• Uncategorized
  • 0

T3 || আমি ও রবীন্দ্রনাথ || বিশেষ সংখ্যায় জয়ন্ত বিশ্বাস

বিভোর রাতে

কমলিনী মুখোপাধ্যায় আর শুভায়ু সেন মজুমদারের ‘দিনরজনী’ অ্যালবামটা মিউজিক সিস্টেমে চালিয়ে কাজ করছিলাম। “একসময় এত করে গান শিখতে বলেছি কানে নেয় নি। আজ আর তাহলে হাতকামড়াতে হতো না…” – তাকিয়ে দেখি চা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে মা। আসলে মামাবাড়িতে গানের পরিবেশে মায়ের বড়ো হওয়া। আমাদের বাড়িতে আসার পর মায়ের গানের চর্চায় বেশ খানিকটা ভাটা পড়েছে। এসব নিয়ে মা আরও কিছু বলতেন কিন্তু আমি থামানোর জন্যে বললাম চুপ করো। দেখ এবারের গানটা তোমার প্রিয়। আমার রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচয় মায়ের সূত্রেই। যে বয়সের স্মৃতি পরিষ্কার মনে রাখা সম্ভব নয় সে বয়সের একটা ছবি আজও আমার কাছে অম্লান। আমি একটা খেলনা গাড়ি নিয়ে হলঘরে ঘুরতাম। আর মা হারমোনিয়াম নিয়ে একলাইন গাইতো আর আমি ওই লাইনটা রিপিট করতাম – “আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাইনে তোমায় দেখতে আমি পাইনে”। আরেকটু বড়ো বয়সে এসে মনে হল আমি ভালো শ্রোতা কিন্তু মোটেও সুমধুর বক্তা নই। তাই আর গান শিখিনি কেবল মায়ের পাশে বসে শুনেছি আর ভালোবেসেছি।
অ্যালবামের শেষ গানটা হয়ে গিয়ে যখন ঘরটা একেবারে শব্দহীন তখন মা বলল, এই রোববার তোর বাবা, আমি আর তুই মিলে একটু বোলপুর যাব ঠিক করেছি। তোর কোনো কাজ নেই তো? আমি একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, হঠাৎ বোলপুর কেন?
– তুই এত ভুলোমনা! কিছুই কি মনে থাকে না? ওই মনা মাসি যে মেয়েটার ছবি দিয়ে গেল… আরে বাবা! তোকে দেখালাম যে…
– হ্যাঁ মনে পড়ছে..
– ও কে দেখতে যাব।
মেয়েটির ছবি দেখে আমার একটু বেশি রকমেরই ভালো লেগেছিল। কারন বিভিন্ন শেডের ঝকমকে ফিল্টারের যুগে পাত্রপক্ষকে ভিন্টেজ এসেন্সের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি বোধহয় আজ আর কেউ দেয় না। মেয়েটার সাথে আমার পছন্দের মিল আছে বলতে হয়। পুরোনো দিনের গন্ধ, আমেজ ভীষণ রকম ভালোবাসি আমি।
রোববার বিকেল নাগাদ আমরা তিনজনে বেরোলাম। পানাগড় থেকে গাড়িতে আমাদের মোটামুটি মিনিট পঞ্চাশেক মতো লাগবে। শেষ বিকেলের আলোয় যে বাড়িটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম তার নাম ‘মালঞ্চ’। প্রাথমিক আপ্যায়নের পর আমাদের বসানো হল ছাদে। শুধু ছাদ বললে তাচ্ছিল্য করা হয়। এ যেন প্রমোদ কানন। পুরো ছাদটা পদ্মরাগমনি রঙের টালি দিয়ে ছাওয়া। সেখান থেকে ঝুলছে পার্শিয়ান স্টাইলের লন্ঠন। ছাদের চতুর্দিকে রঙ্গন, করবী, বেলী, বৃন্দাবন চাপা আরও নানা নাম না জানা ফুলের গাছ। ছাদে ঢুকেই ডানদিকে একটা পিয়ানো। ছাদের শেষভাগের দিকে কৃত্রিম লতায় মোরা একটা দোলনা।দোলনার কাছে একটা কাঠের নক্সা করা টেবিলের উপর ধাতুনির্মিত রোটারি ডায়েলের টেলিফোন। আমরা ছাদের ঠিক মাঝখানে বেতের মোড়াতে বসে আছি। ধীরে ধীরে মা, কাকিমাদের সঙ্গে মেয়েটি এল। নাম দত্তপ্রিয়া। গোধূলির আভায় মেয়েটাকে ছবির থেকে অনেক বেশী মায়াময় লাগছে। মায়াবী তার দুটো অতল গভীর চোখ। ডানদিকের চোখের মাঝ বরাবর ঠোঁটের ঠিক উপরের ছোট্ট তিলটা সমস্ত মায়াকে কয়েকগুন বাড়িয়ে তুলেছে।
বড়দের কথাবার্তা এবার গান-বাজনা নিয়ে শুরু হল। দত্তপ্রিয়া বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে পোষ্ট গ্রাজুয়েট। আমার মা ভীষণ উচ্ছ্বসিত। আবার একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা বললেন, আমি আবার এদিক থেকে ব্যার্থ। ছেলে আমার শুধু পড়াশোনাই করে গেল। গানটা আর শেখাতে পারলাম না। গানের অনুরাগী হয়ে রয়ে গেল।
হাসাহাসির মধ্যে দত্তপ্রিয়ার মা বললেন, ভালোই তো। মেয়ের আমার পাকাপাকি এক গুনমুগ্ধ শ্রোতা জুটে গেল। সকলের অনুরোধে দত্তপ্রিয়া পিয়ানোর সামনে বসল। “রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহনার ধারে” গানটা শেষ হওয়ার পরেই আমাদের বিয়ের দিন ঠিক হল। আর দু’সপ্তাহ পরেই গানের জোয়ারে আর ওই গভীর চোখের মায়ায় ভাসতে চলেছে আমার জীবন তরী।
বিয়ের দিন আমরা পৌঁছনোর পর থেকে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই। মেরুন আর সাদার মধ্যে বাটিক প্রিন্টের কাপড় দিয়ে গেট সাজানো হয়েছে। তাতে জুঁইয়ের মালা। সঙ্গে রয়েছে অমলতাসের ঝুরি। সানাইয়ের বদলে কান আসছে সরোদ আর এস্রাজের যুগলবন্দী। ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম আমার হবু কাকাবাবু সস্ত্রীক সরোদ আর এস্রাজের তারে রবীন্দ্রনাথের সুর নিয়ে বসেছেন। ইমনকল্যাণ, ভৈরবী, শ্রী কখনও বা মিশ্রকাফিতে প্রাণবন্ত হয়ে উঠছেন রবিঠাকুর। বিস্ময়ান্বিত হয়ে আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শ্বশুরমশাই বললেন, “আমাদের পরিবারে আমরা দুজনকে ঠাকুর বলে জেনে এসেছি; এক আমাদের কূলগুরু রামঠাকুর আর এক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এনাদের ছেড়ে আমাদের শুভানুষ্ঠান চলেই না”। ‘মালঞ্চ’র সামনের ফাঁকা জায়াগাতে প্যান্ডেল হয়েছে। সেখানেও মার্জিত রুচির ছোঁয়া। যারা পরিবেশনের দায়িত্বে রয়েছেন সকলের গায়ে নীলাভ সবুজ পাঞ্জাবী আর বা’কাঁধে বাটিকের উত্তরীয়। বিমোহিত হয়ে বসলাম বিয়ের মন্ডপে। আমার চোখ আর মন চঞ্চল হয়ে উঠছে দত্তপ্রিয়াকে দেখার জন্য। সময় ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে আর আমার অপেক্ষা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হঠাৎ দত্তপ্রিয়ার এক দিদি এসে আমাকে সঙ্গে যেতে বলেন। ততক্ষণে যুগলবন্দী থেমে গিয়েছে। চারিদিকে অল্প-বিস্তর শোরগোল। মনের ভেতর কেমন একটা তোলপাড় শুরু হয়েছে আমার।
দত্তপ্রিয়ার ঘরের বাইরে ওর বাড়ির সকালের ভিড়। ভেতর থেকে আসছে গানের সুর। এই সুরের ব্যাঞ্জনা কানের মধ্যে দিয়ে সরাসরি মনকে আহত করছে। দত্তপ্রিয়া গাইছে, “আঁধার থাকুক দিকে দিকে আকাশ-অন্ধ-করা,তোমার পরশ থাকুক আমার-হৃদয়-ভরা।জীবনদোলায় দুলে দুলে আপনারে ছিলেম ভুলে,এখন জীবন মরণ দু দিক দিয়ে নেবে আমায় টানি”।
মেয়েটা কি কাঁদছে!? জড়বৎ এগিয়ে গেলাম ঘরের দরজার সামনে। দরজার সেজাসুজি সাদা উলের টেবিল কভারে ঢাকা টেবিলটার উপর গালভরা হাসি মুখের একটা ছেলের ছবি। লাল বেনারসী আর খোপায় কাঠগোলাপ গোজা মেয়েটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে গাইছে। হাতে একটা শুকিয়ে যাওয়া পুরনো স্বর্নচাঁপার মালা। সেই শুকনো মালটা বুকের মাঝে রেখে দত্তপ্রিয়া তখন গাইছে “চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে…”। দরজার বাইরে অদ্ভুত নিস্তবদ্ধতা। অন্যান্যদের কথা জানি না তবে আমার চোখে বর্ষা নেমেছিল নাকি চোখে কিছু একটা পড়েছিল বলতে পারব না। চোখ মুছে দেখলাম নিজের গলার রজনীগন্ধার সতেজ মালাটা ছবিতে পরিয়ে বিরহিনী গাইছে “তোমারি করিয়া নিয়ো গো আমারে বরণের মালা পরায়ে”।
নিস্তবদ্ধতা ভাঙলেন আমার মা। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করলেন। বুকে জরিয়ে ধরলেন দত্তপ্রিয়াকে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, শাশ্বত হোক তোমার রণন… অক্ষয় হোক তোমার মনন.. অক্ষয় হোক।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।