শ্রীরামপুরের বিখ্যাত দেববিগ্রহ রাধাবল্লভ জিউ। বলা হয় একটি পাথর থেকেই তিনটি বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করবার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন নিত্যানন্দ প্রভুর পুত্র বৈষ্ণবাচার্য বীরচন্দ্র গোস্বামী। তাও স্বপ্নাদেশে পাথরটি সংগ্রহ হয়েছিল নদীয়ার নবাবের মূখ্য দরজা থেকে। সে এক আশ্চর্য কাহিনী। ঘটনাচক্রে আমাদের শ্রীরামপুরের রাধাবল্লভ বিগ্রহও সেই তিন মূর্তির একটি৷ তাই অতি প্রাচীন এই মূর্তির টানে প্রতি মাঘী পূর্নিমায় দলে দলে ভক্তের আগমন হয় শ্রীরামপুরের বল্লভপুরে। কিন্তু আজকের যে মন্দিরে দেববিগ্রহ সেবিত হচ্ছেন, সেটি আদি মন্দির নয়। আদি মন্দিরটি আজও দেখা যায় গঙ্গার তীরে ভগ্নদশায়। লোকে এখন ‘হেনরী মার্টিন প্যাগোডা’ বলেই চেনে। কী আশ্চর্য না! প্রাচীন হিন্দু দেবমন্দির হয়ে গেল প্যাগোডা। তবে চলুন ঘুরে আসি গঙ্গাতীরে, সেই প্যাগোডার ইটগুলো ছুঁয়ে।
নতুন মন্দির তৈরি হবার পর গঙ্গার তীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ল পুরনো মন্দিরটি। এদিকে মিশনারীদেরও দরকার সভা করবার জায়গা। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড ডেভিড ব্রাউন থাকতেন শ্রীরামপুরেই। মিশনারীদের বক্তৃতা ও সভা করবার জন্য তিনি পুরনো ও পরিত্যক্ত মন্দিরটির দখল নিলেন। এদিকে হেনরী মার্টিন সাহেব বন্ধু কেরী সাহেবের হাত ধরেই উঠেছিলেন ভারতবর্ষের জাহাজে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সিনিয়ার র্যাঙ্গলার’ উপাধি পাওয়া মার্টিন ছিলেন মিশনারী দলের অগ্রগণ্য সদস্য ও সুবক্তা। ডেভিড ব্রাউন সাহেবের ভবন পরিদর্শনের জন্য তিনি শ্রীরামপুর নগরে আসেন। পুরনো রাধাবল্লভ মন্দির ও তার সামগ্রিক পরিবেশ তাঁর এতোই মনে ধরে যায় যে নিজের বাসস্থানের জন্য বেছে নেন জায়গাটিকে। আর নিশ্চয় বলে দেবার অপেক্ষা থাকে না যে পুরনো মন্দির কেন আজ হেনরী মার্টিন প্যাগোডা।
এরপর মার্টিন সাহেবের এই বাসভবনেই শুরু হয় খ্রীষ্টান মিশনারীদের জনসভা। রোজ আলোচনায় হাজির থাকেন কেরী, মার্শম্যান সাহেব সমেত সকল মিশনারীগণ এবং কৃষ্ণপাল, গোকুল, কমলমণি, রামরতনের মত বাঙালী খ্রীষ্টানরা। দলে দলে স্থানীয় উদার বাঙালীও রোজ যোগদান করেন সভায়। কেউ কেউ দীক্ষাও নেন খ্রীষ্টমন্ত্রে। রেভারেন্ড কেরী, মার্শম্যান, বুকানন সমেত আরও বহু বিখ্যাত ধর্মপ্রচারক এখানে মিশনারীর প্রসারে বক্তৃতা করেন রোজ। গঙ্গার ভাঙনের ভয়ে একসময় পুরনো মন্দিরটি থেকে রাধাবল্লভকে জিউকে রাজা নবকৃষ্ণের তৈরি করে দেওয়া নতুন মন্দিরে অভিষিক্ত করা হয়। আর পরে সেই পরিত্যক্ত মন্দিরই হয়ে ওঠে মিশনারীদের ধর্মপ্রচারের মূল কেন্দ্র। গঙ্গার ভাঙনের গ্রাসে মন্দিরের একটা অংশ তলিয়েও গেছে জলে। কিন্তু অবশিষ্ট অংশে চলে ধর্ম আলোচনা। খ্রীষ্টান মিশনারীদের সভা ছাড়াও স্থানীয় হিন্দু ব্রাহ্মণের উদ্যোগে নিয়মিত চলে মহাভারত, রামায়ণের পাঠ। ভক্তপ্রাণ হিন্দুরাও ভিড় করেন সেখানে।
শ্রীরামপুর হয়ে ওঠে মিশনারী সমিতির প্রধান কেন্দ্রস্থল। এরমধ্যেই রেভারেন্ড কেরী সাহেব কৃষ্ণপালকে কলকাতায় পাঠালেন খ্রীষ্টধর্ম প্রচারের জন্য। কৃষ্ণপাল কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় সভা ও ধর্ম আলোচনার বন্দোবস্ত করলেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রতিদিন প্রায় দুটি করে সভার আয়োজন করলেন তিনি। একটু একটু করে বাড়তেও থাকল বাঙালী খ্রীষ্টান মিশনারীর সদস্য সংখ্যা। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আরও প্রায় ১০০ জন বাঙালী খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করলেন।
উইলিয়াম কেরী সাহেবের পুত্র ফিলিক্সকেরী থাকতেন ব্রহ্মদেশে। তিনি সেদেশের রাজার আহ্বানে রাজদূতের পদে অভিষিক্ত হন। এভাবেই শ্রীরামপুর হয়ে ওঠে সারা ভারতে খ্রীষ্টান মিশনারীদের কর্মকাণ্ডের মূল রাজধানী।
এরমধ্যেই ঘটে গেল এক ভয়াবহ ছন্দপতন। ১৮১২ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই মার্চ বুধবার শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের অফিসে ঘটে গেল এক ভয়ানক অগ্নিকাণ্ড। একদিনে নষ্ট হয়ে গেল প্রায় ৭০০০০ টাকার মুদ্রণ উপকরণ। মিশনারীদের সামনে সে এক ভয়ানক ক্ষতি। প্রেসের প্রায় ১৪ টি আলমারিতে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার পাণ্ডুলিপি সমেত রাখা ছিল বাইবেল অনুবাদের পাণ্ডুলিপিও। সন্ধ্যেবেলায় নিজের অফিসে বসে কাজ করছিলেন রেভারেন্ড উইলিয়াম ওয়ার্ড। কেরীসাহেব তখন মিশনারীর কাজে কলকাতায়। হঠাৎ ওয়ার্ড সাহেবের চোখ আটকে যায় কালো ধোঁয়ায়। কুন্ডলী পাকিয়ে কাগজের গুদামঘর থেকে বেরিয়ে আসছে দম আটকে যাওয়া ধোঁয়া। ছুটে গেলেন তিনি। আশঙ্কা সত্যি হল। আগুন লেগে গেল প্রেস অফিসে। ওয়ার্ড সাহেব দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলেন মার্শম্যান সাহেবের ঘরে। প্রেসঘরের জানলা দরজা বন্ধ করে ওপরে একটি ছোট্ট গর্ত দিয়ে জল ঢেলে আপ্রাণ আগুন নেভানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলেন দুজনে। আয়ত্তেও এলো কিছুটা। কিন্তু কোন এক কর্মচারী না বুঝে হঠাৎ একটি জানলা খুলে দিলে আবার হাওয়ায় নতুন করে জ্বলে ওঠে সমস্ত কাগজ। একে একে পুড়ে ছাই হয় কাগজের রিম, বাইবেলের পাণ্ডুলিপি, কাঠের অক্ষর সমেত সমস্ত মূল্যবান বই। এরপর বাইরে দাঁড়িয়ে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাওয়ার সাক্ষী থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না ইংরেজ মিশনারীদের। আগুনের ভয়াবহতা এমনই ছিল যে মাঝরাতের দিকে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে প্রেসের পুরো ছাদটা। পরের দিন সকালে রেভারেন্ড মার্শম্যান সাহেব নিজে কলকাতায় গিয়ে খবর জানান কেরী সাহেবকে। এই ভয়ানক ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে যান মিশনারীদের প্রধান ও মানবপ্রেমিক উইলিয়াম কেরী। শিশুর মত ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। প্রেসের যন্ত্রসমেত সমস্ত উপকরণ তাঁর হাত ধরেই আস্তে আস্তে প্রস্তুত হয়েছিল বহুদিনের চেষ্টায়। কিন্তু একটা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড যেন একদিনে কেড়ে নিল তাঁর সমস্ত স্বপ্নগুলোকে।
সবকিছু খুইয়ে আবার নতুন উদ্যোমে লেগে পড়লেন তাঁরাও। হেরে যাবার জন্য তাঁরা আসেননি সাগর পেরিয়ে। নতুন অক্ষর খোঁজ করবার জন্য সেইদিনই কলকাতার বড় বিপণীগুলোয় ঘুরলেন তাঁরা। কিন্তু প্রয়োজনমতো অক্ষরের হদিস না পেয়ে ফিরে এলেন শ্রীরামপুরে। তখনও ওরার্ড সাহেব পাগলের মতো পুড়ে যাওয়া কাগজপত্রের স্তুপ ঘেঁটে খুঁজে বেড়াচ্ছেন অক্ষত থাকা মূল্যবান বই আর মুদ্রণের উপকরণ।
এই খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর সমবেদনা জানায় সমগ্র খ্রীষ্টান সমাজ। দিগ্বিদিক থেকে এসে পৌঁছয় আর্থিক অনুদান। কিন্তু শত অর্থের মধ্যেও আর ফিরে এলো না ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া হাজার হাজার বই আর অমূল্য পাণ্ডুলিপিগুলোর খসড়া। মাথায় হাত দিয়েও আবার নতুন উৎসাহে প্রেস ও মিশনকে দাঁড় করাতে কোমর বেঁধে লেগে পড়লেন মিশনারীরা।