ হয়।
স্যর আনোয়ার আয়া।
বৈঠনেকো বোলো।কাহিনীটি অসমাপ্ত থাকে।দেবলীনা শাড়িটা গুছিয়ে নেয়।
বাইরে রোদ পড়ে এসেছে।
আকাশে অনেক রং রজত আর দেবলীনা স্টাডিতে বসে আনোয়ারের
মুখোমুখি।
এখন সন্ধ্যা শেষের রাত। আকাশ থেকে ফ্যালফ্যাল করে দেখছে চাঁদা ত্রিভুজ গ্রিলের ফাঁক গলে।
লাল মোটা ডায়রিটা খুলে আধশোয়া বিছানায় দেবলীনা ।
অনেকগুলো পাতা ফাঁকা। কিছু মানুষের নাম, কয়েকটা পাড়া, কয়েকটা তারিখ লাল কালিতে ঢ্যাঁড়া পাকানো।
অনেক রক্ত আর লাশের মধ্যে যখন ফরেন্সিকের লোকেরা ছবি আর ছাপ তুলতে ব্যস্ত,আলমারির নীচে আধখোলা ছেতড়ে পড়ে থাকা ডায়রিটা সবার অগোচরে তুলে নিয়েছিলো সে।মোহিনী চক্রবর্তীর পুত্র বধূ মনিকার ডায়রি।
… দু লাইন চারলাইন কখনো তিন চার পাতা একদিনেই…..
বিছানায় আরাম করে বসে পাতা ওল্টাতে থাকে।মেয়েটির গন্ধ লেগে আছে যেন এখনো জীবনের উত্তাপ।
……অয়ন আজ আসেনি।ফোন বন্ধ। কোথায় যায়।
দেখা হলে তবু পাগল করে দেয়। আমিও ভেসে যাই।
ও কি বোঝে না আমাকে।
আমাদের ভালোবাসা ……..
শেষ কোথায়
ছোটো থেকে রাজনীতির পরিপক্ক মুখোশপরা মুখ আর ষরযন্ত্রে বড়ো হতে হতে কী করে যেন কবিতাকে ভালোবেসে ফেললাম।
আর কবিতার হাত ধরে অয়ন।বাড়িতে ভালো লাগে না।একা একা নদী দেখি।আকাশ।
অয়ন এসে বসেছে পাশে।
বাবা জানলে খতম করে দেবে আমাকে আর অয়নকেও।
আজ দোল উৎসব। দোলপূর্ণিমার ভোজ মদের ফোয়ারা বাড়িতে।
আমি পালিয়ে গেছিলাম।দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।
ভক্তপাড়ার আগের চাঁদ ধোয়া বকুলগাছের নীচে…….
অয়ন এসেছিলো…..
আমি কী ভুল করলাম! এতো স্রোতে কখনো ভেসে যাইনি, আমার শরীর জ্যোত্স্না মেলেছে আজ।
আমি কি পাপ করলাম
(ফাঁকা ফাঁকা পাতা)
পর পর ফাঁকা পাতা উল্টে যায় কিন্তু পুরো ফাঁকা নয়।হাল্কা ছাপ।
লেখার? ছবি?
সত্যি কি ফাঁকা
একটা করে গোলাপের শুকনো পাপড়ি ,কাগজে লালচে ছাপ
অয়ন কোথায়।আমার খুব ভয় করছে।
দুমাস বন্ধ
সেই রাতের পর আরো দুবার উন্মত্ত অয়ন।
তারপর নেই।
………………..
কাকে বলব। বৌমণি?
বাবা বিয়ের ঠিক করছে
আমি অয়নকে ছাড়া কাকে স্পর্শ করতে পারি।
বাবার দলের মধ্যে কিছু নিয়ে তুমুল অশান্তি।
একটা অচেনা নতুন লোক এসেছে নাকি বাবাকে টপকে।
পার্টির বড়ো সড়ো কেউ এলে,ভিড় আর ঘরোয়া রাতের আসর।
আমি ঘর থেকে বেরোই না আজকাল।
বাবার সঙ্গে বোধহয় অনেক কিছু সমঝোতা হলো আজ।
খাবার টেবিলে বাবা অনেকদিন পর কথা বললেন
“খুকু তোর ছেলে দেখেছি” সামনের মাসেই……
অয়ন তুমি কোথায়

পাতার পর পাতা খালি। শুধু তারিখ।
………..

রজত ঘরে ঢুকে অভিভূত হয়।
এক নারী।
পূর্ণ প্রস্ফুটিত নারী,আধশোয়া, পড়ছে লাল একটা খাতা,
তার চাঁপা রঙের শাড়ির আঁচল সরে গেছে দুটি কৃষ্ণবর্ণা সুডৌল স্তনের আভাস দিয়ে,
পা থেকে সরে গেছে সায়া আর শাড়ির পাড়,নিটোল দুটি পা,
খোলা চুল কপালে এসে পড়েছে তাকে আড়াল করে…….
কত মুহূর্ত কেটে যায়,রজত এই দৃশ্যে মরে যায়।
আচমকাই মুখ ফেরায় দীঘল চোখ।চোখ দুটি আনমনা, দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নেয়।
কখন এসেছ।
হুম?
কখন এসেছো ?এগিয়ে আসে দেবলীনা।
এই তো। রজত স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে।
জানো আমরা এবার অনেক জট খুলতে পারব।
রজত ফিরতে চায় সমুদ্র থেকে।
সন্ধ্যায় আনোয়ার আসবে এখানে। অনেক খবর পাওয়া গেছে তার কাছেও।
ডায়রির কথাটা চেপে যায় দেবলীনা।
আজ আর কাজের কথা নয়।
কিসের কথা তবে?
তোমার কথা শুনব
তোমার কথাও
মুখটা মেঘে ঢেকে যায় সামান্য
আমার কথা তো নেই কিছু।
আছে লীনা।
তোমার জীবন নিয়ে একটা উপন্যাস হতে পারে।তোমাকে স্যালুট।
ধ্যাত
চলো আজ তোমাকে আমার দেশের গান শোনাই।
—“অয়ন নামটা শুনেছ কখনো রজত?।শিবুকে একবার কল করো।
অভিজিৎ দাশ ওরফে অয়ন
সি আইডি র খাতায় মোস্ট ওয়ান্টেট 2018 থাকে আর তারপর …
বিশেষ বেল এ মাত্র কিছুদিন মুক্ত।
কেন? কার সুপারিশে।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।