।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় জয়ন্ত দত্ত

ভাইফোঁটা

পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন,এই একটি দিনের জন্য আমাকে বাড়ি ফিরতেই হয়।আমার ছোট বোন।বাড়ির সকলের ভীষণ প্রিয়।সারা বাড়ি মাথায় করে রাখে।দীপাবলির সময় চারিদিকে ঘর -বাড়ি -রাস্তা সব আলোয় সেজে ওঠে।আর আমার ও বাড়ির জন্য মন কেমন করে ওঠে।আমি যেই মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে কাজ করি,সেখানে সারা বছরই বাইরে থাকতে হয়।ছুটিও ভীষণ কম।তবু কালী পুজোর পরে দিনকয়েকর জন্য আমার বাড়ি আসা চাই-ই।
বহুবছর আগের কথা।ক্লাস সিক্স পর্যন্ত একাই ছিলাম।স্কুলের বন্ধুদের সকলের দেখতাম, একটি করে ভাই বা বোন!বাড়ি ফিরে প্রায়শই মা-কে অভিযোগ করতাম।মা মৃদু হেসে পাশ কেটে এড়িয়ে যেত।অবশেষে একদিন ঘর আলো করে পরী এলো।বোন নয় তো!যেন পাকা বুড়ি!ছোট ডল পুতুলের মত দেখতে ছিল।সারাদিন কথা বলে আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াতো–‘দাদা এটা করবে না,দাদা ওটা কি?’সাথে হাজার প্রশ্ন!বাড়িতে আমরা তিনজন —বাবা,মা ও আমি ওর সব আব্দার বিনা বাধায় মেনে নিতাম।কি এক অসীম আনন্দে সেসব দিনগুলো পার হয়েছে।মনে পড়লেই খুশিতে বুক ভরে ওঠে।
চাকরি সূত্রে আমি যেদিন মুম্বই পাড়ি দিই,কি কান্না ওর!খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে শুধু কান্না। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম।তারপর থেকে ছুটি পেলেই বাড়ি আসার চেষ্টা করি।কিছুদিন বেশ হইহই করে কেটে যায়।তারপর আবার কাজে ফেরা।
বহুদিন পর দিওয়ালীর ছুটিতে বাড়ি ফিরছি।খুব আনন্দ হচ্ছে।বাড়ির কথাই ভেবে চলেছি।মা,ছোটন ওরা কি করছে!অটোওয়ালা বাড়ির সামনে এসে হর্ন দিতেই ছোটন জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে।তারপর –‘দাদা’ বলে একলাফে নিচে নেমে আসে।মা-ও গেট খুলে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে।লটবহর নিয়ে ঘরে ঢুকতেই মা চলে যায় রান্নাঘরে চা করতে।ছোটন অনেক কথা বলে যায় —কেমন আছি,খাওয়া -দাওয়া ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা,দাড়ি কাটিনি কেন!…ইত্যাদি ইত্যাদি।
ও কথা বলছে,কিন্তু নজর ওর আমার ব্যাগের দিকে।ও নিশ্চিত যে,ওর দাদা কিছু না কিছু গিফট এনেছেই!
অধৈর্য্য হয়ে একসময় বলেই ফেলে –‘বলো না দাদা আমার জন্য কি এনেছো!’
—-‘ভুলে গেছি রে!’জিভ বের করে হাসতে হাসতে বলি।
—-‘ইয়ার্কি করো না!’ও রাগতস্বরে বলে ওঠে।
—-‘চোখ বন্ধ কর।’এই বলে আমি ওর হাতে একটা আইফোন ধরিয়ে দিই।চোখ খুলতেই ও লাফিয়ে উঠে।গলা জড়িয়ে ধরে বলে ,’দাদা তুমি ভীষণ ভালো।’
সারারাত বাবা-মা-বোন তিনজনের সাথে অনেক গল্পগুজব হলো।কত কথা যে জমেছিল সকলের পেটে।ডিনার সারতে অনেক রাত হয়ে যায়।
সকালবেলা যথারীতি অনেক দেরি করে ঘুম ভাঙল।ঘুম ভাঙতেই চোখ খুলে দেখি,ছোটন ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে পাশে বসে।একমনে পেপার পড়ছে।আমি তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে আসি।এসময় খালি পেটে আমাকে দুটো ওষুধ খেতে হয়।গতকাল ব্যাগ থেকে ওষুধের কৌটো বের করে বিছানার সামনে সেন্টার টেবিলে রেখেছিলাম।অথচ কৌটোটা কিছুতেই খুঁজে পেলাম না।ছোটন আড়চোখে দেখছিল সব।হঠাৎ দেখি ওর হাতে সেই কৌটো।ভেতরের ওষুধ গুলো আমার সামনে নামিয়ে রেখে বলে ওঠে ,’দাদা তুমি কবে থেকে প্রেসার সুগারের ওষুধ খাও!’
আমি অবাক চোখে চেয়ে থাকি।
—-‘আমি গুগল সার্চ করে সব ওষুধগুলোর ডিটেলস দেখেছি।’ছোটন বলে ওঠে।
ওর চোখে জল।আমার সামনে নতুন মোবাইলটা নামিয়ে রাখে।
—‘দাদা ,আমার মোবাইল লাগবে না।আমাদের জন্য তোমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়।’
ও ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে।
আমি বিস্ময়ে চেয়ে থাকি।পুচকি মেয়েটা কবে এতো বড় হয়ে গেল!ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠি –‘ধুর পাগলি!কিছু হয়নি আমার।তোরা থাকতে কি আর হবে আমার!!!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।