সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্তী (ইতিহাস কথা পর্ব ১)

শ্রীরামপুরের কথা

(১)
প্রথম দিন থেকেই অবাক চোখে দেখতাম শ্রীরামপুর শহরটাকে। হুগলী জেলার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে বড় অদ্ভুত এই শহর। বর্তমানে হুগলীর একটি মহকুমা এই শহরে আজও আনাচেকানাচে যেন ইউরোপীয়ান গন্ধ। ইংরেজ লেখকরা একসময় এই শহরকেই ‘কলকাতার চেয়েও বেশি ইউরোপীয়’ বলে অভিহিত করতেন। শ্রীরামপুর কলেজ থেকে আকাশচুম্বী সেন্ট ওলাভ গীর্জা, ডেনমার্ক ট্যাভার্ন থেকে হেনরী মার্টিন প্যাগোডা – আজও বিভিন্ন প্রাচীন সৌধ সাক্ষী দিয়ে যায় একসময়ের ইউরোপীয় ফ্রেডরিক্সনগরের (ড্যানিশ গর্ভমেন্ট প্রদত্ত শ্রীরামপুরের প্রাচীন নাম)। আবার মাহেশের জগন্নাথদেব, বল্লভপুরের রাধাবল্লভ জিউ এক সুপ্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যের কাহিনী শোনায় এই শহরের বুকেই। একসময়ের শ্রীপুর মোহনপুর ও গোপীনাথপুর কিভাবে আজকের ঝলমলে শ্রীরামপুরে পরিণত হল তার প্রতিটি স্তর ছুঁয়ে দেখবার সময় হাজির হতে হল বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যময় ইতিহাসের দোরগোড়ায়। কখনো শেওড়াফুলীর রাজার হাতে, কখনো স্থানীয় গোস্বামী জমিদারদের হাতে, আবার একটা দীর্ঘ সময় ডেনমার্ক থেকে আগত দিনেমার (ড্যানিশ) বণিকদের হাতে এবং শেষে ইংরেজ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা শাসিত হয়েছে শ্রীরামপুর নগরী। প্রতিটা অধ্যায় যেন বর্ণময়। প্রাচীন বঙ্গে গঙ্গারিডি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এই স্থান আজও তেমনই এক জীবন্ত জীবাশ্ম। একটা শহরকে খুঁজে দেখবার জন্য যেখানে যেখানে পৌঁছেছি, সেখানেই পেয়েছি একসময়ের অতি প্রাচীন বর্ধিষ্ণু জনপদের সাক্ষী। আবার কখনো গঙ্গার ধারে আজও দাঁড়িয়ে থাকা হেনরী মার্টিন প্যাগোডার ভগ্নাবশেষ চোখের সামনেই তুলে এনেছে রেভারেন্ড উইলিয়াম কেরীর নেতৃত্বাধীন বিখ্যাত শ্রীরামপুর মিশনারীর একের পর এক খ্রীস্টধর্মের সম্মেলনগুলো। যেখানে বহু বাঙালী যুবকও ব্রাহ্মণ্য গোঁড়া কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে বারবার। শোনা যায় একটা সময়ে কৃষ্ণপাল, গোকুল, কৃষ্ণপ্রসাদের মতো বাঙালী যুবকদের খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হবার শুরু এই নগরীতেই। যে নীল চাষ সারা ভারতে ইংরেজ কোম্পানির একসময়ের প্রধান ব্যবসায় পর্যবসিত হয়, তার শুরুও এই শ্রীরামপুরেই, দিনেমার ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে। কী? অবাক লাগছে? ভাবছেন আজকের ছোট্ট শহর শ্রীরামপুর আর কত ইতিহাস ধরে রেখেছে তার বুকে? ধীরে ধীরে শোনাব সব কাহিনী। গঙ্গা তীরবর্তী এই নগরী সত্যিই এক রূপকথা। আজও বিভিন্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্থাপত্য, সৌধের অন্তরালে লুকিয়ে রয়েছে ইউরোপীয়ান শ্রীরামপুর। রেভারেন্ড ডঃ ইউলিয়ম কেরী, জোশুয়া মার্শম্যানের মত বাগ্মী মিশনারী সাহেবরা আজও শুয়ে রয়েছেন এই শহরের বুকেই। তাদের বুকের কাছে কান পেতে আমরাও শুনতে পাই বেঙ্গল রেনেসাঁসের এক বর্ণময় অধ্যায়ের কথা। শ্রীরামপুর শহরের নাম শুনলেই প্রথম মাথায় আসে বাংলা হরফ ও ছাপাখানায় প্রথম বাংলা বই ছাপার কথা। কেরী সাহেবের মুন্সী বলে খ্যাত রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ শুধুমাত্র লর্ড ওয়েলেসলীর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজেই সেযুগে রমরম করে পড়ানো হত তা নয়, বাংলা সাহিত্যের প্রথম গদ্য ছাপা বই হিসাবে এটি ইতিহাসে পাকাপাকি স্থান করে নিয়েছে। পরবর্তীকালে এই ছাপাখানা থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল উইলিয়াম কেরীর বিখ্যাত বই ‘কথোপকথন’, মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের ‘বত্রিশ সিংহাসন’, ‘রাজাবলি’র মতো অসংখ্য বই। আর এইসবের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে শ্রীরামপুর নগরীর অক্ষয় নাম। আজও গঙ্গার তীরে উইলিয়াম কেরী রোডের উপর জননগর গীর্জা প্রাচীন ছাপাখানার সাক্ষ্য বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। শ্রীরামপুরকে জানবার আগ্রহে পৌঁছে গেছিলাম সেখানেও। গিয়ে দেখলাম দরজার সামনের বোর্ডে লেখা আছে ‘কেরী, মার্শম্যান ও ওয়ার্ড সাহেব প্রথম এই গৃহেই থাকতেন’। স্বাভাবিক ভাবেই একটা শিহরণ দিল সারা শরীরে। ইংরেজদের শহর কলকাতায় নিরাপদে ধর্মপ্রচারের সুযোগসুবিধা না থাকায় এই শহরে দিনেমারদের ছত্রছায়ায় কেরী সাহেবদের যে পথচলাটা শুরু হয়েছিল সেদিন, আজও যেন তারই স্মৃতি বুকে ধরে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে স্রোতস্বিনী ভাগীরথী। রাজা রামমোহন রায়ের হাত ধরে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যে নবজাগরণের বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলার প্রতিটা ঘরে, শ্রীরামপুর যে তার মধ্যে অগ্রগণ্য, তা এককথায় স্বীকার করতেই হয়। সারা দেশে ইংরেজদের দাপাদাপির মধ্যেও একটা পূর্ণাঙ্গ শহর দিনেমার শাসনে কিভাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে একটু একটু করে, তারই গল্পগাথা নিয়ে লিখতে শুরু করলাম শ্রীরামপুরের কথা৷

(চলবে…)

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।