।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় জয়ন্তী মন্ডল

হঠাৎ দেখা

অমল, সুচরিতাদের বিদায় জানিয়ে মৃণাল যখন কলেজ স্ট্রীটের চৌমাথার মোড়ে এসে দাঁড়াল তখন সন্ধে ছুঁই ছুঁই। ক্লান্তিতে মৃণালের পা দূটো আর চলছে না। ড্রাইভার যে কোথায় গাড়িটা দাঁড় করিয়েছে। ফোনটাও ধরছে না।
সেই সকাল দশটা থেকে টই টই করে কলেজ ষ্ট্রীট চষে বেড়াচ্ছে চারজনে। মৃণালদের ফাইল পছন্দ হয় তো সুচরিতার পছন্দ হয় না। সুচরিতার পেন পছন্দ হয় তো অমলের হয় না।
বই এর ব্যাপারে ওরা সকলেই একমত। বক্তাদের হাতে একটা করে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির বই উপহার দেওয়া হবে।
কিন্তু কলেজস্ট্রীটের বড় বই এর দোকানে কয়েকটা বই মিললেও সব কটা বই পাওয়া গেল না। নানা দোকান ঘুরে বই গুলো পেল ওরা।
কলেজের আন্তর্জাতিক সেমিনারের এবার দায়িত্বে ওরা চারজন। তবে চারজনের ডিপার্টমেন্ট আলাদা আলাদা। সেমিনারের বিষয় ‘বাংলার শিশু সাহিত্য এবং গ্লোবালাইজেশনের যুগে বাংলার শিশু সমাজ’।
কলেজ স্ট্রীটের মোড়টায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মৃণালের চোখ চলে গেল রাস্তার ওপারে। দেখে একটা লোক দু হাতে কয়েকটা ঠোঙা নিয়ে হন হন করে রাস্তা পার হয়ে এদিকে আসছে।
মৃণালের মনে হল সিরাজুল না!
হ্যাঁ সিরাজুলই তো!
রাস্তাটা পার হয়ে সিরাজুল মৃণালকে এখানে হঠাত দেখতে পেয়ে বলে,
আরেব্বাস মৃণাল যে! কতদিন পর দেখা! কেমন আছিস?
ভালো। তোর কি খবর? সেই যে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে চলে গেলি আর খবর পেলাম না। হাতে এত বেগুনি, মুড়ি? কোথায় চলেছিস? অফিসের টিফিন বুঝি?
সিরাজুল একগাল হেসে বলে সে সব না। অফিস কখন ছুটি হয়ে গেছে। এটা আমাদের বিকেলের আড্ডার জল খাবার। বেগুনি আর মুড়ি। ওই দেখ গাছ তলায় সব বেগুনি মুড়ির জন্য কেমন অপেক্ষা করছে। চল একবার ঘুরে যাবি ওখান দিয়ে।
সিরাজুল মৃণাল ইউনিভার্সিটির বন্ধু। এত ভালো পড়াশোনায় ছিল সিরাজুল। হঠাত প্রেসে কাজ নিয়ে পড়াশোনা ছাড়ল। তারপর আর দেখা হয়নি দুজনের। সেও প্রায় বছর বারো হবে।
মৃণাল তাকিয়ে দেখে টেমার লেনের মুখে একটা বাঁধানো কদম গাছের গোড়ায় কতকগুলো ছেলে কাকে ঘিরে ধরে জটলা করছে। তার মধ্যে দু এক জন বয়স্ক মানুষও আছেন।
মৃণাল ভাবে কি বিপদে পড়লাম রে বাবা! একেই তো ব্যাগ পত্রের ভার। তার উপর সারাদিনের ক্লান্তি। এরপর এদের সঙ্গে গল্প। ওই তো ছেলে ছোকরার দল। কলেজ স্ট্রীটে বই এর দোকানে, প্রেসে সব কাজ করে। এদের সঙ্গে কি ই বা গল্প করব?
মৃণাল ঘড়ির দিকে তাকায়। বলে হাতে তেমন সময় নেই। আজ আসি। আর একদিন আলাপ করব তোর বন্ধুদের সঙ্গে।
চল চল বলে, সিরাজুল একপ্রকার জোর করেই ধরে নিয়ে গেল মৃণালকে।
কিছুটা গিয়েই একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিরাজুল কাকে একটা ঈশারা করতেই, একটা হাফ প্যান্ট পরা ছেলে এসে সিরাজুলের হাত থেকে মুড়ি আর বেগুনির ঠোঙা গুলো নিয়ে চলে গেল।
চায়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে সিরাজুল বলে দিদি সাতটা চা। এখন দুটো।
দুজনে দুটো চায়ের ভাঁড় নিয়ে মৃণাল বলে,
সিরাজুল কি করিস তুই এখন?
সিরাজুল খানিক অপ্রস্তুত হয়ে বলে ছোট একটা কাগজের অফিসে কাজ করি।
মৃণালের ঠাট বাট দেখে, মৃণাল কি করে সে সব কথায় আর না গিয়ে সিরাজুল বলে, তুই এখন কোথায় থাকিস মৃণাল?
মৃণাল বলে, আমি যে কলেজে পড়াই সেই কলেজের পাশেই একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি।
এমন সময় একটা হাফ প্যান্ট পরা ছেলেটা এসে বলে, সিরাজুলদা। দাদা তোমায় ডাকছে।
সিরাজুল বলে, চল মৃণাল। ওঁরা আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।
দুজনে পৌঁছে দেখে ওদের বেগুনি মুড়ি তখন প্রায় শেষ। কদম গাছের গোড়ার বাঁধানো সিমেন্টের উপর ওদের জন্য একটা ঠোঙা রাখা আছে।
ঠোঙ্গাটা দেখে মৃণাল আগে ভাগেই বলে দিল আমি কিন্তু মুড়ি খাব না।
তখন বাঁধানো সিমেন্টের উপর যাঁরা বসে ছিলেন, তাদের মধ্যে এক বৃদ্ধ বললেন, ওহে ছোকরা এখানে এসে যখন পড়েছ বেগুনি মুড়ি খাও। ভবিষ্যতে কখনো বেগুনি খাওয়ার সময় আমদের কথা মনে পড়বে।
মৃণাল মনে মনে ভাবে তোমরা কি কেউকেটা! যার জন্য তোমাদের কথা ভবিষ্যতে আমি স্মরণ করবো। যত্তসব ।
সিরাজুল বলে এসো মৃণাল আলাপ করিয়ে দিই, ইনি আমাদের রজনীকান্তদা।
মৃণাল কে দেখিয়ে বলে, রজনীকান্তদা মৃণাল আমার কলেজের বন্ধু।
মৃণাল হাত তুলে নমস্কার জানাল বৃদ্ধকে। উল্টোদিক থেকে বৃদ্ধটিও প্রতি নমস্কার জানালেন মৃণালকে। দু এক কথা বলতে বলতেই একটা ছোকরা একটা বড় ভাঁড়ে রসগোল্লা এনে বৃদ্ধের হাতে দিয়ে বলল, আপনার পুরষ্কারের খুশিতে মিষ্টি পাঠালেন সংসদের দেবজ্যোতি জ্যেঠু।
একটি ছেলে চোখ বড় বড় করে বলে, আরেব্বাস! মিষ্টি?
ছেলেটির কথা শেষ হবার আগেই উল্লাসে ফেটে পড়ল সকলে।
মৃণাল একটু বিরক্ত মুখে বলে, উনি কিসের পুরস্কার পেয়েছেন? যে শিশু সাহিত্য সংসদ থেকে ওনাকে রসগোল্লা খাওয়াচ্ছেন।
সিরাজুল বলে, একাডেমি পুরস্কার।
মানে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের?
সিরাজুল বলে হ্যাঁ।
মৃণাল বিস্ফারিত চোখে বলে, সাহিত্য একাডেমি? সে তো এ বছর শিশু সাহিত্যে রজনীকান্ত সমাদ্দার পেয়েছেন। মৃণাল খানিক হতচকিত হয়ে বলে ইনিই কি সেই রজনীকান্ত সমাদ্দার!
সিরাজুল বলে হ্যাঁ ইনিই আমাদের রজনীকান্ত দা।
মৃণাল একটু এগিয়ে যায় বৃদ্ধের কাছে।
আমার নাম মৃণাল কান্তি সেন। আপনার সঙ্গে আগেই আমার পরিচয় হয়েছে। মুঠোফোনে।
বৃদ্ধ চিন্তিত মুখে মনে করার চেষ্টা করেন। বলেন হ্যাঁ নামটা শোনা শোনা মনে হচ্ছে। কিন্তু এখনই মনে করতে পাচ্ছি না।
মৃণাল বলে, সেদিন বাঁকুড়ার রঘুনাথ মুর্মু কলেজ থেকে আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম।
বৃদ্ধ তখন একগাল হেসে বলেন, ঠিক বলেছ। সেদিন বাঁকুড়ার রঘুনাথ মুর্মু কলেজের প্রিন্সসিপ্যাল ফোন করেছিলেন বটে। কলেজের সেমিনার আছে। সেখানে শিশু সাহিত্য নিয়ে কিছু বলার জন্য।
তুমি তাঁকে চেনো নাকি হে?
মৃণাল একটু ইতস্তত করে বলে আমিই রঘুনাথ মুর্মু কলেজের প্রিন্সসিপ্যাল মৃণালকান্তি সেন।
বৃদ্ধ বলেন, বলো কি? তুমি ওই কলেজের প্রিন্সিপ্যাল?
কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার বলো তো! আমি নিজে কখনো কলেজে পড়িনি। আর কলেজের প্রিন্সিপ্যাল কিনা ফোন করে আমায় বলছেন কলেজে বক্তৃতা দিতে। সেই থেকে আমি ভয়েই মরছি!
মৃণাল খানিক হেসে বলে, কি যে বলেন আপনি। এসময়ের শিশু সাহিত্যে এখনো আপনি প্রথম সারিতে । শিশু দিবসের দিন রেডিওতে শিশু কিশোরদের উদ্দেশে চমৎকার কটি কথা বলেছিলেন আপনি। আপনার লেখাতেও সে সব কথাই বার বার উঠে এসেছে।
বৃদ্ধ খানিক চিন্তা করে বললেন, দেখো ভাই উপেন্দ্র কিশোর, অবন ঠাকুর, লীলা মজুমদার সব এঁদের হাতে বাংলার শিশু সাহিত্য সোনার কলমে লেখা। আর আমাদের হাতে আছে কেবল ডট পেন।
মৃণাল আর বেশি কথা বাড়ায় না। বাংলা নিয়ে পড়লেও শিশু সাহিত্য নিয়ে ওর তেমন পড়াশুনা নেই। যেটুকু ছিল চাকরি পাওয়ার আগে। এখন সে সব গুলে জল হয়ে গেছে।
মৃণাল খানিক এগিয়ে এসে বৃদ্ধের সঙ্গে করমর্দন করে বলে, সেমিনারে দেখা হচ্ছে। আজ আসি?
রজনীকান্ত বাবু একগাল হেসে বললেন, নিশ্চয়!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।